দেশের উচ্চশিক্ষার কাঠামো এখনও বৈশ্বিক মানের নয়
- আহমেদ ইউসুফ
- প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৮:০৫ PM , আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:২৪ PM
উচ্চশিক্ষার মানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এক সময় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে অভিহিত করা হতো। ১৯২১ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বাংলা অঞ্চলে শিক্ষা, সাহিত্য ও বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল কলকাতা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকা পূর্ব বাংলার মানুষের স্বপ্ন ও আশার নতুন কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তবে শতবর্ষ পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের জন্য কতটা কল্যাণ বয়ে এনেছে এখন উঠছে সে প্রশ্ন।
স্বাধীনতা পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অন্যতম আলোচ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু বর্তমানে প্রতি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ উচ্চশিক্ষার মানকে কিছুটা প্রশ্নের মুখে ফেলেছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাথে বিশ্বায়নের যে ধারণা সেটিও অনেকাংশে ফিকে হয়ে আসছে।
বর্তমানে শিক্ষাখাত এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা বাজেটেরও বেহাল দশা। কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ঘোষণা করা হয়। সেখানে গবেষণা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ২০ কোটি টাকা। যেখানে দুই হাজার শিক্ষক রয়েছেন, সেখানে প্রতি শিক্ষক গবেষণাখাতে পুরো বছর এক লাখ টাকা পাবেন কি-না সন্দেহ রয়েছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা এর থেকে আরও করুণ। মূলত একটি দেশে কতটি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা যাবে সেটি অনেকাংশে নির্ভর করে সেখানে নিয়োগ দেওয়ার মতো কতজন যোগ্য শিক্ষক আছেন।
আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এখন আর বুদ্ধিজীবী পরিচয় দেয় না তারা এখন নিজেদের বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে পরিচয় দেয়। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কলুষিত হওয়ার জন্য তারাই দায়ী। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের সতর্কতার সাথে এড়িয়ে চলতে হবে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত নষ্ট করার পেছনেও তাদের দায় রয়েছে-অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল, শিক্ষাবিদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং টোটাল শিক্ষাখাতে অপ্রতুল গবেষণা বরাদ্দের কারণ সম্পর্কে মন্ত্রী পরিষদ এবং প্রধানমন্ত্রী ভালো বলতে পারবেন। কেন শিক্ষাখাতে এত কম টাকা বরাদ্দ দেয়া হল। আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে গবেষণা এবং শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য আরও বেশি টাকা বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। তবে আক্ষেপের বিষয় হলো স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এখনও কোন রাজনৈতিক নেতা কিংবা সরকার প্রধান এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক, শিক্ষাবিদ
দেশের বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এখন আর বুদ্ধিজীবী পরিচয় দেয় না তারা এখন নিজেদের বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে পরিচয় দেয়। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কলুষিত হওয়ার জন্য তারাই দায়ী। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের সতর্কতার সাথে এড়িয়ে চলতে হবে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত নষ্ট করার পেছনেও তাদের দায় রয়েছে। বিভিন্ন সিভিল সোসাইটি আছে, তাদের কাজ কী? তারা মূলত বাহিরের বিভিন্ন শক্তি থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে চলে, সে অনুযায়ী পক্ষপাতমূলক বক্তব্য দিয়ে বেড়ায়। যদিও রাজনৈতিক নেতারা তাদের কথা অনুযায়ী কাজ করে না কিন্তু অনেকক্ষেত্রে প্রভাবিত হন। এসব বিষয়গুলো একদিনে পরিবর্তন সম্ভব নয়। বরং সমন্বিতভাবে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কাজ করলে পরিবর্তন সম্ভব।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়াটি রাজনৈতিক করে ফেলা হয়েছে। যেখানে একজন ভিসি শিক্ষক নিয়োগের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। যদিও বৈশ্বিকভাবে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি ন্যূনতম তিনটি স্তরে বিভক্ত। কিন্তু আমরা সে ধরনের কোনো স্তর আজ পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারিনি-ড. কামরুল হাসান মামুন, অধ্যাপক, ঢাবি
বিশ্বব্যাপীই কিউএস র্যাঙ্কিংকে মনে করা হয় সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) ৪ জুন প্রকাশিত সর্বশেষ র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এখন ৫৫৪। গত বছরও এই র্যাঙ্কিংয়ে সাত শর ঘরে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অর্থাৎ বিশ্বসেরা ৬০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় উঠে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি মাইলফলক। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্তও ৮০১-১০০০–এর মধ্যে ছিল তাদের অবস্থান। র্যাংকিংয়ে বুয়েট ৮০১ থেকে ৮৫০ অবস্থানে এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ৮৫১ থেকে ৯০০ অবস্থানে আছে। যদিও দেশে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেড়শো’র বেশি। এতসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় যখন বিশ্বমানের তালিকায় যুক্ত হয় তখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈশ্বিক মান নিয়ে।
কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) পুরো বিশ্বের বিশ্বদ্যিালয়গুলোকে ৬টি নির্দিষ্ট মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে র্যাঙ্কিং করে থাকে। যার মানদণ্ডগুলো হলো অ্যাকাডেমিক পিয়ার রিভিউ ৪০ শতাংশ, শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত ২০ শতাংশ, গবেষণা ২০ শতাংশ, চাকরিতে স্নাতকদের সুনাম বা কর্মদক্ষতা ১০ শতাংশ, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের অনুপাত ৫ শতাংশ ও আন্তর্জাতিক শিক্ষক বা কর্মকতার অনুপাত ৫ শতাংশ।
মানসম্মত গবেষণার জন্য শুধু অর্থ বরাদ্দ সমাধান নয়। এজন্য উল্লেখযোগ্য দিক হলো পর্যাপ্ত সময় এবং পরিবেশ প্রদান করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার জন্য যে বরাদ্দ দেয়া হয় বাহিরের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বিভাগেও তারচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়-ড. কামরুল হাসান মামুন, অধ্যাপক, ঢাবি
সার্বিকভাবে আমাদের উচ্চশিক্ষার মান এবং কাঠামো নিয়ে কথা হয়েছে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের সাথে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার প্রসঙ্গ নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আসলে আমরা বায়ান্ন, উনসত্তর এবং একাত্তরের কথা বলি। সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আমাদের যে দায়িত্ব ছিল সেটা আমরা সুচারুভারেব পালন করেছি। কিন্তু একাত্তরের পরে আমাদের কাজ হওয়ার কথা ছিল বিশ্বায়নের পথে এগিয়ে যাওয়া। সমগ্র বিশ্বে উচ্চশিক্ষার যে ধারণা রয়েছে বৈশ্বিক হওয়ার সে ধারায় আমরা অনেকটা ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের যে পরিবর্তন এসেছে সেটা ইতিবাচক হয়নি বরং সেটা নেতিবাচক হয়েছে।
ড. কামরুল হাসান মামুন, অধ্যাপক, ঢাবি
অধ্যাপকদের মূল্যায়নের প্রসঙ্গে এই অধ্যাপক বলেন, ১৯২৬ কিংবা ২৭ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদের যখন বিজ্ঞাপন হয় তখন বেতনের হার ছিল ১০০০-১৮০০ রুপি (সূত্র : রমেশ চন্দ্র মজুমদারের ‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’) তখন অধ্যাপক বেতন পেতেন ১২০০ রুপি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক তখন বেতন পেতেন ৮০০-১০০০ রুপি। অর্থাৎ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক তখন প্রায় ৪০০ রুপি বেশি বেতন পেতেন। যে বেতন দিয়ে ৪৫০ মন চাল কিনতে পারতো। বর্তমানে একজন অধ্যাপকের পূর্ণ বেতন দিয়ে বড়জোর ৪০ মন চাল কিনতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়াটি রাজনৈতিক করে ফেলা হয়েছে। যেখানে একজন ভিসি শিক্ষক নিয়োগের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। যদিও বৈশ্বিকভাবে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি ন্যূনতম তিনটি স্তরে বিভক্ত। কিন্তু আমরা সে ধরনের কোনো স্তর আজ পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারিনি।
রাজনৈতিক প্রভাবের কুফল সম্পর্কে অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, অতি রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কারণে শিক্ষকরা এখন আর কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না। তারা গবেষণার চেয়েও বেশি সময় রাজনীতির পেছনে ব্যয় করেন। কারণ সবাই চায় পরবর্তীতে বড় পদে যেতে। তাই সবার মধ্যে ধারণা তৈরি হয়, যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করে তাহলে তার পরবর্তী গন্তব্য অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। শিক্ষকদেরকে আমরা শিক্ষা-গবেষণার চেয়ে রাজনৈতিক সাইডে বেশি লেলিয়ে দিয়েছি। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কমিয়ে ফেলা হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসলে বিশ্ববিদ্যালয় নেই। তারা ইউনিভার্সাল না বরং লোকাল নিয়মকানুন চালু করেছে। লোকাল নিয়ম চালু রেখে আমরা কীভাবে ইউনিভার্সাল হব? আমি বলব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটা বড় মাফিয়া চক্রের মধ্যে পড়ে গেছে। যেখানে তোষামোদি এবং রাজনৈতিক ভিত্তি শিক্ষা গবেষণার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।-ড. কামরুল হাসান মামুন, অধ্যাপক, ঢাবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি বিভাগে এমন একজন কিংবা দুজন শিক্ষক আছেন যাদের ছাত্র না হলে নতুন শিক্ষক হওয়া সম্ভব নয়। বিষয়টির অধিক তদন্ত হলে বিস্তারিত প্রকাশ পাবে। অথচ পৃথিবীর অন্য দেশে নিজ বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে আন্ডারগ্রাজুয়েট করে বের হলে তাদের নিজ বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নেয়া হয় না। এতে শিক্ষকদের তোষামোদি সংস্কৃতি গড়ে উঠে না।
শিক্ষক নিয়োগের বৈশ্বিক কাঠামোর সাথে বাংলাদেশের পার্থক্যের কথা তুলে ধরে এই অধ্যাপক বলেন, বুয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের কি ভাবে? তারা নিজেদের শিক্ষার্থী ছাড়া অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটদের শিক্ষক হিসেবে নেয় না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েরই চিত্র এমন। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসলে বিশ্ববিদ্যালয় নেই। তারা ইউনিভার্সাল না বরং লোকাল নিয়মকানুন চালু করেছে। লোকাল নিয়ম চালু রেখে আমরা কীভাবে ইউনিভার্সাল হব? আমি বলব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটা বড় মাফিয়া চক্রের মধ্যে পড়ে গেছে। যেখানে তোষামোদি এবং রাজনৈতিক ভিত্তি শিক্ষা গবেষণার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।
গবেষণার বিষয়ে উল্লেখ করে অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, মানসম্মত গবেষণার জন্য শুধু অর্থ বরাদ্দ সমাধান নয়। এজন্য উল্লেখযোগ্য দিক হলো পর্যাপ্ত সময় এবং পরিবেশ প্রদান করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার জন্য যে বরাদ্দ দেয়া হয় বাহিরের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বিভাগেও তারচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়। ৫৬টি গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। যেখানে কোনো সুনির্দিষ্ট মূল্যায়ন পদ্ধতি নেই। ফলে এদের যে বরাদ্দ দেয়া হয় এটা সম্পূর্ণ অপচয় হয়। কারণ তারা কোনো কাজ করছে না। তাও যদি মানসম্মত বরাদ্দ দেয়া হত তাহলে কিছু কাজ উঠে আসত।