কুবি ছাত্রলীগ
নেতা হওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে অছাত্র, খুন-ধর্ষণ মামলার আসামিরা
- হাছান আল মাহমুদ, কুবি
- প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২২, ১০:৪৮ AM , আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২২, ০৯:০০ PM
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদের আবেদনে অছাত্র, শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী, খুন-ধর্ষণ মামলার আসামী এবং বয়স উত্তীর্ণরা এগিয়ে রয়েছেন। বর্তমান সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ সমর্থক ও ২০১৭ সালে বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেজা ই এলাহির সমর্থকদের অন্তত অর্ধশত নেতাকর্মীর জীবনবৃত্তান্ত ও তাদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে। এসব নেতাদের সমর্থকদের দাবি, তাদের সমর্থিত প্রার্থীরাই পরবর্তী কমিটির দায়িত্ব পাবেন।
গত সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের ৪১১-নং কক্ষে সভাপতি ইলিয়াস সমর্থিত পদ প্রত্যাশী নেতাকর্মীরা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের কর্মসূচী ও পরিকল্পনা সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন এবং উপ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক ফাহিম ইসলাম লিমনের নিকট জীবনবৃত্তান্ত জমা দেন।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের রেজা ই এলাহি সমর্থিত পদ প্রত্যাশী নেতা-কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে না এসে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানা আওয়ামীলীগের কার্যালয়ে তাদের জীবনবৃত্তান্ত জমা দেন। এবিষয়ে কথা বলতে চাইলে রেজা ই এলাহি জানান, ‘‘যেকোনো ধরনের সহিংসতা কিংবা বিশৃঙ্খলা এড়াতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা এখানে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছি।’’
আরও পড়ুন: কুবিতে তুচ্ছ ঘটনায় ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে হাতাহাতি
দুই গ্রুপের অর্ধশত নেতাকর্মী জীবনবৃত্তান্ত জমা দিলেও অছাত্র ও বিভিন্ন অভিযোগ ও মামলায় দোষী সাব্যস্তরা জীবনবৃত্তান্ত জমা দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংগঠনটির অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা-কর্মীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক তরুণ নেতা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এই ক্যাম্পাসে রাজনীতি করে আসতেছি। এখন যদি যাদের ছাত্রত্ব নেই বা যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে তারা পদ পেয়ে যায় তাহলে আমরা পদবঞ্চিত হবো। তাই আমি কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের বলবো সবকিছু বিবেচনা করে যারা যোগ্য তাদের হাতে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য।
ইলিয়াস সমর্থিত গ্রুপে সিভি জমা দিয়েছেন, কাজী নজরুল ইসলাম হল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ইমরান হোসাইন ও বর্তমান সভাপতি নাজমুল হাসান পলাশ, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাদাৎ মো. সায়েম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রকিবুল হাসান রকি, দত্ত হল ছাত্রলীগের সভাপতি রাফিউল আলম দীপ্তসহ অন্তত ৩০জন।
এছাড়া শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মেহেদী হাসান বিদ্যুৎ শীর্ষ পদে আসার জন্য দৌড়ঝাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। যার মধ্যে ইমরান হোসাইন, মেহেদী হাসান বিদ্যুৎ ও রকিবুল হাসান রকির ছাত্রত্ব নেই।
আরও পড়ুন: কুবি ছাত্রলীগ সভাপতির কাছে নিরুপায় ম্যাজিস্ট্রেট!
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অনূর্ধ্ব-২৭ বছর ( ২০০৬ সাল থেকে শেখ হাসিনার নির্দেশে অনুর্ধ্ব ২৯ নির্ধারিত) বয়সী বাংলাদেশের যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র বা ছাত্রী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রাথমিক সদস্য হতে পারেন। তবে সদস্যপদ ঠিক রাখার মূল শর্ত হলো শিক্ষা জীবন অব্যাহত থাকা। কিন্তু কুবি ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে অনেকেরই ছাত্রত্ব নেই এবং বয়স উত্তীর্ণ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদ্যুৎ পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক ২০১১-১২ সেশনের শিক্ষার্থী। শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ অনুযায়ী তার বয়স ৩১ বছর চলমান। তিনি ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সদস্য নয়।
আরও পড়ুন: প্রতিপক্ষের ব্যানার নিয়ে গেল কুবি ছাত্রলীগ
এছাড়াও ২০১৯ সালে ১০ এপ্রিল রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁঠাল তলায় প্রত্নতত্ব বিভাগের ১১তম ব্যাচের এক ছাত্রীকে হেনস্তা করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ইমরান হোসাইন বাংলা বিভাগের স্নাতক ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী। বর্তমানে তারও ছাত্রত্ব নেই। রকি মার্কেটিং বিভাগের স্নাতক ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী। এদের সবারই স্নাতকোত্তরের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে এবং কেউই নিয়মিত ছাত্র নয়।
অন্যদিকে রেজা সমর্থিত গ্রুপের রেজা ই এলাহি, শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্বজন বরণ বিশ্বাস, ফিন্যান্স ৯ম ব্যাচের শিক্ষার্থী ইকবাল হোসাইন খান, গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক মোবারক হোসেন মাহী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের যুগ্ম সম্পাদক মুমিন শুভসহ জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন অন্তত ২০ জন।
রেজা ই এলাহি ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে লোকপ্রশাসন বিভাগে ভর্তি হয়ে ২০১৬ সালে স্নাতক পাশ করে বেরিয়ে যান। শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ অনুযায়ী তাঁর বয়স বর্তমানে ৩০ বছর। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ৮ মার্চ বরুড়ার তালুকপাড়া গ্রামের ফাতেমা বেগম (৩১) নামের এক নারীকে ধর্ষণ চেষ্টা, ভাঙচুর, জালিয়াতি ও লুটতরাজের একটি মামলা কুমিল্লার বিজ্ঞ নারী ও শিশু দমন বিশেষ ট্রাইবুনাল-০২ এ ছিল যা পরবর্তীতে বাদী মিমাংসা করে নেয়। যেখানে তিনি ১ নম্বর আসামী ছিলেন।
আরও পড়ুন: কুবিতে মধ্যরাতে দুই হলের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ
এছাড়া তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও কাজী নজরুল ইসলাম হলের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ সাইফুল্লাহ হত্যার এজাহারভুক্ত আসামী।
স্বজন নৃবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক ২০১২-১৩ সেশনের শিক্ষার্থী। তিনিও খালেদ সাইফুল্লাহ হত্যার ২ নম্বর চার্জশীটভুক্ত আসামি। এই মামলায় ৫৫ দিন জেল খেটেছেন তিনি। এছাড়া তার বিরুদ্ধে মাদকসেবন ও চুরিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও ২০১৮ সালের ১ মার্চ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের এক জরুরি সিদ্ধান্ত মোতাবেক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কারও করা হয়। পরে আবার তা প্রত্যাহার করা হয়।
ইকবাল ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের স্নাতক ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী। তিনি শাখা ছাত্রলীগের কোন পর্যায়ের কর্মী বা সমর্থক ছিলেন না এবং কোনো ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রমে সংযুক্ত ছিলেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও তার বাসা শিবিরের রাজনীতির কেন্দ্রস্থল ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও গত ১ অক্টোবর তার নেতৃত্বে ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের মোটরবাইক শোডাউন ও বঙ্গবন্ধু হলে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
আরও পড়ুন: হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা চাকরি পাচ্ছে কুবিতে
মমিন শুভর ছাত্রত্ব থাকলেও তাকে সংগঠনের নীতি-আদর্শ পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ২৬ মার্চ ২০২০ সালে সংশ্লিষ্ট পদ থেকে অব্যহতি দেয় শাখা ছাত্রলীগ।
রেজা ই এলাহি বলেন, ‘আমার ছাত্রত্ব নেই তোমাকে কে বলছে। আমার ছাত্রত্বের ডকুমেন্ট আছে। আমি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের স্টুডেন্ট।’ এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শেখ মকছেদুর রহমান বলেন, ‘বিভাগের সান্ধ্যকালীন একটা কোর্সে তার (রেজা) ভর্তি আছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ নেওয়ার জন্য তিনি ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগে ছাত্রত্ব নিয়েছেন।
সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন, অছাত্র, মাদকের সাথে সম্পৃক্ত ও ফৌজদারি মামলার আসামি কাউকে যেন কমিটিতে আনা না হয় সে ব্যাপারে আমরা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বলেছি এবং সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের নিকটও আমরা বিষয়টি পেশ করেছি। বাকিটা ওনারা বিবেচনা করে দেখবে।
আরও পড়ুন: ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তি নিয়ে উত্তপ্ত কুবি ক্যাম্পাস
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে একাধিক মুঠোফোনে কল দেওয়া হলেও পাওয়া যায়নি।
কুবি শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে পদ প্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত নিতে আসা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের কর্মসূচী ও পরিকল্পনা সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘‘কমিটি কবে হবে এটা আমি বলতে পারবো না এটা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক যাচাই বাছাই করে দেখবে। গঠনতন্ত্র পরিপন্থী কাউকে নেতা বানাবে না এটা হচ্ছে মূল কথা। ছাত্রলীগ সব সময় গঠনতন্ত্র মেনে চলে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘ছাত্রলীগ ছাত্রদের সংগঠন সেক্ষেত্রে ছাত্রত্ব থাকতে হবে বয়সও যা নির্ধারণ করা আছে সেটার মধ্য থেকে কোন অছাত্র, মাদকাসক্তকে নেতৃত্বে আনার সুযোগ নেই। এটা আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন। ছাত্রত্বের সনদ ছাড়া সিভি এলাউ না। কেউ যদি এমন করে থাকে তাহলে তার সিভি বাতিল হয়ে যাবে। মোটকথা হচ্ছে গঠনতন্ত্রে যে শর্ত আছে সেগুলো মেনে নেতৃত্বে আসা লাগবে।’’