পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে ভিসিদের পরিবারতন্ত্র!

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

বিধি ভেঙে ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে বা জামাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ পুরোনো। সবশেষ বাসার গৃহকর্মী ও গৃহকর্মীর স্বামীকেও নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে একজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেন ভিসিদের পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এমন অভিযোগ উঠেছে নানামহল থেকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা দেশে যে পরিবারতন্ত্র চলছে তারই প্রতিফলন।

আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) মনে করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগের পদ্ধতি পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক বিবেচনা বাদ দিয়ে প্রকৃত শিক্ষাবিদদের নিয়োগ না দিলে এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে।

গত সপ্তাহে সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশের পর আলোচনায় আসেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সেখ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ভাই-বোন, শ্যালক, আত্মীয়সহ বাসার গৃহকর্মী ও তার স্বামীকে নিয়োগ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে।

তিনি তার আপন ছোট দুই ভাইকে করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার। আপন শ্যালককে নিয়োগ দিয়েছে পিএ টু ডাইরেক্টর পদে। স্ত্রীর ফুপাতো ভাইকে কেয়ারটেকার, চাচাতো বোনকে ডেটা এন্ট্রি অপারেটর, নারী গৃহকর্মীকে অ্যাসিসট্যান্ট কুক ও তার স্বামীকে ড্রাইভার পদে নিয়োগ দিয়েছেন। এদিকে খবর প্রকাশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায় যে ঘটনা তদন্ত হবে।

একইভাবে এর আগে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. শহীদুর রহমান খান আলোচনায় আসেন নিজের পরিবারের নয় সদস্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিয়ে। তিনি নিজের ছেলে ও শ্যালককে সেকশন অফিসার, চার ভাতিজাকে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ল্যাব টেকনিশিয়ান ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ দিয়েছেন।

আরও পড়ুন: ভিসি-প্রোভিসি-ট্রেজারারবিহীন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার

শ্যালিকার ছেলেকে সহকারী প্রকৌশলী, নিকটাত্মীয় একজনকে ডেটা এন্ট্রি অপারেটর পদে নিয়োগ দিয়েছেন অস্থায়ী ভিত্তিতে। আর মেয়েকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন অবৈধ উপায়ে। ইউজিসি তদন্তে এসব অবৈধ নিয়োগের প্রমাণ পেলেও এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

এর আগে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এম আবদুস সেবহান গত বছর অবসরের ঠিক আগের রাতে ১৩৮ জনকে নিয়োগ দিয়ে তুমুল আলোচনায় আসেন। শুধু তাই নয়, এই ভিসি ২০১৮ সালে নিজের মেয়ে এবং জামাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানাতে একটি বিভাগই খুলে ফেলেন।

এর বাইরেও আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩ জনের অবৈধ নিয়োগের খবর। সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। গত এক বছরেই ১৭ জন উপার্যের বিরুদ্ধে নানাভাবে অবৈধ নিয়োগের অভিযোগ পেয়েছে ইউজিসি।

কিন্তু ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের সময় এরকম সাতজন উপাচার্যকে অপসারণ করা হলেও এর পরে আর কোনো উপাচার্যকে শাস্তি বা অপসারনের মুখোমুখি হতে হয়নি।

ইউজিসির সচিব ফেরদৌস জামান তুহিন বলেন, ‘‘ইউজিসির পক্ষ থেকে এই প্রথমবার আমরা খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছি। এটা আইনে পরিবর্তন আনায় আমরা পেরেছি। এর বাইরে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা তদন্ত করতে পারি, সুপারিশ করতে পারি, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনা। আমরা অনেক অভিযোগ পাই। তদন্ত করি। ওই পর্যন্তই।’’

শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগ বিধি থাকলেও, নিয়োগ কমিটি থাকলেও তা ভিসিদের রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত হয়েছে। তারা যা বলেন তাই হয়। তার সঙ্গে যারা থাকেন তারাও সুবিধা নেন। ফলে ভিসিদের পক্ষে অবৈধ নিয়োগ দেয়া আরো সহজ হয়।’’

তার কথা, ‘‘এটা শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রেই এটা হচ্ছে। নেতারা তাদের ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজনকে ক্ষমতার জোরে পদ, পদবী দিচ্ছেন। ভিসিরা পিছিয়ে থাকবেন কেন? দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি এখন সবখানে।’’

তিনি বলেন, ‘‘দেশে ভিসি হওয়ার মত ভালো শিক্ষাবিদ আছেন। কিন্তু ‘ব্যাড মানি ডিরাইভস গুড মানি।’’

আর ফেরদৌস জামান বলেন, ‘‘রাজনৈতিক বিবেচনায় ভিসি নিয়োগের কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। নানা তদবির করে এখন ভিসি হন। এটা চলতে থাকলে এভাবে ভিসিদের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ চলতেই থাকবে।’’

তিনি বলেন, ‘‘প্রকৃত শিক্ষবিদদের নিয়োগ দিতে ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে। ইউজিসি শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগে পরামর্শ দিতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়।’’

এদিকে সর্বশেষ অভিযুক্ত দুইজন ভিসির সাথে কথা বলার চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি। [সূত্র: ডয়চে ভেলে বাংলা]


সর্বশেষ সংবাদ