অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষায় দেশের অর্থ ও মেধার অপচয়

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে অংশগ্রহণ শেষে শিক্ষার্থীরা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে অংশগ্রহণ শেষে শিক্ষার্থীরা  © ফাইল ছবি

দেশের শিক্ষার প্রায় সব স্তরেই সর্বোচ্চ অবস্থান ধরে রেখেছে কৃষিনির্ভর পরিবারের সন্তানেরা। মাধ্যমিক পর্যায়ের ৪০ দশমিক ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই উঠে এসেছে দেশে কৃষিজীবী পরিবার থেকে। এছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের মোট ৪৭ লাখ ৩৬ হাজার ৯৬২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যেও কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান ১৯ লাখ ৯৯ হাজার ৪২৮ জন। এটি দেশের একক কোনো পেশা হিসেবে সর্বোচ্চ বলে উঠে এসেছে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে।

তবে শিক্ষা পরবর্তী কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণে বিপরীত চিত্র, উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা এবং দক্ষ জনসম্পদসহ নানা জিজ্ঞাসায় আবারও প্রশ্নের কাঠগড়ায় দেশের উচ্চশিক্ষা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের আবারও নতুন করে ভাবতে হবে উচ্চশিক্ষা নিয়ে, চাহিদা-ভিত্তিক খাতে তৈরি করতে হবে দক্ষ জনসম্পদ; পাশাপাশি ভাবতে হবে দেশের চলমান অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষা ও সামগ্রিক শিক্ষা নিয়েও।

ব্যানবেইসের প্রতিবেদন বলছে, দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের মোট এক কোটি এক লাখ ৯০ হাজার ২২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪০ দশমিক ৩৭ শতাংশই এসেছে কৃষিজীবী পরিবার থেকে। সংখ্যার হিসেবে যা ৪১ লাখ ১৪ হাজার ২০৮ জন—জানানো হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

তবে দেশে শিক্ষায় কৃষিনির্ভর বা সমপর্যায়ের পরিবারের সন্তানরা শিক্ষাগ্রহণ বা অংশগ্রহণে সমান সুযোগ পেলেও সে হিসেবের খেরোখাতায় উল্টো চিত্র দেশের চাকুরির বাজারে। শিক্ষার সুযোগ বা অংশগ্রহণ থাকলেও সমানভাবে থাকছে না পড়াশোনা শেষ করে তা প্রয়োগ অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ। ফলে উচ্চশিক্ষা দক্ষতা ও প্রয়োজনীয় জনসম্পদ পাওয়া এবং রাষ্ট্রীয় সাফল্য আনয়নে যতটুকু ভূমিকা রাখার কথা তা অন্তরাল হচ্ছে।

এতে দেশে পথ হারাচ্ছে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং যার অর্থনৈতিক সত্য হচ্ছে সময় মেধা আর অর্থের অপচয়—বলছেন দেশের শিক্ষা ও অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, শিক্ষিত হওয়ার মানসে সরাসরি এ ক্ষতি শিক্ষার্থীর মেধা ও অর্থের; পরোক্ষ হিসেবে যার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি দেশের বলে মনে করেন তারা।

ব্যানবেইসের তথ্য বলছে, দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫ লাখ ১৪ হাজার একজন। যার মধ্যে পেশাভিত্তিক হিসেবে কৃষকদের সন্তান ১১ লাখ ১০ হাজার ৫১১ জন। এরপর, ডিগ্রিতে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৩২২ জন, স্নাতক পর্যায়ে ৫ লাখ ৮ হাজার ৬৪৫ জন এবং স্নাতকোত্তরে রয়েছে ৫২ হাজার ৮৯০ জন কৃষিজীবীর সন্তান।

প্রতিষ্ঠানটির পরিসংখ্যান আরও বলছে, উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শ্রমজীবী পরিবারের সন্তানরা পড়াশোনা করছে ৫ লাখ ২৮ হাজার ৫৭ জন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সন্তান রয়েছে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৩৬৬ জন ও ব্যবসায়ীদের সন্তানরা পড়াশোনায় সংখ্যার হিসেবে রয়েছেন ৪ লাখ ৬১ হাজার ৯৫জন।

তাদের পরিসংখ্যানে নিচের দিকে রয়েছে প্রকৌশলী, কামার বা কুমার ও তাঁতিদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার হিসেব। দেশের ১৪ হাজার ৮৬৮ জন শিক্ষার্থীর অভিভাবকের পেশা প্রকৌশলবিদ্যা। পাশাপাশি, ১৭ হাজার ৫৬৬ জনের অভিভাবকের জীবিকা নির্বাহের উপায় কামার বা কুমার এবং ১৯ হাজার ৫৮৪ জনের অভিভাবক তাঁতি। আর দেশের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষকদের সন্তান রয়েছে এক লাখ ৪৮ হাজার ২৬৬ জন বলেও জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে। এছাড়াও, একই তালিকায় আরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল জেলে, প্রবাসী, সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবী, চিকিৎসক, তাঁতি এবং অন্যান্য পেশাজীবীদের সন্তানদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাসান এ. শাফী মনে করেন, দেশের অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষি এবং কৃষিভিত্তিক হওয়ার কারণে কৃষিভিত্তিক পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি হতে পারে। তবে তিনি কোনো পরিকল্পনা ও চাহিদা বিবেচনা ছাড়াই উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বিরোধিতা জানান।

দেশে বর্তমানে উচ্চশিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা বাড়ছে। যার ফলে দেশে মেধা ও অর্থের অপচয় হচ্ছে। এটা এককভাবে ব্যক্তির বিনিয়োগ ও রাষ্ট্রের উভয় পর্যায়েই হচ্ছে; যার কারণ অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষা। এখানে কোনরকম বাজার সার্ভে হয় না; অর্থাৎ আমাদের কোন খাতে চাহিদা আছে—তা বিবেচনা করা হচ্ছে না। উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ইচ্ছেমতে কোর্স সাজাচ্ছে। যাতে আমাদের শিক্ষিতদের সংখ্যা বাড়ছে, দক্ষতা বাড়ছে না; দক্ষ জনসম্পদ তৈরি হচ্ছে না—অধ্যাপক হাসান এ. শাফী

সমস্যা সমাধানে চাহিদা-ভিত্তিক ও পরিকল্পিত শিক্ষার ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, এখন আমদের প্রয়োজন মার্কেট সার্ভে করা এবং বাজার চাহিদা-ভিত্তিক পাঠ্যসূচি সাজানো। যদিও তা আরও আগে করা প্রয়োজন ছিল বলেও মনে করেন তিনি। পাশাপাশি আমাদের গণহারে উচ্চশিক্ষা না দিয়ে দক্ষ জনসম্পদ তৈরির পরামর্শও তার। একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনায় কমানো যেতে পারে অপ্রয়োজনীয় ও চাহিদা নেই এমন আসন সংখ্যাও।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দেশের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের শ্রমবাজারে প্রবেশের কঠিন শর্ত, প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় দক্ষতায় পিছিয়ে থাকা, কভিড-১৯ মহামারীর কারণে তরুণদের জন্য প্রতিনিয়ত সংকুচিত হচ্ছে শ্রমবাজার, চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা অর্জন করতে না পারা, চাহিদার তুলনায় প্রয়োজনীয় বা সমান সংখ্যক বাজার চাহিদা সৃষ্টি না হওয়াসহ ইত্যাদি কারণে দেশের তরুণ-সমাজ পিছিয়ে আছে বলেও তাদের প্রতিবেদনে জানায় সংস্থাটি।

আইএলও ‘বিশ্বজুড়ে তরুণদের কর্মসংস্থানের প্রবণতা ২০২২’ (দ্য গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ) শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে তারা বলছে, মহামারিকালে দেশে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে তরুণ বেকারদের সংখ্যা। তাদের তথ্য বলছে, দেশে তরুণদের মাঝে বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ এবং জাতীয় পর্যায়ে এ হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।

সমস্যা সমাধানে আমাদের চাহিদা-ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার দিকে যেতে হবে। শিক্ষায় আমাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হচ্ছে এবং শিক্ষায় সূচক ইতিবাচক রাখতে দ্রুত পলিসি পরিবর্তন না হওয়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রতিবেদনের প্রাথমিক তথ্য বিশ্লেষণ বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ১৯ দশমিক ১১ শতাংশ তরুণ, সংখ্যার হিসেবে যা ৩ কোটি ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৮১১ এবং তাদের সকলের বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছর।

বৈশ্বিক মহামারী, মন্দা, যুদ্ধসহ নানা কারণে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতিনিয়ত তরুণদের লড়াই করে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। তথ্য বলছে, প্রচলিত ব্যবস্থায় বর্তমানে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার তরুণের সংখ্যা ২৭ লাখ।

বিবিএস-এর  জরিপ বলছে, দেশের বেকার তরুণদের মধ্যে সবাইই কর্মক্ষম বেকার। যদিও আইএলওর প্রতিবেদনে বলছে, দেশে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত মিলিয়ে মোট বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। তরুণদের দক্ষ করে গড়ে তুলে কর্মসংস্থান সৃষ্টিই বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ্য করে সংস্থাটি। আর অর্থনীতিবিদরা মনে করেন এতে বড় আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি পরোক্ষ অপচয় মেধা, সময় আর তরুণদের উদ্যমের।

অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন চিন্তাবিদ ও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমানও একমত দেশের উচ্চশিক্ষা দক্ষ জনসম্পদের যোগান দিতে পারছে না; পাশাপাশি অপচয় হচ্ছে মেধা এবং অর্থেরও। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, আমরা প্রচলিত শিক্ষায় প্রয়োজনভিত্তিক দক্ষ জনবল তৈরি করতে পারছি না। যার ফলে আমাদের দক্ষ জনবলের অভাবের সুযোগ নিয়ে পার্শ্ববর্তী ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশ আমাদের দেশ থেকে প্রায় ৫-৬ বিলিয়ন ডলার আয় করছে বেসরকারি খাতে। সেজন্য এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন শিক্ষা এবং দক্ষতার সম্মিলন ঘটাতে হবে।

দেশের উচ্চশিক্ষা ও শিক্ষিত বেকার প্রেক্ষিতের সমাধান হিসেবে তিনি সমাধান হিসেবে দেখছেন খাতভিত্তিক দক্ষ জনবল সৃষ্টির প্রয়োজন ও গবেষণাকে। উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন অর্থাৎ সকল পর্যায়েই আমাদের দক্ষ জনবলের চাহিদা আগে নিরূপণ করতে হবে; চাহিদার প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠান, দক্ষ জনবল সৃষ্টির জন্য দক্ষ জনবল, শিক্ষক, অর্থায়ন, নীতিমালা, আইন এবং সবচেয়ে জরুরি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি। অনেক দেশ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ও দক্ষতার অভাবে তারা তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি—যুক্ত করেন ড. কাজী খলীকুজ্জমান। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান সমালোচনা করেন দেশের কলেজগুলোতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স (স্নাতক) কোর্স চালুর বিষয়ে। তিনি এর প্রয়োজনীয়তা, উপযোগিতা বা ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তুলে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কোন সার্ভে ছাড়াই অনার্স (স্নাতক) খোলা হয়েছে। এতে সময়ের অপচয় হচ্ছে; শিক্ষার্থীদের ক্লাস করানো ছাড়াই পরীক্ষা এবং সর্বশেষ ফলাফল দেয়া হচ্ছে।

অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, কারিগরি শিক্ষার পলিসি, সিলেবাস পরিবর্তন করতে হবে। তিনি তার অধীনে একটি গবেষণার সূত্র উল্লেখ করে বলেন, তাদের ল্যাব, থিসিস ইত্যাদির যথেষ্ট ঘাটতি আছে। এছাড়াও চাহিদা-ভিত্তিক দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে শিক্ষা ও সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা বৃদ্ধি, পলিসি পরিবর্তন, দক্ষ জনবল নিয়োগ করার পরামর্শও দেন এই অধ্যাপক।


সর্বশেষ সংবাদ