আমি তো মানুষ, মানুষ মরলে তো মানুষের কষ্ট লাগে, সেই কষ্টের কারণেই আন্দোলনে গিয়েছিলাম

মোহাম্মদ ফয়েজ
মোহাম্মদ ফয়েজ  © সংগৃহীত

মোহাম্মদ ফয়েজ, একসময় যার কর্মদক্ষ হাতে নির্ভর করত সাত সদস্যের একটি পরিবার, আজ নিজের জীবনের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছেন। বয়স মাত্র ৩৫, কিন্তু তার জীবন যেন থমকে গেছে এক মর্মান্তিক ঘটনায়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম এই ওয়ার্কশপ মিস্ত্রি, যার ঘামে ভেজা হাতে দিন গুজরান হতো মা-বাবা, স্ত্রী, ছোট ভাই আর কন্যাসন্তানের—তার চোখে আজ দৃষ্টিহীনতার অন্ধকার। 

পাঁচ মাস ধরে কাজ করতে পারছেন না ফয়েজ। ঘরে ভাতের হাঁড়ি চড়ানোর দায় যে এখন তার কিশোর ভাইয়ের কাঁধে।পরিবারের ঘরে নেমে এসেছে এক অভিশপ্ত কালো মেঘ, যা কাটানোর কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। অথচ এই অন্ধকারের শুরু একটি বুলেট দিয়ে, যা তার ডান চোখের আলো চিরতরে নিভিয়ে দিয়েছে। সেই বুলেট যেন শুধু তার চোখ নয়, তার পরিবারের স্বপ্নকেও বিদ্ধ করেছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শটগানের গুলিতে ডান চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন ফয়েজ।  বাম চোখেরও চিকিৎসা প্রয়োজন। তবে চিকিৎসার খরচ চালানোর  সামর্থ্য ফয়েজের পরিবারের নেই।

চিটাগাং রোডের মুক্তিনগর এলাকায় দুই কক্ষের একটি টিনশেড ভাড়া বাড়িতে ফয়েজ তার পরিবারসহ বসবাস করেন। হাবিবুল্লাহ (৬৫) ও জহুরা বেগমের (৫০) বড় সন্তান ফয়েজ। তার ৪ বোন বিবাহিত। তার ছোট দুই ভাই হাবিব (১৪) ও আব্দুর রহমান (৮)। ফয়েজ অসুস্থতায় বাধ্য হয়ে পড়ালেখা ছেড়ে হাবিব যুক্ত হয়েছেন ফয়েজের কর্মক্ষেত্রে। হাবিবের এই সামান্য আয়ে ৭ সদস্যের পরিবারের খাবারের চাহিদা পূরণ করাই যেখানে কষ্টসাধ্য, সেখানে ফয়েজের চিকিৎসা খরচ চালানো একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়েছে।  

দৃষ্টিশক্তি হারানোর নিজের জীবনের সেই ভয়াবহ দিনের কথা মনে করে ফয়েজ বলেন, ‘আমি তো ছাত্র না, ছাত্রদের আন্দোলনে যাওয়ার কথা আমার ছিলো না। কিন্তু আমি তো মানুষ। মানুষ মরলে তো মানুষের কষ্ট লাগে। সেই কষ্টের কারণেই আন্দোলনে গিয়েছিলাম।’

গত ২০ জুলাই সংঘটিত ঘটনার বর্ণণা দিয়ে ফয়েজ বলেন, 'ওইদিন সকাল থেকেই বার বার গুলির আওয়াজ পাইতেছিলাম। দুপুরের পর বাসা থেকে বের হই। চিটাগাংরোড ব্রিজের দিকে (ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক) লাশের ওপর লাশ পড়েছিল। পুলিশ লাশ নিয়ে যাইতেছিল। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাস্তায় আমি সহ কয়েকজন লাশ সরাই। লাশ সরাই দেইখ্যা (দেখে), আমাদের ওপরেও ছররা গুলি ছোঁড়ে পুলিশ। তারপর আমরা ইট দিয়ে পুলিশরে ঢিল দিয়া (দিয়ে) দূরে সরায়ে দেই।

ফয়েজ আরও বলেন, 'আমরা ভাবছিলাম পুলিশ চলে গেছে। এজন্য রাস্তা থেকে লাশ নিয়ে আসতে যাই। কিন্তু খেয়াল করি নেই পুলিশ ব্রিজের (ফুটওভার ব্রিজ) ওপরে ছিল। সেখান থেকে তারা  আমার দিকে গুলি ছোঁড়ে। গুলি আমার নাকের ভিতর দিয়ে ঢুকে ডান চোখ দিয়ে বের হয়। গুলিতে আমার ডান চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। ওই চোখে আমি দেখি না। বাম চোখেও সমস্যা হচ্ছে, ঝাপসা দেখি। ডাক্তার বলছে আরেকটা অপারেশন লাগবে।' 

তিনি আরও বলেন, 'যেখানে সংসার চালানোর টাকা নাই, সেখানে অপারেশনের খরচ কোথা থেকে আসবে? অপারেশনটা সরকারি হাসপাতালে ফ্রি করালেও ঔষধসহ অনেক খরচ হয়। আমার ছোট ভাই পড়া ছাইড়া ওয়ার্কশপে যোগ দিছে। সংসার চালাইতে তো টাকা লাগে। কম খাইছি কিন্তু না খেয়ে থাকি নাই।  ডাল-ভাত হলেও তিনবেলা খাইছি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। 

'জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন' থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছিলেন উল্লেখ করে ফয়েজ বলেন, ''জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন' থেকে এক লাখ টাকা পাইছিলাম। যে টাকাটা পাইছিলাম সেটা চিকিৎসা খরচ বাবদ শেষ হয়ে গেছে। এখনো আরেকটা অপারেশনের জন্য  টাকা দরকার।'

এদিকে ফয়েজের অসুস্থ হওয়ার পর থেকে একমাত্র শিশু সন্তান তোয়ামনি (২০ মাস) কে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন স্ত্রী সাজেদা আক্তার। তিনি বলেন, আমার স্বামী কোনো ছাত্র না। তারপরও আন্দোলনে গিয়েছিল মানুষের টানে।  আমার স্বামী পাঁচ মাস ধরে কাজ করতে পারছে না। আমার ছোট একটা বাচ্চা আছে। বাচ্চা রাইখ্যা কোথাও কাজ শুরু করতে পারতেছি না। আমার দেবরের বেতনে কোন রকমে সংসার চলতেছে। অনেক অভাবে আছে আমাগো পরিবার।' 

সাজেদা কথা বলার সময় পাশেই ছিলেন ফয়েজ। স্ত্রীর শুনে কান্নাজড়িত কন্ঠে ফয়েজ বলেন, 'আমারে ডাক্তার কোন ভারি কাজ করতে নিষেধ করছে। এখন কীভাবে আমার জীবন চলব জানি না। আমার ছোট একটা মেয়ে আছে। যে মেয়ে আমার বাড়িতে ঢুকলে আব্বু আব্বু বলে দৌড়ে আসত, সে এখন আমারে ডরায়। আমার চোখটা দেখলে মাইয়াডা (মেয়েটা)  ভয় পায়, কাছে আসে না।'

সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ফয়েজ  বলেন, ‘আমার অনুরোধ, সুস্থ হয়ে যেন আগের মতো কাজ করতে পারি। সেই ব্যবস্থাটা যেন  সরকার করে দেয়।’


সর্বশেষ সংবাদ