সেক্রেটারি হওয়ার পর বদলে গেল সৈকতের লাইফ স্টাইল

*গণরুমবিরোধী সেই সৈকতই এখন গণরুম নিয়ন্ত্রণে! *হলের ৬টি গণরুমে শতাধিক শিক্ষার্থী তার অনুসারীদের দখলে *বহিরাগত নিয়ে থাকেন হলের তিনটি রুমে *চালকসহ রয়েছে ব্যক্তিগত প্রাইভেট কার

নিজের সিট ছেড়ে গণরুমে উঠার ছবি (উপরে বামে), সৈকতের ব্যক্তিগত কার গাড়ি (ডানে নিচে)
নিজের সিট ছেড়ে গণরুমে উঠার ছবি (উপরে বামে), সৈকতের ব্যক্তিগত কার গাড়ি (ডানে নিচে)  © টিডিসি ফটো

২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আবাসিক হলে গণরুমের বিরোধিতা করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে নেমেছিলেন বর্তমানে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা তানভীর হাসান সৈকত। এই দাবি আদায়ে কিছুদিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কবি জসীম উদ্‌দীন হলের গণরুমে অবস্থানও করেছিলেন তিনি। কিন্তু ২০২২ সালে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর পাল্টে গেছে সৈকতে আগের সেই অবস্থান।

বর্তমানে ওই হলের তিনটি রুম একাই সৈকতের দখলে রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়াও হলটির ৬টি গণরুমে শতাধিক শিক্ষার্থীকে গাদাগাদি করে রাখার অভিযোগ রয়েছে এক সময়ের গণরুমবিরোধী এই নেতার অনুসারীদের বিরুদ্ধে। এসব গণরুম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সৈকত হলটি আধিপত্য ধরে রেখেছেন বলে জানায় হল শাখা ছাত্রলীগের একটি অংশ।

আরও পড়ুন: ১২৮ গণরুমে আড়াই হাজার শিক্ষার্থী, কারাবন্দিদের অর্ধেক জায়গাও বরাদ্দ নেই যাদের ভাগ্যে

শুধু তাই নয়, ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর লাইফ স্টাইলও পাল্টে গেছে সৈকতের। ২০১৩-১৪ সেশনের থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের এই শিক্ষার্থী শুরু থেকে ছাত্রলীগে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেন হল, বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদে, ছিলেন ছাত্রলীগের প্যানেলের ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের নির্বাচিত সদস্যও।

May be an image of 2 people, motorcycle, scooter, road and street

সেক্রেটারি হওয়ার আগে সৈকতকে ক্যাম্পাসে বাইক নিয়ে প্রায় চলাফেরা করতে দেখা যেত (ফাইল ফটো)

এসব দায়িত্ব পালনকালে সৈকতের লাইফ স্টাইল ছিল অন্য আট-দশ জন রাজনীতি করা শিক্ষার্থীর মতো। সেসময় ক্যাম্পাসে একটি বাইক নিয়ে প্রায় চলাফেরা করতে দেখা যেত তাকে। তবে ঢাবির শীর্ষ নেতা হওয়ার পর এখন তার রয়েছে ব্যক্তিগত প্রাইভেট কার ও গাড়ি চালক। আর সিঙ্গেল রুমে ৪ জন নিয়ে কবি জসীম উদ্‌দীন হলের ৩১৯নং রুমে থাকা সেই সৈকত এখন এক রুমে একাই থাকেন। আরও দুটি রুম রয়েছে তার দখলে। অথচ প্রচণ্ড আবাসিক সংকটের জেরে ওই হলে প্রধান ফটকে তালা দিয়ে সম্প্রতি আন্দোলনে নামেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ডাকসু সদস্য তানভীর হাসান সৈকত গণরুমে থাকা শিক্ষার্থীদের কষ্টের ভাগিদার হতে গণরুমে গিয়ে ওঠেন। হলে নিজের সিট থাকা সত্ত্বেও দায়বদ্ধতা থেকে তিনি গণরুমে থেকেছেন বলে তিনি সময় জানিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের গণরুম সংকটের প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে নিজের সিট ছেড়ে তিনি কবি জসীম উদ্‌দীন হলের গণরুমখ্যাত ২০৮ কক্ষে ওঠেন।

২০২০ সালে করোনায় মানুষের পাশে থেকে জাতিসংঘের ‘বাস্তব জীবনের নায়ক’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া সৈকত পরবর্তীতে ছাত্রলীগের ঢাবি শাখার সেক্রেটারি হওয়ার পর পাল্টে গেছে তার আগের সেই অবস্থান। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে বহিরাগত তার একাধিক অনুসারী নিয়ে হলে অবস্থান করেন সৈকত। এমনকি সৈকতের ব্যক্তিগত ড্রাইভারকে রেখেছেন হলের তার পাশের রুমে। অথচ সৈকতের রুমের উত্তর ব্লকের গণরুমগুলোতে তারই গ্রুপের শিক্ষার্থীরা গাদাগাদি করে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

May be an image of 1 person, hospital, road, grass and tree

ঢাবির কবি জসীম উদ্‌দীন হল (ফাইল ফটো)

হল সূত্রে জানা যায়, কবি জসীম উদ্‌দীন হলের ৩১৯নং ডাবল সিটের রুমে সৈকত একাই থাকেন। একই আকৃতির রুমে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ৪ জন থাকেন। আর গণরুমগুলোতে ১৫-২০ জন করে শিক্ষার্থী থাকেন।

৩২০নং রুমে থাকেন তার গাড়ির ড্রাইভার শরীফ হোসেন ও ঢাবি ছাত্রলীগের দুই নেতা আখতারুজ্জামান রাজীব ও শুভ আলম। গাড়ির ড্রাইভার শরীফ হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়। বহিরাগত হওয়া সত্ত্বেও তিনি জসীম উদ্‌দীন হলে শিক্ষার্থীদের বরাদ্দ সিটে নিয়মিত অবস্থান করছেন। 

সৈকতের অনুসারী ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী ইমাম হোসনের ছাত্রত্ব শেষ ২০১৯ সালে। ৫ বছর আগে ছাত্রত্ব শেষ হলেও  ৩২১নং রুমে একাই থাকেন এই ছাত্রলীগ নেতা। 

৩১৮নং রুমে থাকেন সৈকতের বন্ধু কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক মাহিদুল ইসলাম খন্দকার। তিনি হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ থেকে অনার্স সম্পন্ন করেছে। এছাড়াও একই রুমে থাকেন সৈকতের বন্ধু বহিরাগত হিমেল হোসেন। তিনি জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বলে জানা যায়। 

May be an image of 3 people and text

২০১৯ সালে নিজের সিট ছেড়ে গণরুমে উঠেছিলেন সৈকত (ফাইল ফটো)

অভিযোগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক মাহিদুল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়। মাস্টার্সে গভর্নেন্স স্টাডিজ বিভাগে সন্ধ্যাকালীন কোর্সে ভর্তি হয়েছি। আমার বরাদ্দকৃত হল সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। আমি হলে থাকি না। আমার পরিবারসহ আমি বাইরে থাকি।

তার দাবি, কবি জসীম উদ্‌দীন হলের থাকার কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মনুসারে সন্ধ্যাকালীন কোর্সে শিক্ষার্থীদের হলে সিট বরাদ্দ দেওয়া হয় না। 

হল ছাত্রলীগের একাংশের অভিযোগ, প্রতিটি রুমে ৪ জন করে থাকার কথা থাকলেও সৈকত ও তার অনুসারীদের বেলায় ভিন্ন নিয়ম। এখানেই শেষ নয়, সৈকতের নেতৃত্বে তার অনুসারীরা পরিচালনা করেন এ হলের ৮টি গণরুমের মধ্যে ৬টি। রুমগুলো হলো ২১২, ২১৫, ২২৮, ২৩০, ৩৩০ এবং ৫৩১নং। প্রতি রুমে ১৫-১৮ জন শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে থাকে। প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী এখানে মানবেতর জীবন যাপন করে।

বাকি ২টি গণরুম কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দামের অনুসারীরা পরিচালনা করে। শেখ ওয়ালি আসিফ ইনানের ১ম বর্ষের কর্মী সংখ্যা কম থাকায় তারা সৈকতের অনুসারীদের রুমে থাকে।

আরও পড়ুন: ঢাবির ১৫০ গণরুমের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছাত্রলীগের

ঢাবির হলগুলোতে ছাত্রলীগের চারটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এই চারটি গ্রুপ পরিচালনা করেন যথাক্রমে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান, ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন এবং সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত। কিন্তু কবি জসীম উদ্‌দীন হলের তিনটি গ্রুপ রয়েছে। এ হলে ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতি মাজহারুল কবির শয়নের ক্যান্ডিডেট থাকলেও নেই কোনো গ্রুপ। 

মাজহারুল কবির শয়নের এক অনুসারীর ভাষ্যমতে, তানভীর হাসান সৈকত নিজের হলে প্রভাব বিস্তার করতে ইচ্ছাকৃতভাবে মাজহারুল কবির শয়নের গ্রুপকে সংগঠিত হয়ে দেয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগ নেতা বলেন, শয়নের অনুসারী হওয়ায় বিভিন্ন সময় হলের প্রোগ্রামে তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। সৈকতের অনুসারী কর্তৃক খারাপ ব্যবহারের শিকার হয়েছেন।

May be an image of ‎sedan, wheel and ‎text that says '‎ישר ঢাকামেট্রো-গ ঢাকা মেট্রো- গ ና‎'‎‎

সৈকতের টয়েটো এক্সিও ২০১৬ মডেলের ব্যক্তিগত গাড়িটি (সংগৃহীত)

কবি জসীম উদ্‌দীন হলে চতুর্থ বর্ষের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, একসময় গণরুমের বিরোধিতা করা সৈকত ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসার পর পরিবর্তন হয়ে গেছে। তারই গ্রুপের শিক্ষার্থীরা এখন গণরুমে গাদাগাদি করে থাকে। প্রত্যেক গণরুমে প্রায় ১৫-২০ জন করে থাকে।

এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, সৈকত নিজেই তার কাছের মানুষদের নিয়ে বিলাসবহুলভাবে রুমে থাকে। কবি জসীম উদ্‌দীন হলে তার একক আধিপত্য বিরাজমান।

ব্যক্তিগত গাড়ি
নেতা হওয়ার পূর্বে ক্যাম্পাসে একটি বাইক নিয়ে চলাফেরা করতে দেখা যেত তানভীর হাসান সৈকতকে। কিন্তু নেতা হওয়ার পর প্রায় সময়ই টয়েটো এক্সিও ২০১৬ মডেল গাড়িতে করে তাকে হলে প্রবেশ এবং বাহির হতে দেখা যায়। মাঝেমাঝেই তিনি সূর্যসেন হল ক্যাফেটেরিয়ার সামনে  গাড়ি থেকে নেমে বাকি পথ হেটে হলে আসেন এবং সেখান থেকে গাড়ি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেন, যাতে গাড়ির বিষয়টি জানাজানি না হয়। এই গাড়ির আনুমানিক দাম ২০ লাখেরও বেশি বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুন: ঢাবির হলে শিক্ষার্থীদের রুমে কর্মচারীদের বসবাসে’র জেরে বিক্ষোভ, প্রধান ফটকে তালা

যদিও তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ক্যাম্পাসে এ গাড়ি নিয়ে আসেন সৈকত। গাড়িটির বিষয়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) যোগাযোগ করা হলে, গাড়ির মালিকানায় তানভীর হাসান সৈকতের নাম পাওয়া যায়। সেখানে গুলশানের একটি বাসার ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। 

May be an image of 3 people and text

২০১৯ সালে গণরুম ছেড়ে ভিসির বাড়ির সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সৈকত (ফাইল ফটো)

যদিও গাড়িটি তার বাবার কেনা দাবি করেছেন সৈকত। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গাড়ি আমি নেতা হওয়ার পরে কিনেছি এমনটা নয়, আমার পারিবারিকভাবে গাড়ি কেনা। নেতা হওয়ার আগে, বিশ্বাস না হলে কত সালে কত তারিখে গাড়ি কেনা রেজিস্ট্রেশন চেক করে দেখতে পারেন। এটা আমার পারিবারিক গাড়ি, আমার বাবা-মা ঢাকাতে আসেন গাড়িতে করে। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

একাধিক রুম দখল করে থাকার বিষয়ে কবি জসীম উদ্‌দীন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহীন খান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার জানামতে কবি জসিমউদদীন হলে কোনো বহিরাগত শিক্ষার্থী থাকে না। এই প্রথম শুনলাম, আমার হলে বহিরাগত ছাত্রলীগ থাকে। আমি খোঁজ-খবর নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

হলের গ্রুপিং প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ছাত্রলীগের রাজনীতি যারা করে সবাই একই আদর্শের রাজনীতি করি। কখনো কখনো দেখা যায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা ধরনের ঘটনা ঘটে, সেগুলো আমরা সাধারণভাবে নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করে দিই। এছাড়া কোনো হলে আমাদের গ্রুপিং ভিত্তিক কোনো বিভেদ নেই।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈকত বলেন, আগে আমি ৩২০নং রুমে থাকতাম, এটা সত্য। কিন্তু এখন আমি ৩১৯নং রুমে থাকি। আমি যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, সেহেতু আমি মনে করি আমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আসবে, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যদি চিন্তা করি, শুধু আমি নয়, সকল রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সাথে শিক্ষার্থীদের কথা বলার সুযোগ তৈরি করে দিতে জায়গা প্রয়োজন।


সর্বশেষ সংবাদ