২৭ বছর আগের ‘গাভী বিত্তান্ত’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখনকার প্রতিচ্ছবি
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২২, ১২:৩৭ PM , আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২২, ১২:৫৮ PM
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘বিশেষ দেশ, বিশেষ জাতি যে বিদ্যা সম্পর্কে বিশেষ প্রীতি, গৌরব ও দায়িত্ব অনুভব করেছে তাকেই রক্ষা ও প্রচারের জন্য স্বভাবতই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সৃষ্টি।’
তবে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদ্যার এই গৌরব রক্ষায় কতটুকু দায়িত্ব পালন করছে তা জানতে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ২৭ বছর আগে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত আহমদ ছফার বিখ্যাত কালজয়ী উপন্যাস ‘গাভীবিত্তান্তে’। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ ও পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে উন্যাসটি লেখেন প্রথাবিরোধী এই লেখক।
অদ্ভুত হলেও বাস্তব, তখনকার বর্ণনার সাথে এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ জোড়া কবুতরের মতো মিলে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতিকে উপজীব্য করে লেখা বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ স্যাটায়ার বোধ হয় ‘গাভীবিত্তান্ত’ই। ঘটনার সুনিপুণ বিশ্লেষণ, হাস্যরসবোধে ভরা, আয়নার মতো স্বরূপ দেখানো এই বইটি বারবার পাঠককে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মিয়া মুহাম্মদ আবু জুনায়েদ, দেশের শ্রেষ্ঠ ও প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়টির রসায়ন বিভাগের একজন অধ্যাপক। স্বভাবে চুপচাপ, গোবেচারা ধরনের মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি তখন নোংরা— শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, স্বার্থপরতা ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ে বিধ্বস্ত। রাজনীতি আর ক্ষমতার লোভকে কেন্দ্র করে চলা কোন্দলে শিক্ষার্থীর হাতে খুন হচ্ছে অপর শিক্ষার্থী। প্রমোশন-ডিমোশনের নোংরা খেলায় লিপ্ত শিক্ষকগণ।
এতকিছুর কোনোটিতেই না থেকে কাকতালীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হয়ে যান মিয়া মুহাম্মদ আবু জুনায়েদ। হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া এই কাহিনীই পাল্টে দেয় তার জীবনের রূপ। মিছিল-মিটিংয়ের ঝামেলা, সহকর্মীদের অসন্তুষ্টি, দাবী-দাওয়ার সামাল দিতে হাপিয়ে ওঠেন তিনি। চারপাশে সুযোগসন্ধানীদের আনাগোনা, পর্দার আড়ালের ষড়যন্ত্র।
এসব কিছুর পরে পরিবারে গিয়ে যে শান্তি খুঁজবেন তারও জোঁ নেই। স্বামীর হঠাৎ প্রমোশনে স্ত্রী নুরুন্নাহার বানুর ভেতর জেগে ওঠে নতুন সত্ত্বা— ‘উপাচার্যের বেগম’। নুরুন্নাহার বানুর বাবার টাকায় লেখাপড়া করেন আবু জুনায়েদ। এ কারণেই তিনি মনে করেন তার ভাগ্যজোড়েই স্বামীর এমন উন্নতি।
শেষমেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনে সপরিবার উঠে বসেন আবু জুনায়েদ। দিন না যেতেই জেগে ওঠে নুরুন্নাহার বানুর রানি হওয়ার স্বাদ। উপাচার্য ভবনের দায়িত্বে বহাল মালি থেকে শুরু করে সকল সরকারি কর্মচারীর উপর কর্তৃত্ব ফলাতে শুরু করেন তিনি। বাদ যায় নি স্বামীর সহকর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকরাও। উচ্চাসনে উঠে ভুলে বসেন স্বামীর গুরুত্বও। পরিবারে একরকম খেলনার পুতুল হয়ে যান উপাচার্য আবু জুনায়েদ।
একদিকে প্রশাসনিক ঝামেলা, অন্যদিকে পারিবারিক অশান্তি। সব মিলিয়ে তার জীবন অতিষ্ট। উপন্যাসের এই অংশটিতে আহমদ ছফার স্পষ্টবাদিতার পরিচয় মেলে। বড় বড় পদে যখন অযোগ্যরা বসে যায় তখন তারা কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে বসে। তাদের আশপাশের মানুষরাও নুরুন্নাহার বানুর মতো নিজেদের সেই ক্ষমতার ধারক মনে করে। ঠিক এই গুরু বিষয়টি সোজাসাপ্টা তুলে ধরেন ছফা।
কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া আবু জুনায়েদ একদিন চাচা-শ্বশুরের কাছ থেকে উপহার পান অস্ট্রেলিয়ান-সুইডিশ ক্রস ব্রিডের একটি দুষ্প্রাপ্য গাভী। সঙ্গে সঙ্গেই তার ভেতরকার কৃষকসত্ত্বা জেগে ওঠে। সেন্সিটিভ এই গাভীটির যথাযথ পরিচর্যা নিয়ে ভাবতে থাকেন তিনি। গাভীর সুস্বাস্থ্য ও যথাযথ দেখভাল নিশ্চিত করতে উপাচার্য ভবনের পেছনের দিকে মনোরম পরিবেশে তৈরি করে ফেলেন একটি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত গোয়ালঘর।
পারিবারিক ও কর্মজীবনের সব ঝামেলাকে একপাশ করে গাভী পালনে মগ্ন হয়ে পড়েন তিনি। দিনের বেশিরভাগ সময় পার করতে থাকেন গোয়ালঘরে। আস্তে আস্তে ওই গোয়ালঘরই তার কর্মস্থলে রূপান্তরিত হয়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হতে শুরু করে ওই গোয়ালঘর থেকে।
সহকর্মীদের নিয়ে ওখানেই গড়ে তোলেন জমজমাট আড্ডার আসর। মোদ্দাকথা, বিশ্ববিদ্যালয় যেন তার কেন্দ্র পরিবর্তন করে আশ্রয় নেয় ওই গোয়ালঘরেই। পরে এই গাভী নিয়ে নতুন করে সমস্যার সৃষ্টি হয়। ছাত্র-শিক্ষক নানা দলে বিভক্ত হয়ে যায়। কেউ কেউ তার গাভী পালার ব্যাপক সমালোচনা করতে শুরু করে। আবার আরেক দল নিজেদের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে নিঃস্বার্থ পশুপালনের নামে মিয়া মুহাম্মদ আবু জুনায়েদের এই কাজকে যৌক্তিক দাবী করে সমর্থন করতে থাকে। পরে আরেক সহকর্মীর উৎসাহে নানান জাতের পাখি সংগ্রহ করে গোয়ালঘরে গড়ে তোলেন পক্ষীশালা।
আবু জুনায়েদ মগ্ন গাভী আর পাখি নিয়ে। অন্যদিকে কোথায় গেল পরিবার, কোথায় আছে বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রতি নেই কোনো ভ্রুক্ষেপ। স্ত্রী নুরুন্নাহার বানু চিন্তা করেন এই গাভী আসার পর থেকে স্বামী তার প্রতি ভালোবাসা কমিয়ে দিয়েছে। তাই একদিন বিষ খাইয়ে গাভীটিকে তিনি মেরে ফেলেন। উপাচার্যের মতো একটা বড় দায়িত্ব নিয়ে আবু জুনায়েদ গাভী পালন ও গাভীর মৃত্যুপরবর্তী শোক পালনে কাটিয়ে দেন পুরোটা সময়। আবার ঠিক এমন উপাচার্যকেই শেষে সরকার সমস্ত বিশ্বের ৫১ টি দেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেন। যার জন্য ছিল লাখ টাকার সম্মাননা।
সম্পূর্ণ বই জুড়ে আহমদ ছফা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার অপব্যবহারের চিত্র তুলে ধরেছেন। মিয়া মুহাম্মদ আবু জুনায়েদ অযোগ্য ক্ষমতাসীনদের স্বরূপ। সরকারি টাকায় তার পশুপালন প্রতিনিধিত্ব করে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার অপব্যবহারের। বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী আর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে কী! ২৫ বছর পর এসে এখনো বইটি পড়লে পাঠকের মনে হবে, লেখক বোধ হয় বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে বিদ্রুপাত্মক লেখা লিখেছেন।
যেখানে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে আত্মোন্নতির বলে দেশে কাজ করবে সেখানে তারা করছে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে থাকা পা-চাটা রাজনীতি; যেখানে শিক্ষকরা করবেন মানুষ গড়ার কাজ সেখানে তারা খেলছেন প্রমোশন-ডিমোশন খেলা; যেখানে উপাচার্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্তি হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে সেখানে হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে। প্রতিবাদী লেখক আহমদ ছফা স্রোতে গা না ভাসিয়ে, কারো সাফাই না গেয়ে লেখে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চরম বাস্তব বর্ণনা। এই বইয়ের বাস্তবিক শিক্ষা পড়া এবং জানার গণ্ডি পেরিয়ে আন্দোলন পর্যন্ত গড়ায়।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার চরম অধঃপতন এই ‘গাভী বিত্তান্ত’র বর্ণনা বাস্তবিক উদাহরণ। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাব্যবস্থার গৌরবময় অতীত নিয়ে গর্ববোধ করার আগে অবশ্যই এই বইটি পড়ে সবার যাচাই করা উচিত আদৌ গর্ব করার মতো বর্তমানে কিছু আছে কি না।