শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার ঘাটতিতেই শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে স্বল্পতা

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক  © ফাইল ছবি

মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তাদের মধ্যে ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে দুর্বলতা সবচেয়ে বেশি। এর প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা কঠিন বলে মত সংশ্লিষ্টদের। তবে পরিসংখ্যান বলছে, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের শিক্ষকদের একটি বড় অংশের নিজ নিজ বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেই। তাই শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা ঘাটতিতেই কী শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে স্বল্পতা দেখা যাচ্ছে, সে প্রশ্ন সামনে আসছে।

দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো থেকে সংগ্রহ করা তথ্য নিয়ে গত ২৮ আগস্ট ‘শিক্ষা পরিসংখ্যান’ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ শিক্ষা-তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)। এতে উঠে এসেছে, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি ও গণিত শিক্ষকদের প্রায় ৮৫ শতাংশেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেই। 

বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার ঘাটতি এখন শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রি না থাকা এ সমস্যা আরও প্রকট করছে। এ বিষয়ে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। অন্যথায় এখনকার শিক্ষার্থীরা শিখন ঘাটতি নিয়ে ভবিষ্যতে আরও সমস্যায় পড়বে।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি ও গণিত শিক্ষকদের প্রায় ৮৫ শতাংশেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেই। মাধ্যমিক পর্যায়ের ইংরেজি শিক্ষকদের একটি বড় অংশের ইংরেজিতে উচ্চশিক্ষাই নেই। ইংরেজি শিক্ষকদের ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ ইংরেজি বিষয় ছাড়াই স্নাতকের গণ্ডি পেরিয়েছেন। আর ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ ইংরেজি শিক্ষকের উচ্চশিক্ষাই নেই, তারা উচ্চমাধ্যমিক পাস।

ব্যানবেইসের তথ্য বলছে, দেশে মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় ইংরেজি শিক্ষকের সংখ্যা ৬০ হাজার ৮৫৭ জন। তাদের মধ্যে ইংরেজিতে স্নাতক (অনার্স) ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যা চার হাজার ১৫৮। অর্থাৎ মোট শিক্ষকের ৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ ইংরেজিতে স্নাতক (অনার্স) ডিগ্রিধারী। আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যা ৫ হাজার ২১৮, যা মোট শিক্ষকের ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

সে অনুযায়ী, ইংরেজির শিক্ষকদের ৯ হাজার ৩৭৬ জন বা ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ বিষয়টিতে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। আর ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর নেই ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশের।

মাধ্যমিক পর্যায়ের ইংরেজি শিক্ষকদের একটি বড় অংশের ইংরেজিতে উচ্চশিক্ষাই নেই। ইংরেজি শিক্ষকদের ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ ইংরেজি বিষয় ছাড়াই স্নাতকের গণ্ডি পেরিয়েছেন। আর ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ ইংরেজি শিক্ষকের উচ্চশিক্ষাই নেই, তারা উচ্চমাধ্যমিক পাস।

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় গণিত শিক্ষকের সংখ্যা ৬৪ হাজার ১৪৭ জন। তাদের মধ্যে গণিতে স্নাতক (অনার্স) ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যা ৩ হাজার ৮৩৬। অর্থাৎ মোট শিক্ষকের ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ গণিতে স্নাতক (অনার্স) ডিগ্রিধারী। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আছেন ৪ হাজার ৬৪৩ জন, যা মোট শিক্ষকের ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। 

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গণিতের শিক্ষকদের মধ্যে বিষয়টিতে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আছেন মাত্র ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থাৎ গণিতে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ছাড়াই শিক্ষার্থীদের বিষয়টি শেখাচ্ছেন ৮৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ শিক্ষক। গণিত শিক্ষকদের অর্ধেকের বেশির গণিত বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নেই। তাদের ১২ দশমিক ৩৯ শতাংশের উচ্চমাধ্যমিকে গণিত বিষয় থাকলেও স্নাতক পর্যায়ের গণিত পরেননি। 

১৬ দশমিক ৯ শতাংশের ডিগ্রি পর্যায়ে গণিত ছিল না। ১১ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ শিক্ষক গণিত বিষয়সহ উচ্চমাধ্যমিক পাস করে শিক্ষকতা করছেন। আর  ১১ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ গণিত বিষয় ছাড়াই উচ্চমাধ্যমিক পাস করে শিক্ষকতায় আছেন। ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ শিক্ষকের ডিগ্রি বা এইচএসসি পর্যায়ে ডিগ্রি বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে গণিত পড়েননি।

গত বছর একটি গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ ইংরেজি ও গণিতে দক্ষ নয়। শিখন দক্ষতা মূল্যায়নের জন্য এ দুই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি এবং গণিত বিষয়ে ৯০ মিনিটের পরীক্ষা নিয়েছিল গণসাক্ষরতা অভিযান। পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি অষ্টম শ্রেণির ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ। নবম শ্রেণিতে ফেলের হার ২৬ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী। পরে এ নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। 

এর আগের বছর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গণিত ও ইংরেজিতে দুর্বলতার চিত্র। প্রতিবেদনে জানানো হয়, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে অবস্থা খারাপ। এর মধ্যে ২৯ শতাংশের অবস্থা খুবই খারাপ এবং ৩২ শতাংশের অবস্থা খারাপ বা গড়পড়তা। আর একই শ্রেণিতে গণিতে ৪৩ শতাংশের অবস্থা খারাপ বা গড়পড়তা। 

এর মধ্যে ১৩ শতাংশের অবস্থা খুবই খারাপ। ইংরেজিতে অষ্টম শ্রেণির ২২ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর খারাপ। আর ২ দশমিক ৪ শতাংশের অবস্থা খুব খারাপ। অপরদিকে ষষ্ঠ শ্রেণির প্রায় ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে খারাপ অবস্থায় আছে। এর মধ্যে ১৩ শতাংশের অবস্থা খুবই খারাপ। আর অষ্টম শ্রেণির ২২ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থীর গণিতে খারাপ অবস্থায় আছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অভিভাবক বলেন, ‘আমার ছোট ভাইয়ের ক্লাসে রোল ১ হলেও ইংরেজি তার দক্ষতার ঘাটতি অনেক। অংকেও অনেক কিছু বুঝতে পারে না। সেক্ষেত্রে অন্য শিক্ষার্থীদের অবস্থা কেমন, সেটি সহজেই অনুমেয়। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নিতে হবে। নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রেও যোগ্যতা ভালোভাবে পরখ করে নেওয়া দরকার।’

একাধিক অভিভাবক বলছেন, কোনও এলাকায় নতুন কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলে টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগের নজির রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দক্ষতা বা ডিগ্রির বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় না। এমন অদক্ষ শিক্ষক যখন দীর্ঘদিন পাঠদান করেন, তখন শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি থাকবেই। এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসা দরকার। সরকারি নিয়ম-নীতি মেনে নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

আরো পড়ুন: ৮৫ শতাংশ ভিন্ন বিষয়ে ডিগ্রিধারীরা শেখাচ্ছেন ইংরেজি-গণিত  

শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা ঘাটতিতে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে স্বল্পতা দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল হালিম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বাস্তব চিত্র যদি এমনটা হয়, তাহলে খুব বিপদের কথা। কোনো শিক্ষক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে শিক্ষকতায় আসলে তাঁর পড়ানোর পদ্ধতি এক রকম হবে। আর কোন শিক্ষক বিষয়টি না পড়ে শিক্ষকতায় আসলে তার শিখন বা শেখানোর পদ্ধতি আরেক রকম হবে। 

তিনি আরও বলেন, আসলে আমরা যদি নৌকা চালাতেই না জানি, শুধু নৌকায় চড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে কাউকে নৌকা চালানো শেখাতে যাই, তবে সে বাতাসের তোড়ে একবার এদিক তো পরের বার অন্যদিকে যেতে থাকে, এটাই বাস্তবতা। আগামী প্রজন্মের কথা চিন্ত করে গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন খুব জরুরি।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence