রাবির যাত্রাকালে ছিল না বাংলা বিভাগ, কারণ কী?

বাংলা বিভাগ ও রাবি লোগো
বাংলা বিভাগ ও রাবি লোগো  © ফাইল ছবি

১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ৬ জুলাই থেকে দর্শন ও আইন বিভাগ দিয়ে অনুষ্ঠানিক পঠন-পাঠন শুরু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৫৪ সালে ইংরেজি ও ১৯৫৫ সালে বাংলা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য গড়া সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে  সেই বাংলাকেই কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রাকালে প্রাধান্য দেয়া হলো না, এমন প্রশ্ন অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর। এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনো অধরাই থেকে গেছে!

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে দর্শন ও আইন বিভাগ পঠন-পাঠন কার্যক্রম শুরু করে। তারপর ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইতিহাস, ইংরেজি, অর্থনীতি ও গণিত বিভাগ। পরের বছর ১৯৫৫ সালে এসে বাংলা বিভাগ চালু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। তারপর থেকে বিভিন্ন বছরে চালু হওয়া মোট ৫৯টা বিভাগ রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সর্বশেষ ২০২০ সালে এসে জীববিজ্ঞান অনুষদভুক্ত মাইক্রোবায়োলোজি বিভাগ চালু হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ঘেটে দেখা গেছে, ব্রিটিশ যুগে ১৮৭৩ সালে রাজশাহী অঞ্চলের শিক্ষা-দীক্ষা উন্নয়নে রাজশাহী কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু যথাযথ মান উন্নয়ন না হওয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য এ অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজন অনুভূত হয়। পরবর্তীতে স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে আন্দোলন শুরু হয়। 

১৯৫০ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ৬৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক আন্দোলন সংগ্রাম হয়। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাস হয়। সেই বছরের ৬ জুলাই অধ্যাপক ইতরাত হোসেন জুবেরীকে উপাচার্য নিয়োগের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন: শিক্ষকদের ওপর হামলা মানে শিক্ষার ওপর হামলা: ইউনিসেফ

এবিষয়ে জানতে চাইলে ইতিহাস বিভাগের জেষ্ঠ্য অধ্যাপক মর্তুজা খালেদ বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই হিন্দু-মুসলিম, উর্দু-বাংলা ভাষা এসব নিয়ে ভারত পাকিস্তান ও বাঙালির মধ্যে বিভিন্ন বিতর্ক ছিল। ফলে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করা, নজরুল সংগীতকে বিকৃত করা, আরবী হরফে বাংলা লেখা ইত্যাদি বিষয় তুলে বিতর্ক সৃষ্টি করার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। 

এ ইতিহাসবিদ বলেন, পাকিস্তান সরকার বুঝতে পেরেছিল ভাষা নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে এক ধরণের জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হতে পারে। তাই বিভিন্ন অকৌশলে বাংলা ভাষাভাষীদের কথা বলার অধিকার হরণ করত তারা। তাছাড়া যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন বাঙালি জাতি মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার নিয়ে বেশ সচেতন হয়ে উঠে। এমনকি ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য বাঙালি জীবন বিসর্জন দেয়। ফলে এমন উচ্চতর বিদ্যাপীঠে বাংলা বিভাগ চালু করে নিজেদের অকৌশল প্রতিষ্ঠার পথে বাঁধা সৃষ্টি হোক, সেটা হয়তো পাকিস্তান সরকার চায়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রাকালে বাংলা বিভাগ চালু হয়নি বলে মনে করেন এ অধ্যাপক।

এবিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রবীন অধ্যাপক জুলফিকার মতিন পাকিস্তান সরকারের হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন। সাবেক এ অধ্যাপকের মতে, তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলে বহু আন্দোলন সংগ্রামের পর প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে উত্তরবঙ্গসহ উচ্চ শিক্ষার পথ সহজ হয় বাঙালি জাতির। কিন্তু পাক-সরকার তো কোনক্রমেই বাংলা ভাষার পক্ষ-পাতি নয়। কেননা তার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ ভাষা আন্দোলন বাঙালি জীবন উৎসর্গের ইতিহাস। তাই বিভিন্ন অপকৌশলগতভাবে তারা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা প্রতিষ্ঠায় বিলম্ব করেছে। তাছাড়া সেসময় যারা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদে ছিলেন তারাও পাকিস্তান সরকারের নিয়োগকৃত। তাই তাদের পক্ষেও এবিষয়ে জোড়ালো কোন কথা বলার ক্ষমতা ছিল না। তাছাড়া এমন অনেক কারণেই যাত্রাকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু হয়নি বলে মনে করেন এই প্রবীন অধ্যাপক।


সর্বশেষ সংবাদ