অস্থিতিশীলতায় বছর পার কুবির, বিধ্বস্ত শিক্ষা কার্যক্রম
- কুবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০৬ PM , আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০৬ PM
২০০৬ সালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলেও অন্যান্য বছরের তুলনায় চরম উত্তেজনা ও অস্থিতিশীলতার মধ্যদিয়ে গেছে ২০২৪ সাল। বছরজুড়ে একের পর ছাত্র-শিক্ষক-প্রশাসন দ্বন্দ্ব, আন্দোলন, প্রশাসনিক পদত্যাগ, রদবদল এবং সর্বশেষ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপক ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ৬ মাস বিভিন্ন ছুটির মধ্যদিয়ে যেতে হয়েছে। ব্যাহত হয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম, সৃষ্টি হয়েছে সেশনজট। অস্বাভাবিক আন্দোলন ও ছাত্র-শিক্ষক-প্রশাসনের ত্রিমুখী সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশও নষ্ট করে ফেলে। সারাবছর ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন আলোচিত ঘটনা তুলে ধরেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস প্রতিনিধি জুবায়ের রহমান।
শীতকালীন ছুটি দিয়ে বছরের শুরু
২০২৪ সালের শুরুটা ছিল শান্তিপূর্ণ। বছরের প্রথম সপ্তাহ শীতকালীন ছুটির মধ্য দিয়ে শুরু হয়। ২ জানুয়ারি থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর ১০ জানুয়ারি থেকে ক্যাম্পাস আবার চালু হয়। শিক্ষার্থীরা তাদের ক্লাসে ফিরে এসে এক ইতিবাচক পরিবেশের মধ্য দিয়ে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু করলেও, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং শিক্ষক-প্রশাসনের মধ্যে ক্রমাগত দ্বন্দ্বের ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় অচলাবস্থা দেখা দেয়।
শিক্ষকদের ওপর হামলা, দ্বন্দ্বের সূচনা
চলতি বছরের গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্বাচিত শিক্ষক সমিতি বিভিন্ন দাবি সহ উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম. আবদুল মঈনের সাথে দেখা করতে যান। এসময় তৎকালীন প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীর ইন্ধনে শিক্ষকদের শারীরিক লাঞ্ছনা ও থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দেওয়ার হুমকি দেন চাকরিপ্রার্থী সাবেক শিক্ষার্থী ও কয়েকজন কর্মকর্তা। এই ঘটনায় ক্যাম্পাসজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষক সমিতি এই হামলার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করে এবং প্রশাসনের কাছে তাদের দাবি তুলে ধরে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযুক্তদের বিচার না করে তাদের আরও কাছে টেনে নেয়। এতে শিক্ষকদের আন্দোলন তীব্র হতে শুরু করে। শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এবং বিচারের দাবিতে শিক্ষক সমিতি শিক্ষক সমিতির ক্লাস বর্জন করে। প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে এই আন্দোলন দীর্ঘমেয়াদি সংকটে রূপ নেয়।
দীর্ঘ ছুটি, উত্তেজনা সাময়িক স্তিমিত
মার্চ মাসের শেষ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ ২৪ দিনের ছুটি ঘোষণা করে। এই ছুটি পবিত্র শব-ই-কদর, ঈদ-উল-ফিতর এবং পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা এই সময় পরিবার ও প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পেলেও, ক্যাম্পাসের সংকট তখনও পুরোপুরি কাটেনি। ২১ এপ্রিল ছুটি শেষে ক্যাম্পাস খুললেও, শিক্ষকদের দাবিগুলো সমাধান না হওয়ায় অস্থিরতা রয়ে যায়।
দ্বিতীয় দফায় শিক্ষকদের ওপর হামলা ও পদত্যাগ
২৮ এপ্রিল উপাচার্যপন্থি শাখা ছাত্রলীগের একটি অংশ, সাবেক শিক্ষার্থী এবং বহিরাগতদের নিয়ে শিক্ষকদের ওপর পুনরায় হামলা চালানো হয়। এই হামলার পেছনে তৎকালীন উপাচার্য, ট্রেজারার, এবং প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীর সরাসরি ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। শিক্ষকদের এই ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনায় পুরো ক্যাম্পাসে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষকদের ওপর এই হামলার জেরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় মোট ১৯ জন শিক্ষক প্রশাসনিক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এই পদত্যাগ কুবি প্রশাসনের জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে কাজ করে এবং শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে আরও বিঘ্ন ঘটায়।
উপাচার্যের কুশপুত্তলিকা ঝোলানো
শিক্ষক সমিতির আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়। ১০ মে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক এবং গোল চত্বরে উপাচার্যের কুশপুত্তলিকা ঝুলিয়ে প্রতিবাদ জানান। এই ঘটনা ক্যাম্পাসজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তবে ১২ মে উপাচার্যপন্থি ছাত্রলীগ কর্মীরা কুশপুত্তলিকা সরিয়ে ফেলে, যা ক্যাম্পাসের পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে।
অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ
শিক্ষক-প্রশাসনের দ্বন্দ্ব এবং ক্রমাগত উত্তেজনার জেরে ৩০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। আবাসিক হলগুলো বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। এই ঘটনা শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
৫৩ দিন পর ক্যাম্পাস পুনরায় চালু
৫৩ দিন বন্ধ থাকার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৯৫তম সিন্ডিকেট সভায় ২৩ জুন থেকে ক্লাস শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া হয়, শিক্ষকদের দাবিগুলো পুরোপুরি মেনে নেওয়া হয়নি। ফলে তারা আংশিক কর্মবিরতি পালন করে এবং পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে সময় লাগে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে উত্তাল কুবি
জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঢেউ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েও আঘাত হানে। জাতীয় পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কোটবাড়ি বিশ্বরোড অবরোধ করার জন্য শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে একত্রিত হয়ে রাস্তায় নামে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে কুবি শিক্ষার্থীরা দেশব্যাপী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
ছাত্র আন্দোলনে প্রথম রক্তাক্ত কুবি
১১ জুলাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এই ঘটনায় প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। এটি ছিল বাংলাদেশের কোটা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রক্তপাতের ঘটনা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই আত্মত্যাগ জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।
প্রশাসনিক পরিবর্তন এবং পদত্যাগ
ক্যাম্পাসের সংকট এবং জাতীয় রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবির, এবং প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী শিক্ষার্থীদের ক্রমাগত আন্দোলনের চাপে পদত্যাগ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অষ্টম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। প্রথমবারের মতো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মাসুদা কামাল এবং অধ্যাপক ড. মো. সোলায়মান যথাক্রমে উপ-উপাচার্য এবং ট্রেজারার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা
ক্যাম্পাসে ক্রমাগত অস্থিরতা নিরসনে এবং শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০তম জরুরি সিন্ডিকেট সভায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বস্তি এনে দিলেও দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব নিয়ে বিতর্ক রয়ে যায়।
আবাসিক হলের নাম পরিবর্তন
শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই আবাসিক হলের নাম পরিবর্তন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নাম পরিবর্তন করে ‘বিজয় ২৪’ রাখা হয় এবং শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন করে ‘বিপ্লবী সুনীতি-শান্তি হল’ রাখা হয়।
২০২৪ সাল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ছিল এক কঠিন সময়। প্রশাসনিক দ্বন্দ্ব, শিক্ষকদের ওপর হামলা, এবং জাতীয় আন্দোলনের প্রভাবে এক বছরের অর্ধেক সময় বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত অচল থাকে। তবে নতুন প্রশাসন এবং শিক্ষার্থীদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা সকলের।