পুলিশ অফিসারের চাকরি ছেড়ে বিসিএসে তথ্য ক্যাডার তিতুমীরের বীথি

বীথি প্রধান
বীথি প্রধান  © টিডিসি ফটো

বীথি প্রধান। সম্প্রতি প্রকাশিত ৪৩তম বিসিএসের চূড়ান্ত পরীক্ষায় তথ্য ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) অধিভুক্ত সরকারি তিতুমীর কলেজের গণিত বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা এই শিক্ষার্থী বিসিএসে পেয়েছেন একাধিক সাফল্য। তবে তার এ যাত্রা সহজ ছিল না। ৪৩তম বিসিএসের পরীক্ষার জন্য ছাড়তে হয়েছিল পুলিশ অফিসারের চাকরি। বিসিএসের বাইরেও একাধিক সরকারি  চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত আছেন। স্বপ্ন দেখেন একদিন তার নিজের টাকায় মা-বাবাকে হজ্জ করানোর। তার বিসিএস জয়ের গল্প শুনেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের—আমান উল্যাহ আলভী।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সাফল্য নিয়ে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
বীথি প্রধান: আমি এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না যে আমি প্রজাতন্ত্রের একজন প্রথম শ্রেণির কর্মচারী হতে যাচ্ছি। তবে আমার মায়ের কান্নাভেজা চোখ, বাবার নির্লিপ্ত চাহনি আর আত্মীয় স্বজনদের উচ্ছ্বাস বলে দিচ্ছে আমি সফল।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার শৈশব নিয়ে বলুন।
বীথি প্রধান: আমার দুরন্ত শৈশব কেটেছে গ্রামে। আমরা একঝাঁক ভাইবোন ছিলাম। চাচাতো বোন মিতু, ভাই হাসান, সৈকত, ফুপাতো বোন সোমা সবাই ছিল আমার সমবয়সি। একসাথে স্কুলে যাওয়া, গাছে ওঠা, সাইকেল চালানো, বিলে সাঁতার কাটা, মাছ ধরা থেকে শুরু করে এমন কিছু নেই—যা আমরা করিনি। এখন সবাই সবার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

তবে আমি তাদের খুব মিস করি এখনো। আমার শৈশবের কিছু সময় নানু বাড়িতেও কেটেছে। নানু বাড়িতে খালামনি ছিল আমার একমাত্র বন্ধু। আমার প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা। এই মানুষটাকে আমি অত্যন্ত পছন্দ করি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানতে চাই
বীথি প্রধান: আমার স্কুল জীবনের শুরু ছনি বাড়িয়ারটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এরপর ইউসুফগঞ্জ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করি। ঢাকা উইমেন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের গণিত বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার সাফল্যের পেছনে প্রধান অনুপ্রেরণা কে ছিলেন?
বীথি প্রধান: আমার বড় মামা আব্দুল হাই দেওয়ান। তিনি পেশায় একজন ব্যাংকার। আমার চেয়ে বেশি বিশ্বাস ছিল আমার মামার। তিনি সবসময় চাইতেন আমি ভালো কিছু করি। সবার কাছে গর্ব করে আমার গল্প করতেন। তার এই চাওয়া আমাকে সবসময় ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

আমার মেজো মামা হেলাল দেওয়ান আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। তিনি সবসময় আমার পড়াশোনা সংক্রান্ত সকল ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। তিনি আমাকে সবসময় হাতখরচ এর টাকা দিতেন। ক্যাডার হওয়ার পর আমাকে নিয়ে তার উচ্ছ্বাসের শেষ নেই।

আমার ছোট মামার কথা না বললেই নয়, তিনি আমাকে সকল বোর্ড পরীক্ষার কেন্দ্রে নিয়ে যেতেন এবং অপেক্ষা করতেন। তাদের এসব অবদান আমাকে ভালো কিছু করার প্রেরণা দিয়েছেন সর্বদা। আমার শিক্ষক চন্দ্রশেখর সরকার স্যার সবসময় ফোন করে আমার খোঁজ নিতেন। আমাকে উৎসাহ দিতেন। স্যারের এই উৎসাহ আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করেছে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার প্রস্তুতির বিশেষ কোনো টেকনিক ছিল কি-না, কোন বিষয়টি আপনাকে প্রস্তুতি এগিয়ে রেখেছিল?
বীথি প্রধান: আমরা গ্রুপস্টাডি করতাম। এটা বেশ কাজে দিয়েছে। সম্মিলিতভাবে পড়ার কারণে অনেক দ্রুত পড়া যেত। তাছাড়া আমরা নানা রকম গল্প, ছড়া আর সূত্র বানিয়ে পড়তাম। এতে অনেক কঠিন টপিকও সহজ মনে হতো।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: প্রস্তুতির সময়টা কেমন ছিল?
বীথি প্রধান: বিসিএসের তিনটি ধাপের মধ্যে সবচেয়ে সহজ হলো লিখিত পরীক্ষায় পাস করা। তবে ভালো করা সবচেয়ে কঠিন এখানেই। বাংলাদেশ বিষয়াবলি ও বাংলা এই দুটো বিষয়ে প্রচুর লিখতে হয়। লিখিত পরীক্ষায় আমি প্রচুর ডাটা, চার্ট ও ম্যাপ ব্যবহার করেছি। এগুলো আমাকে এগিয়ে রেখেছে বলে আমার মনে হয়। তবে ম্যাথ ও ইংরেজিতে ভালো করার বিকল্প নেই।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার পরিবার সম্পর্কে বলুন।
বীথি প্রধান: ৫ ভাই বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। গ্রামের আট দশ জনের মতোই সহজ সরল ও সাদামাটা আমার বাবা-মা। তারা আমাকে আমার সব ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। আমার সকল সিদ্ধান্তে তারা আমার পাশে ছিল। আমি এর আগে আরো দুটি সরকারি চাকরি ছেড়েছি। ২০২১ সালে আমি পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হই।সারদায় দুই মাসের ট্রেনিং ও করি। সবাই বলেছিলো বিসিএসের জন্যে ছুটি পাবো। কিন্তু সেই ছুটি আর আমি পাইনি।

পরক্ষণেই আমি চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেই। কেউ আমাকে সাপোর্ট করেনি তখন। প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সবাই আমাকে চাকরি না ছাড়ার পরামর্শ দেন। আমি মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিলাম। সেই সময় আমার বাবা-মা আর বড় মামা আমার পাশে ছিলেন। রাজশাহী যেদিন ছেড়ে আসি সেদিন মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই আর একটি চাকরি না পেয়ে আমি বাড়ি যাব না । আলহামদুলিল্লাহ এরপর বিসিএসসহ আরো ৩টি চাকরি আমি পেয়েছি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কীভাবে ক্যাডার চয়েজ করেছিলেন?
বীথি প্রধান: পুলিশ আমার বরাবরই প্রথম পছন্দ ছিল। পুলিশ প্রথমে দিয়ে বাকিগুলো সিরিয়ালি দিয়েছিলাম। চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে এবং মেয়ে হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণে পুলিশ ক্যাডার আমার বেশি ভালো লাগে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কোন কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে ক্যাডার চয়েজ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন?
বীথি প্রধান: আমি মনে করি এটা সবার ব্যক্তিগত পছন্দ। এখন সবাই সব ক্যাডার সম্পর্কে কম বেশি জানে। ইংরেজিতে ভালো হলে পররাষ্ট্র আর ভালো উচ্চতা থাকলে পুলিশ প্রথম দেয়া উচিত। এই বিষয়গুলো ভাইভাতে কিছুটা এগিয়ে রাখতে পারে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: যারা বিসিএস দিতে চান তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি?
বীথি প্রধান: একটা বিসিএস শেষ হতে ৩-৪ বছর বা আরো বেশি সময় লেগে যায়। সুতরাং প্রথমেই এতো সময় ধৈর্য ধরে লেগে থাকার মানসিকতা থাকতে হবে, পরিশ্রমী হতে হবে। ইংরেজি, ম্যাথ ও বিজ্ঞানে জোর দিতে হবে। নিয়মিত পত্রিকা পড়ার অভ্যাস থাকলে ভালো।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: চাকরিপ্রার্থীদের বিসিএসকে একমাত্র লক্ষ্য বানানো কি ঠিক?
বীথি প্রধান: বিসিএস কখনোই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। একমাত্র লক্ষ্য বলে কিছু হয় না আসলে। ব্যাংকে সমস্যা না থাকলে ব্যাংকে চেষ্টা করা উচিত। তবে বিসিএস বেজড পড়াশোনা করলে ব্যাংকসহ অন্য যেকোনো চাকরির প্রস্তুতি হয়ে যায়। কেননা সব চাকরির পরীক্ষাই এখন সমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ। সুতরাং পড়াশোনার কোন বিকল্প নেই। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই?
বীথি প্রধান: বাবা মাকে নিজের টাকায় মক্কায় হজে পাঠাতে চাই। সর্বোপরি দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে চাই। আমি সকলের দোয়া প্রার্থী।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
বীথি প্রধান: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের জন্যেও শুভ কামনা রইলো।


সর্বশেষ সংবাদ