শিক্ষার্থী না থাকলেও ঢাবির হলে চলে লাইট-ফ্যান, শ্রেণিকক্ষে এসি
- খালিদ হাসান, ঢাবি
- প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২৩, ১০:২৮ AM , আপডেট: ০৯ জুন ২০২৩, ১০:২৮ AM
সারাদেশে তীব্র লোডশেডিংয়ের মাঝেও স্বাভাবিক পরিস্থিতির মতো বিদ্যুৎ সেবা পাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় গড়ে ৮-১০ ঘণ্টা লোডশেডিং হলে ঢাবিতে এ সময়টা সর্রোচ্চ ৩০ মিনিট। তবে এ সেবার অপব্যবহার হচ্ছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মহল থেকে অভিযোগ উঠে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষ ও আবাসিক হল ঘুরে এমন অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে কর্তৃপক্ষ বলছে, কেউ যেনো অকারণে লাইট-ফ্যান বা এসি চালিয়ে না রাখেন।
সরজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে বিশেষ করে ছেলেদের হলগুলোতে বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে ব্যাপক আকারে। শিক্ষার্থীরা হলে অবস্থান না করলেও ফ্যান বা লাইট বন্ধ করতে অবহেলা করছেন। আর ক্লাসের বিরতিতেও বন্ধ হয় না এসি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ৮ জনের একটি রুমে ৪টি ফ্যান দিনের ২৪ ঘণ্টাই চালু থাকে। রুমে ২-৩ জন অবস্থান করলেও রুমের চার কোনায় চারটি ফ্যান চলছে অনবরত। আবার রুমে দুইটি লাইট থাকলে দিন কিংবা রাত অনবরত জ্বলতে থাকে সেগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক, সূর্য সেন হল, বঙ্গবন্ধু হল, বিজয় একাত্তর হল ও কবি জসীম উদ্দীন হলসহ আরও বেশকিছু হল ঘুরে এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে।
বর্তমানে বিদ্যুৎ সংকটে শহরের মানুষ যেমন ভুগছে; গ্রামের মানুষ এরচেয়ে অনেক বেশি ভুগছে। আমি সবাইকে বলবো, কেউ যেনো অকারণে লাইট ফ্যান বা এসি চালিয়ে না রাখেন।
অবশ্য গেল বছর এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের অপচয়রোধে সতর্ক ও সচেতন হওয়ার শপথ নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে বর্তমান ক্রান্তিলগ্নে বিদ্যুৎ ব্যবহারে তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি সাশ্রয়ী হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, বাসাবাড়িতে এবং সর্বত্র তারা বিদ্যুতের বাতি ও পাখা যেন অপ্রয়োজনে না জ্বলে, তা নিশ্চিত করবেন। তবে এমন শপথ যেন শিক্ষার্থীরা ভুলেই গেছেন!
আরও পড়ুন: মমতাজের ফেসবুক লাইভ, বিদ্যুৎ নিয়ে বক্তব্যের ব্যাখ্যা
অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন বিভাগের ক্লাসরুম ও সেমিনারে দেখা যায়, রুমের লাইট-ফ্যান সবসময়ই চালু রয়েছে। সেমিনারে ২০ জন থাকলেও সকল লাইট ফ্যান চালু থাকে। আবার ২-৩ জন থাকলেও ফ্যান বা লাইট অফ করার কোন খেয়াল থাকে না। অন্যদিকে এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসের বিরতি এক-দুই ঘণ্টা হলেও বন্ধ করা হচ্ছে না ব্যপক বিদ্যুৎ খরুচে এসিগুলো। আবার অনেক সময় দেখা যায়, কয়েকজন শিক্ষার্থী এসি চালু করে বসে থাকে ক্লাসের মধ্যবর্তী সময়ে।
এছাড়া বিদ্যুতের এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসের লাইট চালু হয় বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকেই। ক্যাম্পাসের লাইটগুলো যখন চালু হয় তারও প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর সূর্য অস্ত যায়। এতে দেখা যায় সন্ধ্যা পর্যন্ত লাইট ছাড়াই যথেষ্ট আলো থাকে বাইরে। আবার অনেক লাইট আছে যেগুলো পর্যাপ্ত আলো না দিলেও জ্বলছে সারারাত ধরেই।
এর আগে গত বছরের ২৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য কর্মঘণ্টা এক ঘণ্টা কমানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অফিস আগামীকাল ২০২২ বুধবার হতে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। নামাজ ও দুপুরের খাবারের জন্য দুপুর ১টা থেকে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বিরতি থাকবে। আগের মতো শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি বহাল থাকবে।
এতে আরও বলা হয়, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, ইন্টারনেট, স্বাস্থ্যসেবা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি জরুরি পরিষেবাগুলো নতুন অফিস সময়সূচির আওতা বহির্ভূত থাকবে।
বিদ্যুতের এমন অপচয় মানতে পারছে না সচেতন শিক্ষার্থীরা। ফ্রি বিদ্যুৎসেবা পেয়েই এমন অপচয় কারো গায়ে বাঁধছে না বলে মত তাদের। বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহারে অর্ধেক অপচয় রোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, শুধু কর্মঘণ্টা কমিয়ে নয় বরং বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহারই পারে সবার মাঝে বিদ্যুৎ সেবা পৌঁছে দিতে।
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান রুনা বলেন, ঢাকায় তো আছেই, কিন্তু ঢাকার বাইরে লোডশেডিংয়ের মাত্রা ভয়াবহ। প্রায় সারাদিনই বিদ্যুৎ থাকছে না। আর যখন বিদ্যুতের দেখা মিলছে; তখন ভোল্টেজের অভাব। এমন পরিস্থিতিতে খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। মটর চালু করলে ভোল্টেজের অভাবে ট্যাংকে পানি তুলতে পারছে না।
তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে আমাদের অনেকেই বিদ্যুৎ সংকট যে হচ্ছে সেটা নিয়ে সিরিয়াস হতে পারছি না। নিজেরা এখনও অসচেতন, অনর্থক লাইট অন করে রাখছি। বিশেষত সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোতে। ঢাবিতেও এটা বেশ লক্ষণীয়। হলের শিক্ষার্থীরা লাইট-ফ্যান চালু রেখেই বাইরে চলে যাচ্ছেন। ডিপার্টমেন্টগুলোতেও একই অবস্থা।
বর্তমানে বিদ্যুতের যেই সংকট চলছে; তার উপরে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই সংকট বেড়েছে অনেক বেশি। আমরা যারা শহরে অবস্থান করি, তারা হয়তো বিদ্যুতের অভাবটা খুব বেশি টের পাই না।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান তন্ময় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এটা মূলত হয় মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের চর্চার অভাবে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে দেশের প্রতি, দেশের সম্পদের প্রতি আমাদের দায়িত্বশীলতা বেশি থাকার কথা। সারাদেশে বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই দেশের ভবিষ্যৎ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বর্তমানে এই বিদ্যুতের ক্রান্তিকালে আমরা নিজেরাই বিদ্যুতের অপচয় বেশি করছি।
লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে বিদ্যুতের যেই সংকট চলছে; তার উপরে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই সংকট বেড়েছে অনেক বেশি। আমরা যারা শহরে অবস্থান করি, তারা হয়তো বিদ্যুতের অভাবটা খুব বেশি টের পাই না। কিন্তু গ্রামের অবস্থা খুবই করুণ।
তিনি বলেন, আমি সেদিন আমার গ্রামের বাড়িতে গেলাম ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেখানে বিদ্যুৎ থাকে না বললেই চলে। এক ঘণ্টা থাকলে দুই ঘণ্টা থাকছে না; এমন একটা পরিস্থিতি সেখানে বিরাজমান। আমরা যারা শহরে থাকি তারা যদি বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহার করি, অপচয় রোধ করতে পারি; তাহলে সেটা দশের মঙ্গল হবে; দেশের মঙ্গল হবে।
আরও পড়ুন: কেন লোডশেডিং? কীভাবে পরিত্রাণ মানুষের– বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর স্ট্যাটাস
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বর্তমানে বিদ্যুৎ সংকটে শহরের মানুষ যেমন ভুগছে; গ্রামের মানুষ এরচেয়ে অনেক বেশি ভুগছে। আমি সবাইকে বলবো, কেউ যেনো অকারণে লাইট ফ্যান বা এসি চালিয়ে না রাখেন। কারণ আমার ঘরে দুইটি লাইট বন্ধ থাকলে অন্যের ঘরে দুইটা লাইট জ্বলবে। আমার ঘরের একটি ফ্যান বন্ধ থাকলে আরেকজনের ঘরে একটি ফ্যান চলবে।
তিনি বলেন, তাই আমি সবাইকে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলবো যেনো সবাই বিদ্যুতের অপচয় না করে এর সাশ্রয়ী ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা বিদ্যুতের অপব্যবহার করছেন তাদের সতর্ক করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, আমি খুব দ্রুতই একটি বিজ্ঞপ্তি সকল বিভাগ ও হলে পঠানোর ব্যবস্থা করবো। সেখানে সবাইকে বিদ্যুতের অপচয় না করে এবং সাশ্রয়ী ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারে সতর্ক করা হবে।
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নের মতে দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৭,৩৬১ মেগাওয়াট হলেও চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৬ শত ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। এর মাঝে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার পাশাপাশি উৎপাদন কমে যাবে। ফলে রাজধানী সহ দেশের সব জেলা উপজেলায় নিঃসন্দেহে এর প্রভাব পড়বে এবং এটার প্রভাব ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে প্রতিটি জেলা উপজেলায়।