ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

টিএসসি-ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় এক কেজি মুরগি ৪৫ খণ্ডে বিক্রি

টিএসসির খাবার ও ক্যাফেটেরিয়া
টিএসসির খাবার ও ক্যাফেটেরিয়া  © সম্পাদিত

স্বাভাবিকভাবে বাসা-বাড়িতে এক কেজি মুরগি রোস্টের জন্য ৪ পিস করা হয়। ভুনার জন্য ১০/১২ পিস করা হয়। কিন্তু কল্পনারও বাহিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান দুই ক্যাফেটারিয়া ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) ও ডাকসু ভবনের কলাভবন ক্যাফেটারিয়ায়। সেখানে ১ কেজি মুরগি ৪৫ খন্ড করা হয়। মাঝেমধ্যে শুধু ছোটো একটা হাড় দিয়ে খাবার পরিবেশন করার অভিযোগ রয়েছে। 

খাবারে মোটা চাল, মসলা কম হওয়ায় খাবারের অযোগ্য হয়ে উঠেছে এই দুই ক্যাফেটারিয়ার খাবার। কর্তৃপক্ষ কম দামের অজুহাত দিলেও সেই কম দাম থেকে লাভ হয় কর্তৃপক্ষের। নিম্নমানের খাবার খেয়ে শিক্ষার্থীদের অসুস্থ হওয়ার ঘটনাও কম নয়।

১৯৯০ সালের আগে ক্যাফেটারিয়াগুলোতে খাসির মাংস দিয়ে দুপুর এবং রাতের খাবার দেওয়া হতো। কিন্তু ১৯৯০ সালের পরে মুরগি শুরু হয়। ৩৩ বছর ধরে মুরগি চললেও পরিবর্তন হয়নি এই মেন্যু। ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে খাবারের পরিবর্তন বিষয়ে এজেন্ডা থাকলেও সে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারেনি ডাকসুর নেতারা।  

ক্যাফেটারিয়ার খাবারের রুটিন থেকে জানা যায়, ২০ টাকা মূল্যের ডাকসু ক্যাফেটারিয়ায় দুপুরে সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে পোলাও মুরগি, মুরগি-খিচুড়ি দেওয়া হয়। রাতে প্রতিদিন মুরগি-ভাত সাথে ডাল দেওয়া হয়। টিএসসির ক্যাফেটারিয়ায় দুপুরের খাবার রুটিন একই রকম। এছাড়াও ডাকসু ক্যাফেটারিয়ায় ৩ টাকা মূল্যের সমুচা, সিঙ্গারা ও চপ থাকে। এক টাকা মূল্যের লাল চা। একই রকম নাস্তা টিএসসি ক্যাফেটারিয়া হলেও সেখানে ৭ টাকা মূল্যের কেক পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন: ঢাবি হলের ক্যান্টিনে খাবারের দাম বাড়লেও কমেছে মান

ক্যাফেটারিয়ার বাবুর্চিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রসেস (গোস্ত-হাড্ডি) করা এক কেজি ব্রয়লার মুরগি ২৭০/২৮০ টাকা বাজার ধর। কাটারি পোলাওর চাউল ১ কেজি ৮০ টাকা ধরে আনা হয় এবং সাদা ভাতের জন্য চাল (আটাশ) ব্যাবহার করা হয় যার দাম ৫৪/৫৫ টাকা।  

ডাকসু ভবনের কলাভবন ক্যাফেটারিয়ায় শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার

জানতে চাইলে টিএসসি ক্যাফেটারিয়ার প্রধান বাবুর্চি নজরুল ইসলাম বলেন, এখন থেকে ৪/৫ বছর আগে ও মুরগির পিস কেজিতে ২০/২২ পিস হতো। কিন্তু এখন দাম বাড়ার কারণে ৪২ থেকে ৪৫ পিস হয়।   

ডাকসু ক্যাফেটারিয়া বাবুর্চি রিয়াদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ১ কেজি মুগিতে ৪২ টুকরা করা হয়। ১২ বছর ধরে আমি এখানে কাজ করি। আগে এক কেজি মুরগিতে ২০/২৫ টুকরা হতো।

আরও পড়ুন: ঢাবি হলের অপরিচ্ছন্ন ও অপুষ্টিকর খাবারে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

মুরগির রান্না খাওয়ার অযোগ্য। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ মুরগি রান্নায় মসলা দেওয়া হয় কম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এ বাবুর্চি বলেন, মসলা দেওয়া হয়। তবে আগে থেকে একটু কম দেওয়া হয়।

ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের তালিকা

বাজারের দাম হিসেব করে দেখা যায়, ব্রয়লার মুরগি ২৮০ টাকা কেজিতে ১ কেজি মুরগি ৪৫ টুকরা হলে মুরগির টুকরার দাম ৬ টাকা ২০ পয়সা হয়। ৮০ টাকা দামের ১ কেজি পোলাউর চাউল (কাটারি) ১২ জনকে খাওয়ানো হয়। সে হিসেবে এক প্লেটের দাম সাড়ে ৬ টাকা পড়ে। দুইটি মিলে  ১৩ টাকা ও খরচ পড়েনা। সাথে মসলাসহ আরো ৩ টাকা ধরলে ও খরচ ১৬ টাকা। তারমানে ২০ টাকার খাবারে ২০ টাকাও পুরোপুরি খরচ হচ্ছেনা। একিভাবে রাতে এক কেজি চাল ৬ জনের জন্য হিসেব করা হয়। ২৮ চাল যা আনা হয় ৫৫ টাকা ধরে।

উল্লেখ্য, এই ২ ক্যাফেটারিয়ার গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ও স্টাফ খরচ বিশ্ববিদ্যালয় এককভাবে বহন করে। তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি সাপোর্ট দেওয়ার পরও  ২০ টাকা থেকে কেন কম খরচ করা হয়।

আরও পড়ুন: নিম্ন মানের খাবারে আর ছারপোকার কামড়ে ঢাবি জীবন ‍শুরু নবীন শিক্ষার্থীদের

খাবারের মানের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ডাকসু ও টিএসসি ক্যাফেটেরিয়া খাবার এখন খাওয়ার অযোগ্য হয়ে গিয়েছে। যেদিন পোলাও দেওয়া হয় এক প্লেট পোলাও স্বাভাবিক ৭/৮ লোকমা ও হয়না। মুরগির টুকরা তো মাঝে মাঝে চোখে ও দেখা যায়না। মাঝে মাঝে শুধুৃ ছোট একটা হাড্ডি দেওয়া হয়। খাওয়ার টেস্ট খুবই জঘন্য। না একটু স্বাদ হয়, না একটু পেট ভরে খাওয়া যায়। ক্যাম্পাসে থাকলে কিছু খেতে হয় তাই খাওয়া হয়।  

“শিক্ষার্থীদের যে পরিমাণ খাবার দেওয়া হয় এবং তার মাঝে ছোট এক টুকরা মাংস খুব খারাপ দেখা যায়। আমি তাদেরকে বলেছি যদি এই পরিমাণ খাবার এবং আরও দুইটা সবজি যুক্ত করা যায় অন্তত একটু হলেও খাবারের মানটা ভালো হয়”-ঢাবি ভিসি

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের খাওয়ার জন্য খুব কম জায়গা আছে। তাছাড়া অনেকেই আর্থিক সংকটের কারণেও বাধ্য হয়েই নির্ভর করতে হয় ডাকসু বা টিএসসির এই ক্যাফেটেরিয়াগুলোতে। কিন্তু বর্তমান সময়ে ২০ টাকায় খাবার বিক্রি করা যেমন অমূলক; তার থেকেও অদ্ভুত এখানকার খাবারের পরিমাণ। এত স্বল্প এবং নিম্নমানের খাবার যেন শিক্ষার্থীদের মুখের উপর একটা পরিহাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব বিষয়ে নজর আছে বলেও মনে হয় না। ক্যাফিটেরিয়াগুলোর খাবারের মান উন্নত করা না গেলে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত থেকে যাবে।

আরও পড়ুন: ঢাবিতে খাবারের দাম কমিয়ে মান বাড়ানোর দাবিতে মানববন্ধন
   
পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলছেন, ১০০ গ্রাম কাচা মুরগির মাংসে ১০৬ ক্যালরি থাকে। রান্নার পর বিভিন্ন তেল, মসলার ব্যাবহারের কারণে আরও কিছু ক্যালরি যুক্ত হবে। সে হিসেবে ২ ক্যাফেটারিয়ায় একজন শিক্ষার্থী এক বেলা খাবারে মাত্র ২২ গ্রাম মাংস পায়। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর দিনে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার কিলো ক্যালরি গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু কেউ যদি ২ বেলা খাবার এই ক্যাফেটেরিয়ায় গ্রহণ করে সেখানে ক্যালরির বড় একটা ঘাটতি রয়ে যায়। 


টিএসসি-ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় ২০ টাকার খাবার

খাবারের মেন্যু পরিবর্তনে অনীহা প্রশাসনের
ক্যাফেটারিয়ার খাবারের ধরণ নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিস্তর অভিযোগ থাকলেও খাবার পরিবর্তনে অনীহা রয়েছে প্রশাসনের। ক্যাফেটারিয়ার কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯০ সালের আগে ক্যাফেটারিয়াগুলোতে খাসির মাংস দিয়ে দুপুর এবং রাতের খাবার দেওয়া হতো। কিন্তু ১৯৯০ সালের পরে মুরগি শুরু হয়। ৩৩ বছর ধরে মুরগি চললেও পরিবর্তন হয়নি এই মেন্যু। ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে খাবারের পরিবর্তন বিষয়ে এজেন্ডা থাকলেও সে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারেনি ডাকসুর নেতারা।  
    
জানতে চাইলে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (ভারপ্রাপ্ত) পরিচালক খোরশেদ আলম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, খাবারের পরিবর্তন আমরাও চাই। কিন্তু নতুন কোনো কিছু এড করতে হলে খাবারের দাম বেড়ে যাবে। 

টিএসসির ক্যাফেটারিয়া

শুধু মুরগি কেন এ বিষয়ে তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ পরিবর্তন করতে বললে আমরা করব। রান্না খাওয়ার অযোগ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাবুর্চিরা চেষ্টা করে রান্না ভালো করতে।  

আরও পড়ুন: ‘বাজারের আগুনে’ পুড়ছে ঢাবির আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরাও

তিনি আরও বলেন, আমরা দ্রব্যমূল্যের এই উর্ধ্বগতির মধ্যেও চেষ্টা করছি শিক্ষার্থীদের যাতে একটা ভালো মানের খাবার দেওয়া যায়। খাবারে যে যে মসলা দেওয়া দরকার আমরা সব ধরনের মসলা দেই এবং আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যাতে খাবারটা ভালো হয়। আগে যেভাবে রান্না হয়েছে বা আমি আসার আগে যেভাবে রান্না হয়েছে এখন তার থেকে খারাপ এটা বলাই যায় না। 

তিনি আরও জানান, গতকাল ভিসি স্যার পরিদর্শন করেছেন তিনিও দেখেছেন খাবারের অবস্থা। অথরিটি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে যাতে একটা নির্দিষ্ট মান বজায় রেখে শিক্ষার্থীদের খাবার পরিবেশন করা যায়।

টিএসসি-ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় ১০ টাকার চা-চপ-সিঙ্গারা-সমুচা

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সম্প্রতি আমি টিএসসি ক্যাফেটেরিয়া পরিদর্শন করেছি। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির জন্য আসলে খাবারের পরিমাণ কমতে পারে বিষয়টা আমি খেয়াল করেছি। এছাড়া আমি আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করেছি শিক্ষার্থীদের যে পরিমাণ খাবার দেওয়া হয় এবং তার মাঝে ছোট এক টুকরা মাংস খুব খারাপ দেখা যায়। আমি তাদেরকে বলেছি যদি এই পরিমাণ খাবার এবং আরও দুইটা সবজি যুক্ত করা যায় অন্তত একটু হলেও খাবারের মানটা ভালো হয়।

তিনি আরও বলেন, আমি জানি ঘরের খাবারের তুলনায় এই খাবার কিছুই নয়। প্রয়োজনীয় ক্যালরিসমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবার এটা না। এটা সাধারণত একটা ওয়ার্কিং লাঞ্চ। তবে আমি চেষ্টা করছি যে খাবারের গুণগত মান যেন বৃদ্ধি পায়।


সর্বশেষ সংবাদ