টানা ৪ বার ব্যর্থ হয়েও যেভাবে সহকারী জজ হলেন জাবির রুহুল

মো. রুহুল আমিন
মো. রুহুল আমিন  © সংগৃহীত

ছোটবেলা থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার তীব্র ইচ্ছা থাকলেও গণিতে দুর্বলতা ও আর্থিক সমস্যার কারণে ৯ম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগ না নিয়ে মানবিক বিভাগ বেছে নিয়েছিলাম। গণিতের জন্য এসএসসিতে অল্পের জন্য জিপিএ ফাইভ পেলাম না। এইচএসসিতে গণিত না থাকলেও মন্দ ভাগ্যের কারণে প্রাণপ ণ চেষ্টার পরেও জিপিএ ফাইভ মিস হয়ে গেল।

ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও অল্পের জন্য চান্স পেলাম না। কপালে বোধহয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় লেখা ছিল। যে ইউনিটেই পরীক্ষা দিলাম, সে ইউনিটেই চান্স পেলাম। অবশেষে আইন ও বিচার বিভাগে ভর্তি হলাম। আমার গাফিলতি ও অন্য কিছু কারণে এখানেও ভালো সিজিপিএ অর্জন করতে পারলাম না। সেশন জটের কারণে শিক্ষা জীবন শেষ হতে অতিরিক্ত ২ বছর সময় লেগেছিল।

একটা সময় ভেবেছিলাম বিসিএস পরীক্ষা দেব। কিন্তু কিছু কারণে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে শুধু জুডিশিয়ারি, ল অফিসার, বার কাউন্সিল পরীক্ষার দিকে মনোনিবেশ করলাম। মাস্টার্সে পড়া অবস্থায় ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জুডিশিয়ারি পরীক্ষায় প্রিপারেশন ছাড়া নামকাওয়াস্তে অংশগ্রহণ করলাম। ফলাফল প্রিলিতেই ফেল।

তারপর মাস্টার্স শেষে শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে হয়েছিল। সুস্থ হওয়ার পরে ২০১৯ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ত্রয়োদশ জুডিশিয়ারি পরীক্ষায় গ্রামে থেকে কিছুটা প্রিপারেশন নিয়ে অংশগ্রহণ করলাম। প্রিলিতে পাস করলেও গণিত ও আরো কিছু সাবজেক্টে ভাল এক্সাম দিতে পারি নাই বিধায় রিটেনে ফেল করি। এর মধ্যে আবার লক্ষ্মীপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পেয়ে দীর্ঘ সময়ে অসুস্থ ছিলাম। গ্রামে পড়াশোনার ভাল পরিবেশ না থাকায় সুস্থ হওয়ার পর যখন ঢাকায় ফেরার করার চিন্তা করলাম, তখনি করোনা মহামারির ভয়াল থাবায় সব থমকে গেল।

করোনার প্রকোপ কিছুটা কমলে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সম্পূর্ণ বেকার অবস্থায় বিয়ে করলাম। বিয়ের পর সংগত কারণে টেনশন, তীব্র হতাশা ও সীমাহীন অর্থ কষ্টের মধ্যেও আরেকটু ভালোভাবে বার কাউন্সিল, জুডিশিয়ারি ও ল অফিসার পদের প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। একটা সময় আমার বন্ধু আবু বকরের সহায়তায় গ্রাম থেকে আবার ঢাকায় ফিরলাম সস্ত্রীক। চাকরি পরীক্ষার বইপত্রের অপ্রতুলতা ছিল বিধায় ওর সহযোগিতায় কিছু বইপত্রও কেনা হল।

২০২১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেটশিপ এনরোলমেন্ট চূড়ান্ত পরীক্ষা পাসের মাধ্যমে অ্যাডভোকেটশিপ লাইসেন্স অর্জন করলাম। আমার স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে ঢাকা বারে মেম্বারশিপ নিলাম। অত:পর ১৪তম জুডিসিয়ারির রিটেন শেষে নভেম্বর, ২০২০ সাল থেকে রেগুলার্লি ঢাকা জজ কোর্টে প্র‍্যাক্টিস শুরু করলাম। কোর্ট প্র‍্যাক্টিসের প্রথম ৩ মাস অত্যন্ত বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার হয়েছি। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বাধ্য হয়েছি অনেক অনিয়ম, মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে। যেদিন সহ্যের সীমা পার হয়ে গিয়েছিল, সেদিন কোর্টে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। কেউ একজন বলেছিলেন, আমি জীবনে কিছু করতে পারব না, কোথাও ঘুরে দাঁড়াতে পারব না।

প্রায় ১ সপ্তাহ পর নতুন চেম্বারে জয়েন করলাম। সেখানে আমি একজন প্রকৃত জুনিয়র বান্ধব সিনিয়র ও মানবিক মানুষকে পেলাম, নিমিষেই আমার কষ্ট দূর হয়ে গেল। আলহামদুলিল্লাহ, অদ্যাবধি, ইমাম হোসেন মঞ্জু স্যারের সাথেই আছি। প্রথম সাক্ষাতেই স্যার আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি নিশ্চিত না হবে’। স্যার সব সময় আমাকে উৎসাহ দিতেন। বলতেন, তোমার মত লোকের জন্য অ্যাডভোকেটশিপ না, তোমার জুডিশিয়ারিতে যাওয়া উচিত। চেষ্টা করে যাও। মঞ্জু স্যার ছাড়াও চেম্বারের বাসেত স্যার, মামুন ভাই, রাসেল ভাই, গায়েত্রী আপা, মঞ্জু ভাই, সোহাগ ভাই, সাবরিন আপা, মোহন ভাই, ফরহাদ ভাই, শামিম ভাই, সৌরভ সহ চেম্বারে ও কোর্টে যখনি যার সাথে পরিচয় হয়েছে, সবাই আমাকে অনেক উৎসাহ দিতেন।

নিয়মিত কোর্ট প্র‍্যাক্টিসের পাশাপাশি জুডিশিয়ারি ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ল অফিসার বা আইন সংক্রান্ত কয়েকটা সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। কোনোটাতে প্রিলি ফেল, কোনোটাই রিটেন ফেল, কোনোটাতে ভাইভাতে ফেল। সফলতার মুখ আর দেখলাম না। কোনোটাতে এখনো ভাইভা পেন্ডিং, কোনোটাতে রিটেনের রেজাল্ট পেন্ডিং। কোনোটাতে পরীক্ষার ডেট এখনো দেয় নি। সম্প্রতি একটা রেপুটেড প্রাইভেট ব্যাংকের ল অফিসার পদে রিটেনে অনেক ভাল এক্সাম দিয়েছিলাম। ভাইভার জন্য সিলেক্টেড হলেও ইচ্ছা করেই ভাইভা দিই নি।

আরও পড়ুন: জুনিয়র ইন্সট্রাক্টদের মৌখিক পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি কবে— জানাল পিএসসি

চতুর্দশ জুডিশিয়ারি পরীক্ষায় প্রিলি, রিটেন পাস করলেও ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত ভাইভা/ চূড়ান্ত ফলাফলে ফেল। হতাশা আরো গ্রাস করতে লাগল আমাকে। তথাপিও নতুন উদ্যমে চেষ্টা করতে লাগলাম। সকাল থেকে সন্ধ্যা, রাত অবধি কোর্ট প্র‍্যাক্টিস শেষে বাসায় এসে যতটুকু পেরেছি পড়াশোনা করেছি। টার্গেট একটাই, সহকারী জজ/ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হতেই হবে, বয়স যতদিন আছে, পরীক্ষা দিতেই হবে সফল না হওয়া পর্যন্ত। 

পঞ্চদশ জুডিশিয়ারি পরীক্ষায় যথারীতি প্রিলি, রিটেনে পাস করলেও ভাইভায় চূড়ান্ত ফলাফলে ফেল। পূর্বের সময়ের চেয়েও এবার বেশি কষ্ট পেলাম। চোখের সামনে সিনিয়র, জুনিয়র, বন্ধুরা যারা এ লাইনের, প্রায় সবাই জজ হয়ে গেল। আরো হতাশা বেড়ে গেল। পাগলের মত আচরণ করেছি বাসায়। নিজেকে কোনোভাবেই শান্ত রাখতে পারছিলাম না। আমার স্ত্রীকে এসব সহ্য করতে হয়েছিল। আমার পাগলামি দেখে ও অনেক কান্নাকাটি করত। আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করত। কিন্তু কোন সান্ত্বনাই আমাকে শান্ত করতে পারে নি। সকল উদ্যম, উৎসাহ, আগ্রহ প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম।

আমার মা, বাবা, স্ত্রী, শ্বশুর বাড়ির লোকজন সহ আমার বিজ্ঞ সিনিয়র, ক্লোজ কিছু মানুষের উৎসাহে কয়েকদিন পর আবারো প্রিপারেশন নিতে শুরু করলাম ষোড়শ জুডিশিয়ারি পরীক্ষার জন্য। টার্গেট করেছিলাম, যেকোনোভাবেই হোক, নাউ অর নেভার। প্রিলির পূর্বে ১ সপ্তাহ ছুটি নিলাম। রিটেনের পূর্বে ২ মাস ছুটি নিয়েছিলাম।

বারবার ভাইভা দিয়েও রেকমেন্ডেড হতে পারছিলাম না। ব্যর্থতার  মূল কারণ খুঁজে বের করলাম। আমার ব্যর্থতার প্রধান কারণ ছিল গণিতে ভাল করতে না পারা। আমি চিন্তা করলাম, যতই আমি গণিতে ভাল করার চেষ্টা করি না কেন, এই বিষয়ে আমি ভাল করতে পারব না। আমার ওয়াইফ অনেক হেল্প করেছে যাতে আমার গণিত ভীতি দূর হয়, প্রস্তুতি ভাল হয়। কিন্তু আমি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম, এই বয়সে এসে গণিতের ভীতি আমার পক্ষে কাটিয়ে তোলা সম্ভব না। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, গণিতের ৫০ নাম্বারে ভাল করার বৃথা চেষ্টার চেয়েও বাকি ৯৫০ নাম্বারে বিশেষ করে আইনের ৬০০ নাম্বারে আমাকে সর্বোচ্চ ভাল প্রস্তুতি নিতে হবে এবং পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ভাল করতে হবে। এবার সেভাবেই প্রস্তুতি নিলাম। 

রিটেন পরীক্ষা দিতে লাগলাম। যে পরীক্ষা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভয় ছিল, সেই গণিত ও বিজ্ঞান পরীক্ষার আগের রাতে ব্যক্তিগত জীবনে খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত ও দু:দুঃখজনক একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। সারারাত এবং পরের দিন সীমাহীন টেনশন ও মানসিক কষ্ট নিয়ে গণিত ও বিজ্ঞান পরীক্ষায় অ্যাটেন্ড করি। যতই চেষ্টা করলাম, ৫০ নম্বরের মধ্যে গণিতে মাত্র ১০ নাম্বার সঠিকভাবে উত্তর দিতে পেরেছি। বিজ্ঞান খুব বেশি ভাল দিতে পারি নি। গণিত ও বিজ্ঞান মিলিয়ে ৩০ নাম্বার পাব কিনা এটা নিয়ে রিটেনের রেজাল্ট দেয়ার আগ পর্যন্ত টেনশন ছিল। জেনারেলের বাকি পরীক্ষাগুলো ভালোভাবে দিলাম। আইনের ৬০০ মার্কের পরীক্ষাগুলো আলহামদুলিল্লাহ, খুবই ভালোভাবে দিয়েছি। ভেবেছিলাম, যদি গণিত ও বিজ্ঞানে ৩০ পাই, তবে এবার আল্লাহ চাইলে ভালো কিছু হতে পারে। রিটেনে পাস করলাম।

ভাইভার আগে ১ সপ্তাহ ছুটি নিলাম। ভাইভার জন্য আইনের বিষয়গুলো ভালোভাবে রিভাইজ দিলাম। সাধারণ জ্ঞান বিষয়েও ওয়াকিবহাল থাকলাম। সম্ভাব্য সকল বিষয়ের খুঁটিনাটিও আরেকবার রিভাইজ দিলাম। ভাইভা বোর্ডে আমাকে প্রায় ২০ মিনিট রেখেছিল। ভাইভা দিয়ে মোটামুটি সন্তুষ্ট ছিলাম যদিও রেজাল্টের আগ পর্যন্ত সীমাহীন টেনশন ছিল, রাতে ঘুমোতে পারতাম না। আমার স্ত্রী, আমার বিজ্ঞ সিনিয়র সহ কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীরা এবার অনেক বেশি আশাবাদী ছিলেন আমাকে নিয়ে। বারবার শুধু ওনাদের কথাই ভাবতাম যে শেষ পর্যন্ত আমার ও ওনাদের মনের আশা পূরণ করতে পারব কিনা।

অবশেষে ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, রবিবার, বিকেল প্রায় ৫:৩০ এর সময় চূড়ান্ত রেজাল্ট দিল। প্রথমবার রেজাল্ট শিটে নিজের রোল খুঁজে পাই নি, ২য় বার ৪১তম স্থানে আমার রোলটি খুঁজে পেলাম। আমার দীর্ঘ ০৫ বছরের প্রচেষ্টা, ধৈর্য, একাগ্রতা আর কষ্টের ফলাফল স্বরূপে ৫ম বারের প্রচেষ্টায় এবং ৩য় ভাইভায় বহুল আকাঙ্ক্ষিত সফলতার দেখা পেলাম। আনন্দে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। এভাবেই আমার, আমার পরিবার, আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজনের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হল। আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলাম। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালে ১২তম তে প্রিলি ফেল, ১৩তম তে রিটেন ফেল, ১৪তম ও ১৫তম তে ভাইভা ফেল, ১৬তম জুডিশিয়ারিতে আলহামদুলিল্লাহ, সহকারী জজ/ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হলাম।


সর্বশেষ সংবাদ