পোষ্য কোটার ধাক্কায় পাস করেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিবঞ্চিত মেধাবীরা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পোষ্য কোটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পোষ্য কোটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে  © ফাইল ছবি

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বর থাকে ৩০ কিংবা ৪০। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই পরীক্ষা হয় ১০০ নম্বরের। এ নম্বরও তুলতে পারেন না ভর্তিচ্ছুদের একাংশ। তবে এরমধ্যে কিছু শিক্ষার্থী দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ‍সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। তাদের এ সুযোগ করে দিচ্ছে বিতর্কিত ‘পোষ্য’ কোটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও শিক্ষক বা কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিচয়ে ফেল করেও এভাবে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন তারা।

অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আসনে ভর্তির জন্য ৭০ জন পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীর প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে পোষ্য কোটা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সব মহল থেকে। ডিসিদের কাছ থেকেও পোষ্য কোটার বিরোধীতা এসেছে। ইউজিসিও এ কোটার পক্ষে নয়। এরপরও শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করেই অনেকটা ঢাকা ঢোল পিটিয়ে পোষ্য কোটা বহাল রেখেছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকারী অধ্যাপকের ভাই হওয়ায় পোষ্য কোটায় ভর্তির সুযোগ পান এক ছাত্র। অথচ তার চেয়ে অনেক ভালো ফলাফল করেও অনেক শিক্ষার্থীই ভর্তির সুযোগ পাননি।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ২৫ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৭০০ শিক্ষার্থী পোষ্য কোটায় ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন স্বায়ত্তশাসিত চার বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২৭ জন, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫৫ জন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৩ জন শিক্ষার্থীকে পোষ্য কোটায় ভর্তি করা হয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটায় ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬০ জন ছিলেন অকৃতকার্য শিক্ষার্থী। ভর্তি পরীক্ষায় নূন্যতম ৪০ নম্বরও পাননি তারা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পোষ্য কোটায় আসন ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে ন্যূনতম পাস নম্বর কমিয়ে ৩০ করা হয়ে।

কেননা হিসাব অনুযায়ী, এ কোটায় ২০১ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ থাকলেও ন্যূনতম পাশ নম্বর ৪০ থাকায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল মাত্র ৬৭ জন। পরে পাস নম্বর কমানোর ফলে আরও ৬০ জন ভর্তির সুযোগ পায়।

এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে পোষ্য কোটায় পাস নম্বর তুলতে না পারা ৪৬ জনকে এবং ২০২০-২১ শিক্ষবর্ষে ৪০ জনকে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জাবিতে কোটার বিষয়টি বিবেচনা করে পাস নম্বর ৪০ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ৩৩, কৃষি গুচ্ছভুক্ত শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাস নম্বর ৪০ হলেও পোষ্য কোটার ক্ষেত্রে নম্বর ২৫, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিকৃত সর্বনিম্ন নম্বরধারী সাধারণ শিক্ষার্থীর চেয়ে ১০ নম্বর কম পেয়েও ভর্তি হতে পারেন পোষ্য কোটাধারীরা। এছাড়া, গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও কোটার ক্ষেত্রে পাস নম্বর ৩০ থেকে ২৫ করে বিজ্ঞপ্তি প্রদান করেছিল। 

রাবিতে এবারও বিশেষ কোটার জন্য ৫৩৭টি আসন বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার। জানা গেছে, এ বছর রাবিতে কেবল কোটাতেই বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট আসনের ১২ শতাংশ। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৬১টি, শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ১২২, মুক্তিযোদ্ধার পুত্র/কন্যা, নাতি/নাতনিদের জন্য প্রতিটি বিভাগ ও ইন্সটিটিউটের পাঁচ শতাংশ এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পুত্র/কন্যাদের জন্য প্রতি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের আসন সংখ্যার চার শতাংশ এবং বিকেএসপি কোটায় শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিভাগের ১০ শতাংশ।

যদিও রাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেছেন, নির্ধারিত পাস মার্ক ছাড়া এ বছর কেউ ভর্তি হতে পারবে না। গত বছরের তুলনায় এ বছর  পোষ্য কোটা ১ শতাংশ কমানো হয়েছে। গত শিক্ষাবর্ষে কোটায় আসন পূরণ না হওয়ার ভর্তি পরীক্ষা কমিটি ও উপকমিটির বিশেষ সুপারিশে ভর্তি করা হয়েছিল। এবছর সে সুযোগ থাকছে না। পাস করেই ভর্তির সুযোগ অর্জন করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, পোষ্য কোটা বিষয়টি আগে থেকে চলে আসছে। হঠাৎ এটা বাদ দিলে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। শুধু যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটা আছে বিষয়টা কিন্তু এমন না। এখনো অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রতিষ্ঠানে পোষ্য কোটা আছে। কোটামুক্ত কোনো শিক্ষার্থীকে বঞ্চিত করে আমরা কোটায় ভর্তি করাই না। শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী, এ বছর আমরা এক শতাংশ কমিয়ে চার শতাংশ করেছি। ভবিষ্যতে ভর্তি পরীক্ষা উপ-কমিটির সিদ্ধান্তে আরও কমে আসতে পারে।

আরো পড়ুন: রাবিতে এবার বিশেষ কোটায় ভর্তির সুযোগ পাবে ৫৩৭ শিক্ষার্থী

১৯৭৩ সালের নীতিমালায় পোষ্য কোটা বিষয়ে বলা হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, সেভাবে কিছু নেই। আসলে অনেক কিছুই এ নীতিমালায় নেই বা থাকে না। প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অনেক কিছুই পরিবর্তন করতে হয়েছে। যেমন- ভর্তি পরীক্ষায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালাগুলো আস্তে আস্তে সুষ্ঠুভাবে পরিবর্তিত হয়ে শিক্ষার্থীদের চাহিদার দিকে যাক, সে প্রত্যাশা করি।

গত বছরের ন্যায় এবারও অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীদের পোষ্য কোটায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ রাখা হবে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বছর ভর্তি পরীক্ষার উপ-কমিটিতে সদস্য ছিলেন ৩০ জন। সবার মতামতের ভিত্তিতে সেবার পাস মার্ক ৪০ থেকে কমিয়ে ৩০ করা হয়েছিল। তবে এবার পাস না করে এ সুযোগ দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে আমাদের কথা হয়েছে।

অথচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের মতো পরীক্ষায়ও পোষ্য কোটা বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছিল। ঢাকায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন সামনে রেখে ডিসিরা এ সুপারিশ করেছিলেন। জানা গেছে, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে দেশে সরকারি চাকরিতে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগে কোটা বাতিল করে সরকার। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে ৬০ শতাংশ নারী কোটা, ২০ শতাংশ পোষ্য ও ২০ শতাংশ পুরুষ কোটা রয়েছে।

এ বিষয়ে কুড়িগ্রামের ডিসি তার প্রস্তাবে বলেছিলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে পোষ্য কোটা আছে। এতে অধিকতর যোগ্য প্রার্থী থাকলেও দুর্বল প্রার্থী শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পাচ্ছেন। ফলে শিক্ষকতার মান কমছে, একই পরিবারে চাকরিজীবীর সংখ্যা বাড়ছে এবং দরিদ্র ও মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারি নীতি ‘প্রতি পরিবারে চাকরির উদ্দেশ্যও ব্যাহত হচ্ছে।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে পোষ্য কোটায় ভর্তির ফলে শিক্ষার মান নষ্ট হচ্ছে এবং বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া পোষ্য কোটায় ভর্তিতে অনিয়মের অভিযোগও কম নয়। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন বিতর্কিত কর্মকাণ্ড কাম্য নয়।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববদ্যিালয়ের সাবেক কোষাধ্যক্ষ এবং ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. তাহের বলেন, কারা কোটার সুবিধা পাবেন সেটি উল্লেখ করা রয়েছে সংবিধানে। সেখানেতো পোষ্য কোটা নেই। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিসের ভিত্তিতে কোটা রেখেছে? আমার মতে, এ কোটার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং ইউজিসির অপর এক সদস্য অধ্যাপক মো. আলমগীর বলেন, শিক্ষকদের সন্তানদের কোটা কেন লাগবে? তারা কি পিছিয়ে আছেন? নাকি শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনামূল্যে সেবা দিচ্ছেন? বিশ্ববিদ্যালয় সবাইকে সমান সুযোগ-সুবিধা দিতে বাধ্য। কিন্তু এ ধরনের কোটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈষম্য। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে সুপারিশ করেছি, এ কোটা বন্ধ করার জন্য।

উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে মোট ৪৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি কার্যক্রম চলমান রয়েছে।  এদের মধ্যে ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটা রয়েছে। অবশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটা নেই।


সর্বশেষ সংবাদ