গৌরব-ঐতিহ্যের ৭০ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়   © টিডিসি ফটো

গৌরব ও ঐতিহ্যের ৭০ বছরে পদার্পণ করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। পদ্মা তীরের কুঠিবাড়ি থেকে 
হাঁটি-হাঁটি, পা-পা করে শিক্ষা, গবেষণার পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তি বিনির্মাণে আজ দেশের খ্যাতনামা বিদ্যাপীঠ পরিণত হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। তবে গুণে-মানে-সম্মানে এই খ্যাতি অর্জন করতে এ বিদ্যাঙ্গণকে অতিক্রম করতে হয়েছে বহু চড়াই-উৎরাই।কালের প্রবাহে ঘটে যাওয়া বহু আন্দোলন, সংগ্রাম, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বাক্ষী মতিহারের এই চির সবুজ প্রাঙ্গণ।

ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধ ও তৎপরবর্তী বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের মূর্ত-প্রতীক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি কিছু মহান ব্যক্তির রক্ত ও ত্যাগের ইতিহাস আজন্মকাল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করবে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা, শহীদ বুদ্ধিজীবী সুখরঞ্জন সমাদ্দার, শহীদ বুদ্ধিজীবী হবিবুর রহমান, শহীদ বুদ্ধিজীবী মীর আবদুল কাইয়ুম, ইতরাত হোসেন জুবেরী, মজিবর রহমান দেবদাস প্রমূখ।

ভাষা আন্দোলনের কিছুকাল পূর্বেই এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ১৯৫০ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ৬৪ সদস্য বিশিষ্ট এক কমিটি গঠিত হয়। ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাজশাহী কলেজ প্রাঙ্গনে সমবেত হোন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ পাসের দাবি তোলেন। এ লক্ষ্যে ১০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী শহরের ভুবন মোহন পার্কে এক জনসভা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজপথে চলে আন্দোলন।

সে-সময় আন্দোলন করতে গিয়ে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন ১৫ ছাত্রনেতা। ফলে আন্দোলন তীব্র হয়। একের পর এক আন্দালনের চাপে টনক নড়ে সরকার ও সুধী মহলের। অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাশ হয়। সেই বছরের ৬ জুলাই অধ্যাপক ইতরাত হোসেন জুবেরীকে উপাচার্য করে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। 

এরপর থেকেই জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, কূটনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে স্বাক্ষরতার ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছে উত্তরবঙ্গের এ শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। ধীরে ধীরে বিদ্যাচর্চা, গবেষণা ও পাণ্ডিত্যের সুখ্যাতি দেশর গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের আনাচে-কানাচে।

আরও পড়ুন: আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে এসএসসি, অক্টোবরে এইচএসসি

৫ জন ছাত্রীসহ ১৬১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা করা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৮ হাজার ৩'শ জন। যাদের মধ্যে ৩১ জন বিদেশী শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি অনুষদের ৫৯টি বিভাগে পাঠদান চলছে। এছাড়া রয়েছে ৬টি উচ্চতর গবেষণা ইনস্টিটিউট, ১৩টি একাডেমিক ভবন। ১৭টি আবাসিক হল। যারমধ্যে ১১টি ছাত্র ও ৬টি ছাত্রী এবং গবেষক ও বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য ১টি ডরমিটরি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষক সংখ্যা ১১৮৭জন, কর্মকর্তা রয়েছেন ৮১৬ জন, সাধারণ কর্মচারী ৯৬৬ জন ও সহায়ক কর্মচারী ৫৪৮ জন।

প্রতিষ্ঠার ৬৯ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩ হাজারের অধিক শিক্ষার্থীকে উচ্চতর ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। যারমধ্যে প্রায় ২ হাজার পিএইচডি এবং এক হাজারের বেশি জনকে এমফিল ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই শিক্ষা ও গবেষণায় বিশ্বদরবারে অভাবনীয় স্বাক্ষর বহন করে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

দীর্ঘ উনসত্তর বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৈরি হয়েছে প্রখ্যাত ভাষা বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ও সেলিনা হোসেন, ইতিহাসবিদ আব্দুল করিম, তাত্ত্বিক ও সমালোচক বদরুদ্দীন উমর, চলচ্চিত্র পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম, খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ আনিসুল হক ও রুহুল কবীর রিজভী।
দেশের খ্যাতনামা কুটনৈতিবিদ এইচটি ইমাম, দেশের প্রথম নারী নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম, দেশের আইনজ্ঞ প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।

দেশের প্রথম হিন্দু মহিলা বিচারক কৃষ্ণা দেবনাথ, আরবী ভাষা পণ্ডিত আফতাব আহমাদ রহমানী, বাংলাদেশ ব্যাংক ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, দেশেন খ্যাতনামা অভিনেতা আহমেদ শরীফ, মনোজ প্রামানিক, চিত্রনায়ক রিয়াজ, ইতিহাসবিদ ডেভিড কফ, নৃবিজ্ঞানী জোহানা কর্ক প্যাট্রিক, ভাষা সৈনিক প্রখ্যাত নাট্যকার ও অভিনেতা মমতাজউদ্দীন আহমেদ, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট, নবীন ক্রিকেটার আল-আমিন হোসেন, দেশ সেরা স্প্রিন্ট দৌড় কিংবদন্তি শিরিন আক্তার। 

বর্তমানে অধ্যাপনা চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুখ্যাতি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন যারা, তাদের মধ্যে অন্যতম খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ সনৎ কুমার সাহা, বিজ্ঞানী ইমেরিটাস অধ্যাপক অরুন কুমার বসাক, বাংলা একাডেমি পুস্কারপ্রাপ্ত নাট্যকার মলয় ভৌমিক, ইতিহাসবিদ আবুল কাশেম, চিত্তরঞ্জন মিশ্র, মৎস গবেষক ইয়ামিন হোসেন, উদ্ভিদ বিজ্ঞান গবেষক অধ্যাপক মনজুর হোসেন সহ আরো অনেক গবেষক, বিজ্ঞানী সাহিত্যক, প্রাবন্ধিক ও লেখক।

সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার করে সাড়া ফেলেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক অধ্যাপক মনজুর হোসেন। তাঁর গবেষণার ফলে জাতি ফিরে পেয়েছে হাজার বছরের হারানো ঐতিহ্য। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের উদ্ভাবিত দেশে প্রথম মৎসজাত খাদ্যদ্রব্য ও উন্নত প্রজাতির মাছ উৎপাদন, কৃষি অনুষদে উন্নতজাতের কলা ও ধান উৎপাদন বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেছে। সকলের এই সমন্বিত গবেষণা, কৃতিত্ব ও অর্জন বিশ্ববিদ্যালয়ের মানকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়েছে। 

দেশের অন্যতম সেরা এ বিশ্ববিদ্যালয়কে অত্যাধুনিক রূপ দেয়ার পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে চলমান রয়েছে ৫০ বছরের মহা-পরিকল্পনা। যারমধ্যে রয়েছে সাত পুকুর গবেষণা প্রকল্প, গবেষণা জালিয়াতি রোধে প্ল্যাগারিজম প্রকল্প, বিশ্ববিদ্যালয় আরকাইভস ও অনলাইনে তথ্য জমা রাখার জন্য ‘আরইউ ক্লাউড’, ব্র্যান্ডিং গিফট শপ, বিশ্ববিদ্যায়ের নিউজলেটার ‘বিদ্যাবার্তা’, বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যচিত্র, সৌন্দর্য্য বর্ধণ, ওয়েবসাইট আধুনিকীকরণ, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স অফিস, ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনের নামকরণ। এছাড়া এ প্রকল্পের মধ্যে থাকা ২০ তলার একাডেমিক ভবন, ছেলেদের ও মেয়েদের পৃথক ১০ তলা আবাসিক হলসহ আরো অনেক নির্মাণ কাজ চলমান।

একাডেমিক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন, গবেষণা, প্রযুক্তি ও যোগাযোগ সুবিধা উন্নত করার লক্ষ্য নেয়া হয়েছে মহাপরিকল্পনা। সম্প্রতি অনুমোদিত বাজেটে গবেষণা, শিক্ষা ও প্রকাশনা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এমনকি সমৃদ্ধ গবেষণা ও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। সেজন্য শতাধিক কোটি টাকার বরাদ্দ ব্যবস্থা নিয়ে কাজ চলমান রয়েছে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীন শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থী বান্ধব ব্যবস্থায় তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বর্তমান প্রশাসন।

প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, দেশের অন্যতম প্রাচীন এ বিশ্ববিদ্যালয় যুগ যুগ ধরে বহু সফলতার স্বাক্ষর বহন করে আসছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকদের নানা গবেষণা, কৃতিত্ব, সুখ্যাতি ও অর্জন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। তবে গৌরবের ৬৯ বছর যেমন অর্জনের, তেমনি প্রতিনিয়ত রয়েছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ।

উপাচার্য বলেন, বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে তরান্বিত করতে নানা পরিকল্পনা গৃহিত হয়েছে। শিক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। অধিকন্তু মানসম্মত গবেষণার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য কাজ চলছে। সকলের সার্বিক সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতা, ঐতিত্য ও অর্জন বিশ্বময় উদ্ভাসিত হবে বলে প্রত্যাশা করেন উপাচার্য।


সর্বশেষ সংবাদ