আর্থিক সংকটে জুলাই আন্দোলনে নিহত দেলোয়ারের পরিবার

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত দেলোয়ার
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত দেলোয়ার  © টিডিসি সম্পাদিত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে দোকানের মালামাল কিনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন দেলোয়ার হোসেন (৩৫)। পরে ২১ জুলাই ঢাকা শ্যামলী সিটি কেয়ার জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। 

দেলোয়ারের মৃত্যুর ৩ মাস পেরিয়ে গেছে।এখনো কান্না থামেনি মায়ের। বারবার ছুটে যাচ্ছেন ছেলের কবরের পাশে। আর কান্না করছেন,  আমার আদরের ছেলেকে কেন হত্যা করলো? এখন কে আমাকে ওষুধ কিনে দিবে? আমি কার কাছে থাকবো?মায়ের এ আহাজারি আর আর্তস্বরে ভারি হয়ে উঠছে চারপাশ।

স্বামীহারা জিন্নাতুন নেছা ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে ২৬ বছর অনেক কষ্ট ও সংগ্রাম করেছেন। তাদের মানুষ করেছেন। বার্ধক্যের এই দিনগুলোতে ছেলে দেলোয়ারের কাছে একটু স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন যাপন করছিলেন। সেই সন্তানের মৃত্যুতে হারিয়ে গেছে তার আহ্লাদ আর স্বাচ্ছন্দ্যের এই আশ্রয়টুকু।  

ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা জিন্নাতুন নেছা ও পিতা মরহুম সুলতান আহমেদের ছেলে নিহত দেলোয়ার হোসেন (৩৫)।  মা, স্ত্রী ও তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে ঢাকার মিরপুরে বসবাস করতেন। সেখানেই তার ফার্নিচারের দোকান ছিল।

জানা যায়, স্বামীহারা জিন্নাতুন নেছার (৬৯) পাঁচ ছেলের মধ্যে নিহত দেলোয়ার আর্থিকভাবে  অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ছিলেন। তাই মা জিন্নাতুন নেছাকেও নিজের ঢাকার বাসায় এনে রেখেছিলেন। মায়ের থাকা, খাওয়া, ওষুধ, চিকিৎসার পুরোটাই বহন করতেন দেলোয়ার। মায়ের জন্য তার আহ্লাদও যেন অন্য ভাইদের চেয়ে একটু বেশিই ছিল। দেলোয়ারের মৃত্যুর পরে মা এখন ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার দিনমজুর ছেলে আনোয়ারের সাথে থাকেন। টাকার অভাবে এখন আর নিয়মিত ওষুধও খেতে পারেন না।

সরেজমিনে দেলোয়ারের বড় ভাই আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় জিন্নাতুন নেছার সাথে। বয়সের কারণে নানান শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে তার। দেলোয়ারের কথা উঠতেই কেঁদে ওঠেন মা । তিনি বলেন, দেলোয়ারের বাবা সুলতান আহমেদ প্রায় ২৬ বছর আগে আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। পাঁচটি ছেলে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। শ্বশুর বাড়িতে থেকেই অনেক সংগ্রাম করে ছেলেদের বড় করেছেন। পাঁচ ছেলের মধ্যে দেলোয়ার ছিল চার নম্বর।

তিনি জানান, একটু বড় হওয়ার পর থেকে দেলোয়ার ঢাকায় গিয়ে ফার্নিচারের দোকানে কর্মচারীর কাজ নেন। গত কয়েক বছর আগে নিজেই ঢাকার মিরপুরে একটি ছোটখাটো ফার্নিচারের দোকান দেন। তার আগে থেকেই ছেলে মাকে তার কাছে নিয়ে যায়। দেলোয়ার সবসময় নিজেই মায়ের খাওয়া-দাওয়া ও শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর রাখতেন।  

দেলোয়ারের স্ত্রী লিজা বলেন, তার স্বামী গত ১৯ জুলাই বিকাল চারটার দিকে ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরে দোকানের মালামাল কিনতে যান। রিক্সা থেকে নামার পরে গোল চত্বরে শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে  মানুষের হুড়োহুড়িতে মাটিতে পড়ে যান। এ সময় তার তলপেটে তিনটি গুলি লাগে। স্থানীয়রা উদ্ধার করে একে একে তিনটি হাসপাতালে নিলেও কোথাও কেউ তাকে চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় দেলোয়ারের। পরে তাকে শ্যামলী সিটি কেয়ার জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। ঐদিন রাতেই দেলোয়ারের শরীরে অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু ২১ তারিখ সকাল পৌনে আটটার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেলোয়ার ইন্তেকাল করেন। পরে লাশ ভোলা সদরে গ্রামের বাড়িতে ঐ রাতেই দাফন করা হয়।

দেলোয়ারের বড় ভাই দিনমজুর আনোয়ার বলেন,আমার মা সারাদিন দেলোয়ারের কথা বলে কান্নাকাটি করে। ছুটে যেতে চায় বারবার ভাইয়ের কবরের পাশে। বয়স হয়ে যাওয়াতে শিশুর মত করছে মা। এছাড়া দেলোয়ারের স্ত্রী তিনটি ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। তাই তাদের সম্মানের সাথে জীবন যাপন করার জন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।

তিনি আরো বলেন, আমাদের কারো আর্থিক সচ্ছলতা নেই । ছোটবেলা থেকেই অভাবের সংসার। আমার অন্য ভাইয়েরা জেলে, কাঠমিস্ত্রি ও কৃষিকাজ করে। এই ভাইয়ের অবস্থা একটু ভালো ছিল। সে মা ও পরিবারের  সবার খেয়াল রাখতো। তিনি জানান, বাবা সুলতান আহমেদের  মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া কোন সম্পদ তারা পাননি। সব নিয়ে নিয়েছে দ্বিতীয়  পরিবারের সন্তানেরা।  তাই তাদের তেমন কোনো সম্পদ নেই।

এদিকে শহিদ দেলোয়ারের ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া ছেলে রাব্বি হাসান, ছয় বছরের মেয়ে হাসনুর ও ১৮ মাস বয়সী ছেলে হোসাইনকে নিয়ে আর্থিক সংকটে রয়েছেন স্ত্রী লিজা। চিকিৎসাতেই ব্যয় হয়েছে প্রায় চার লাখ টাকা। তার ওপর তিন ছেলেমেয়ের পড়ালেখা, খাওয়া। সামনের দিনগুলো কীভাবে চলবে তাই ভেবে দিশেহারা লিজা।

লিজা জানান, দেলোয়ারের হাসপাতালে চিকিৎসা, ওষুধ,  অপারেশন, মৃতদেহ অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়ি নিয়ে যাওয়া সহ সব মিলিয়ে প্রায় চার লাখ টাকার মত খরচ হয়েছে। পুরো টাকাই ধার দেনা করে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এখন সেই টাকাই বা কীভাবে পরিশোধ করবেন? ইতোমধ্যে তিনি দেলোয়ারের ফার্নিচারের দোকানটিও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

শহিদ দেলোয়ারের বড় ভাইয়ের স্ত্রী বিউটি বেগম জানান, দেলোয়ারের ভাইয়েরা সবাই গরিব মানুষ। তাদের পক্ষে চার লাখ টাকা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। তিনি দেবর শহিদ দেলোয়ারের পরিবারের জন্য সরকারি সহায়তার দাবি জানান।


সর্বশেষ সংবাদ