শিক্ষক সংকটে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কমছে শিক্ষার গুণগত মান

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

দেশের বৃহত্তম স্বায়ত্তশাসিত বিদ্যাপীঠ হয়েও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আদর্শ অনুপাত নেই। অপরদিকে সৃষ্ট পদের বিপরীতে শূন্য রয়েছে চার শতাধিক পদ। শিক্ষক সংকটের কারণে বিভিন্ন বিভাগে পাঠ্যক্রম যথাযথভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না। ফলে ব্যাহত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার গুণগত মান। এমনকি বিশ্ব প্রতিযোগিতায় এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিভাগে যথেষ্ট শিক্ষক না থাকায় কাঙ্ক্ষিত পড়াশোনা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নির্ধারণ কোর্স-পরীক্ষা এবং ফলাফল যেমন যথা সময়ে হচ্ছে না, তেমনি কার্যকারী কোন পড়াশোনা হচ্ছে না। যা পড়াশোনা গুণগত মানকে সমৃদ্ধ করতে সহায়ক নয়। তাই শিক্ষার্থী অনুপাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে শিক্ষক চান তারা।

বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রম যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে যথেষ্ট শিক্ষকের প্রয়োজন। কিন্তু তা না থাকায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি সম্পর্কে বরাবরই অবহিত করা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় বিভাগেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত সন্তোষজনক নয়। কেননা গুটিকয়েক শিক্ষক দিয়ে চলছে এসব বিভাগ। যারমধ্যে আইন ও ভূমি বিভাগে প্রায় ২৫০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে রয়েছে মাত্র ২ জন শিক্ষক। তারাও আবার পদমর্যাদায় সহযোগী অধ্যাপক। টুরিজম এণ্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর বিপরীতে রয়েছে মাত্র ৫ জন শিক্ষক, মাইক্রোবাইলোজি বিভাগে প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ৩ জন, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগে প্রায় দেড়শো শিক্ষার্থীর বিপরীতে রয়েছে মাত্র ৭ জন শিক্ষক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে মাত্র ৭ জন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় দুইশত জন। এছাড়া অন্যন্য বিভাগেও এই অসামাঞ্জস্যপূর্ণ অনুপাত রয়েছে।

বৈশ্বিক উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের নূন্যতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য থাকবে একজন শিক্ষক। তবে সেই মানদণ্ড ধরে রাখতে পারেনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনসহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে পরেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ১ হাজার ৪৯০ টি সৃজিত শিক্ষক পদের মধ্যে শূন্য পদ রয়েছে ৪৩৫ টি। অপরদিকে বর্তমানে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৮ হাজার তিনশত জন। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১:৩৭। অর্থাৎ প্রতি ১ জন শিক্ষকের বিপরীতে ৩৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। যা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আদর্শ অনুপাতের প্রায় দ্বিগুণ।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতে সবচেয়ে পিছিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সমান সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন ২ হাজার ৪২১ জন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:১৬। অন্যদিকে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:২২। যা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের অর্ধেক। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকটের অন্যতম কারণ শিক্ষামন্ত্রনালয় কর্তৃক সকল নিয়োগে স্থগিতাদেশ। কেননা ২০১৭ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০১৫ সালের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায়য় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। পরিবর্তিত সেই নীতিমালায় আবেদনের যোগ্যতা শিথিলকরণ, স্বজনপ্রীতি, '৭৩-এর এ্যাক্ট লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। যা পরবর্তীতে আন্দোলনে রূপ নেয়। এমনকি উপাচার্যের মেয়াদের শেষ দিনে ১৩৮ জনকে গণ-নিয়োগ দিয়ে যান অধ্যাপক আব্দুস সোবহান। ফলে ২০২০ সালের শেষের দিকে তদন্ত সাপেক্ষে বিতর্কিত এই নিয়োগ বাতিল করার পাশাপাশি তা পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল নিয়োগে স্থগিতাদেশ প্রদান করে শিক্ষা মন্ত্রনালয়। তারপর থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ধরণের নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়নি। তবে সর্বশেষ ৫১৬তম সিন্ডিকেটে বিতর্কিত এই নীতিমালা বাতিল করে নতুন নীতিমালা পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এতে যথাযথ যোগ্য ও মেধাবীকেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের নির্দেশনা দেয়া হয়।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনিস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি এ্যাসুরেন্স সেলের পরিচালক অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র রায় বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিন নিয়োগ কার্যক্রম না হওয়ার ফলে বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষকের সংকট তৈরি হয়েছে। যা অবশ্যই  বিশ্ববিদ্যালয়ের যথাযথ শিক্ষা ও গবেষণা কর্যক্রমকে ব্যাহত করছে। তাই এ সমস্যা সমাধানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতে সামঞ্জস্য রাখা জরুরী। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে নতুন শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। তাছাড়া ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাদের চাহিদা সম্পর্কে প্রশাসনকে অবিহিত করেছে। তাই প্রশাসনের উচিত এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া। যাতে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সমস্যা সমাধান হয়।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল ইসলাম বলেন, বিগত দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্কিত নিয়োগ নীতিমালা এবং এই কেন্দ্রিক বিভিন্ন জটিলতার কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা রয়েছে৷ ফলে বিভিন্ন বিভাগ তাদের চাহিদার কথা জানালেও আমরা সেটা পূরণ করতে পারছিনা। তবে মন্ত্রণালয় নতুন নিয়োগ নীতিমালার যে শর্ত দিয়েছিল, সেটা ইতোমধ্যে আমরা সম্পন্ন করেছি। এমনকি পূর্বের মতো এখনো এই শিক্ষক সংকটের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে অবিহিত করে আসছি। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে এ সংকট কেটে উঠতে সক্ষম হবো। 

উপ-উপাচার্য বলেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের বিষয়টি যথাযথভাবে বিবেচনা করার চেষ্টা করা হবে। এছাড়া নতুন নীতিমালা অনুসারে যোগ্যতমরাই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা-গবেষণার গুণগত মান অধিকতর উন্নত হবে বলে মনে করেন তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ