ভর্তি পরীক্ষা জীবনের অংশ, এটাই জীবন নয়

উম্মে সুমাইয়া বৃষ্টি
উম্মে সুমাইয়া বৃষ্টি  © টিডিসি ফটো

উম্মে সুমাইয়া বৃষ্টি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ২২-২৩ সেশনে ‘এ’ ইউনিটে ৭ম স্থান অর্জনকারী ছাত্রী। ভর্তি প্রস্তুতির সময় দৈনিক ১২ ঘণ্টা পড়া এই ছাত্রী বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির আইন বিভাগে। সম্প্রতি তিনি তার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতির গল্প নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের মুখোমুখি হয়েছেন। কথাগুলো শুনেছেন— আমান উল্যাহ আলভী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার জন্য আপনি কীভাবে পড়েছেন, দৈনন্দিন রুটিন কী ছিল?
উম্মে সুমাইয়া বৃষ্টি: ক্লাসে প্রথম হয়েও যখন নবম শ্রেণিতে মানবিকে পড়ার সিদ্ধান্ত নেই, তখন অনেকেই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। মানবিক পড়ে কী হবে? তুমি এত ভালো ছাত্রী, তুমি পড়বে মানবিক? ইত্যাদি। কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ ছিল অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন আমার বড় ভাইয়ের সুবাদে আইন বিভাগ সম্পর্কে জানতে পারা এবং আইন বিভাগকে নিজের টার্গেট হিসেবে বেছে নেওয়া। এক্ষেত্রে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাবির আইন বিভাগকে প্রাধান্য দিয়ে নিজের প্রস্তুতি গুছিয়েছিলাম। যেহেতু ভর্তি পরীক্ষার সিলেবাসটা অনেক বড়; তাই তিন মাসে এটা শেষ করতে দৈনিক ১২ ঘণ্টা পড়ার সময় নির্ধারণ করেছিলাম। সবসময় চেষ্টা করতাম নির্ধারিত রুটিন অনুসরণ করতে এবং যথাসম্ভব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে। ভোর রাতে উঠতাম ৩/৪ টার মধ্যে। এমন রুটিনে ঘুমটাও কার্যকর হত এবং পড়াটাও গুছিয়ে নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পেতাম। 

ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাওয়ার কোনো সহজ টেকনিক আছে কী?
উম্মে সুমাইয়া বৃষ্টি: আমার মনে হয় না পড়াশোনা থেকে সহজ কোনো টেকনিক আছে! যারা পরিশ্রমী, তারাই সফল হবে। এছাড়া বিশেষ কোনো টেকনিক আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে অনেক সময় ভালোভাবে পড়াশোনা করেও আত্মবিশ্বাসের ভালো করতে পারি না। পরীক্ষার হলে যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে, ভয় কাটিয়ে প্রশ্নের উত্তর করলে ভালো করবে ইনশাআল্লাহ। 

কোচিং কতটা গুরুত্বপূর্ণ? 
উম্মে সুমাইয়া বৃষ্টি: ভর্তি পরীক্ষায় কোচিং একটা প্রভাবক মাত্র। চান্স পাওয়ার হাতিয়ার নয়। একজন শিক্ষার্থীর চান্স পাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তার পরিশ্রম, ধৈর্য ও সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ। কোচিং না করে ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করা সম্ভব। আমি নিজেও কোন কোচিং করিনি। এজন্য আমাদের প্রথমে যেটা প্রয়োজন, তা হলো পরীক্ষার সিলেবাসটা ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করা। সিলেবাসটা বুঝতে পারলে পড়াশোনা অনেকটাই সহজ হয়ে যায় ৷ আর অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের পড়াশোনাকে অনেকটা সহজ করে দিয়েছে। অনেক সমস্যার সমাধান আমরা অনলাইনে পেয়ে যাই। বিশেষ করে ভর্তি পরীক্ষার সময় ফেসবুকের মাধ্যমে অসংখ্য ফ্রি এক্সাম দেওয়ার সুযোগ থাকে; যেটা আমাদের নিজের অবস্থান বুঝতে সহায়তা করে। তাছাড়া অফলাইনে এতটা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ কোচিং না করলেই বরং ঘরে বসে আরও অধিক সময় পড়ার সুযোগ পাওয়া যায়। এতে সময়টাও বেঁচে যায়। 

পাঠ্যবই নাকি গাইডবই কোনটা  বেশি গুরুত্বপূর্ণ? 
উম্মে সুমাইয়া বৃষ্টি: ভর্তি পরীক্ষার জন্য উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নাম্বার আপনার পজিশন অনেক এগিয়ে আবার পিছিয়ে নিতে পারে। এক্ষেত্রে কোনোটাকেই কমবেশি গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগ নেই। এমন হতেই পারে যে, আপনি অবহেলায় যে অংশটা না পড়ে ফেলে গেছেন, ওখান থেকেই ২টা প্রশ্ন চলে আসলো। আর গ্রামারভিত্তিক যে প্রশ্নগুলো হয়, এগুলো টপিক অনুযায়ী শেষ করা এবং পর্যাপ্ত অনুশীলনের জন্য গাইড বইগুলো কার্যকর। শুধু মানসম্মত বই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে একটু সচেতন হতে হবে। 

অনেক শিক্ষার্থীকে একইসঙ্গে একাধিক ইউনিটের প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়। এমন শিক্ষার্থীদের জন্য পরামর্শ কী?
উম্মে সুমাইয়া বৃষ্টি: প্রথমেই ইউনিটভিত্তিক প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে উভয় ইউনিটে যে বিষয় বা টপিকগুলো থেকে প্রশ্ন আসে; সেগুলো আলাদা করে ফেলতে হবে। এরপর একেকটা ইউনিটের জন্য আলাদা করে যে অংশটুকু পড়তে হবে; সেগুলো খুঁজে বের করে লিখে ফেলা। উভয় ইউনিটে আসা টপিকগুলো প্রথমে শেষ করতে হবে। এতে করে একাধিক ইউনিটের জন্য আলাদাভাবে পড়তে হবে না; চাপটাও কমে যাবে এবং দুই ইউনিটের প্রস্তুতি একসাথে হবে। সর্বশেষ আলাদা বিষয়গুলো একে একে শেষ করতে পারলে পুরো বিষয়টি সহজ হয়ে যাবে। 

ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণকালে সাধারণত কী ধরনের ভুল হয়? 
উম্মে সুমাইয়া বৃষ্টি: ধারাবাহিকতা না মেনে পড়াশোনা, অর্থাৎ একদিন অনেক পড়াশোনা করলেন, অন্যদিন পড়লেন-ই না। পর্যাপ্ত পড়াশোনা করেও পিছিয়ে পড়তে পারে, যদি নিয়মিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে। পর্যাপ্ত পরীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে দুর্বলতাগুলো বুঝো যায়। স্বাস্থ্য সচেতন না থেকে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমরা পিছিয়ে পড়তে পারি। এক্ষেত্রে রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে যাওয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাতের অগ্রভাগের ঘুমটা আমাদের শরীর এবং ব্রেইনের জন্য কার্যকর। সুতরাং রাত জেগে পড়ার চেয়ে রাতের শেষ ভাগে উঠে পড়াশোনা করা অধিক কার্যকর। নিয়মিত নামাজ আদায় বা প্রার্থণা না করা আমাদের মানসিক প্রশান্তির ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। নির্ভরযোগ্যতা যাচাই না করে ভুল তথ্য পড়ার বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। অনেক শিক্ষার্থী প্রশ্ন ভালোভাবে না পড়ার কারণে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না। অতিরিক্ত স্নায়ু চাপ থাকায় অনেক সময় ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারে না। 

আপনার সফলতার পেছনের গল্প কী?
উম্মে সুমাইয়া বৃষ্টি: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়  ভর্তি পরীক্ষায় আমার অবস্থান ছিল ৭ম। এই সফলতার পেছনের গল্পটা অসম্ভব সুন্দর। সৃষ্টিকর্তা আমাকে ভাগ্যগুণে এমন একটা ভাই দিয়েছেন; যার সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই আমার পড়াশোনার ব্যাপারে মা এবং ভাইয়ার সাপোর্ট সবচেয়ে বেশি ছিল। প্রতিটা পদক্ষেপে আমাকে বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু পরিবারের চোখে যে স্বপ্ন ছিল; সেটা আমাকে বারবার অনুপ্রাণিত করেছে। আমি তাদের চোখে তাকিয়ে সাহস জুগিয়েছি, সমালোচনা আমাকে থামাতে পারেনি। বারবার উঠে দাঁড়িয়েছি। এমন একটা পরিবার পেয়ে আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ। 

আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া। আমি যখন এসএসসি শেষ করে গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে পা বাড়াই অসংখ্য মানুষ বাধ সেধেছে। মেয়ে মানুষের আবার এতো পড়াশোনা? বাইরে গিয়ে বিপথে যাবে, গ্রামেও তো কলেজ আছে, ইত্যাদি। এসব মন্তব্য একপাশে রেখে পরিবার বিশেষ করে বড় ভাই আমাকে বগুড়ায় ভর্তি করান। তখন থেকেই আমার মাথায় একটা বিষয় ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম, তা হলো ভালো করতে হবে। স্বপ্নের আইন বিভাগে পড়তে হবে। আমি মূলত ১ম বর্ষ থেকেই একাডেমিকের পাশাপাশি ভর্তি পরীক্ষার জার্নি শুরু করেছিলাম। আগে থেকেই টুকটাক পড়া ছিল। যে কারণে কোচিং অনর্থক মনে হয়েছে। 
জানি না ভবিষ্যৎ কি বা কতটা অর্জন করতে পারব? কিন্তু আজ এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমার জীবনের সেরা অর্জন হলো পরীক্ষার ফলাফল পেয়ে পরিবারের উৎফুল্লতা নিজ চোখে দেখা। ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করবো এতটুকু আশা তাদের ছিল, কিন্তু এত ভালো অবস্থান তথা সপ্তম স্থান অর্জনের ব্যাপারটা তাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। সেদিন মাকে কারণ ছাড়াই হাসতে দেখেছি। মায়ের চোখে খুশি দেখেছি। ভাইয়ের উৎফুল্লতা, পরিবারের প্রতিটা সদস্যের গর্বিত হওয়া ভাষায় প্রকাশ না পেলেও দৃষ্টিতে প্রকাশ পেয়েছে। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন কেমন উপভোগ করছেন? 
উম্মে সুমাইয়া বৃষ্টি: খুবই ভালো। বিশেষ করে আমার আইন বিভাগে এসে আমি অনেক বেশি আনন্দিত। এখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছে। তাদের সাথে মিশে আমি অনেক কিছু জানতে পারছি, শিখতে পারছি। 

এমন কোনো গল্প আছে কি অ্যাডমিশন সম্পর্কিত যেটি আপনি বলতে চান? 
উম্মে সুমাইয়া বৃষ্টি: ভর্তি জার্নিটা এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। এই সময়টা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। পরিশ্রম, সফলতা, ধৈর্য, হতাশা শব্দগুলোর সাথে যেন নতুনভাবে নিজেকে পরিচিত করেছি। এই অ্যাডমিশন জার্নি শিখিয়েছে কীভাবে বিনয়ী হতে হয়! এই সময়টা একটা শিক্ষার্থীকে কতটা মানসিক প্রেশারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। একমাত্র এই জার্নিতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরাই জানে। আমি আমার অনেক বন্ধুকে দেখেছি যারা রাত-দিন পরিশ্রম করেও হয়তো সৃষ্টিকর্তার ফয়সালায় কাঙ্ক্ষিত পজিশন পায়নি এবং পরবর্তীতে সমালোচনার শিকার হয়েছে। এটা সবচেয়ে বেদনাদায়ক। পাশাপাশি আশেপাশের মানুষদেরও এই বিষয়টা থাকা দরকার— অ্যাডমিশন জীবনের একটা অংশ, এটাই জীবন নয়। খারাপ-ভালো ফলাফল যাই হোক, আমরা সেটাকে গ্রহণ করব।


সর্বশেষ সংবাদ