খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চায় পিছিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
- হোসাইন আরমান
- প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২২, ০১:১৩ PM , আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২২, ০৬:৫০ PM
একটা সময় দেশের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আধিপত্য ছিলো বেশি। তবে বর্তমানে এ পরিবেশ দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং সংস্কৃতি কর্মীরা। সম্প্রতি শেষ হওয়া বঙ্গবন্ধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপ এর তৃতীয় আসরে এই চিত্র দেখা গেছে। এই আসরে ১২৫টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। আর পদক তালিকায় শীর্ষ ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ছয়টিই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
এক সময় দেশের টেলিভিশন, নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীতাঙ্গনে রাজত্ব করেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দেশসেরা শিল্পীরা পড়েছেন কোন না কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন তুলনামুলকভাবে সেটি কমছে এবং দিন দিন এই সংখ্যা নিচের দিকে নামছে। সেই তুলনায় বিনোদন অঙ্গনে বাড়ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আধিপত্য। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনিশ্চিত ক্যারিয়ার, সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ বাড়ায় এই দুই অঙ্গনে তাদের উপস্থিতি কমছে বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন: চ্যাম্পিয়ন ড্যাফোডিল, সেরা দশের ছয়টিই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একঝাক তারকা পড়াশোনা করেছেন। কিংবদন্তি পরিচালক জহির রায়হান (বাংলা), খান আতাউর রহমান, হুমায়ূন আহমেদ, কালজয়ী নাট্যকার মুনির চৌধুরী, অভিনেতা আসাদুজ্জামাম নুর (আইন), নাট্যকার আব্দুল্লাহ আল মামুন (ইতিহাস), মামুনুর রশিদ (রাষ্ট্র বিজ্ঞান), নায়ক আলমগীর(রাষ্ট্র বিজ্ঞান), বুলবুল আহমেদ, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল( আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ), সোহেল রানা, ইলিয়াস কাঞ্চন(সমাজ বিজ্ঞান), ডলি আনোয়ার (আশির দশকের অভিনেত্রী), ডলি জহুর (সমাজ বিজ্ঞান), আলী যাকের (সমাজ বিজ্ঞান), ড. ইনামুল হক, বারী সিদ্দিকী, ফকির আলমগীর (গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা)।
ফেরদৌসী মজুমদার, পরিচালক তারেক মাসুদ, রেজোয়ানা চৌধুরী বন্যা, ফাল্গুনী হামিদ, তারানা হালিম (আইন বিভাগ), লায়লা হাসান (দর্শন), অভিনেতা রায়সুল ইসলাম আসাদ, খায়রুল আলম সবুজ, অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফা (ইংরেজি বিভাগ), রোকেয়া প্রাচী, বিজরী বরকতুল্লাহ, বন্যা মির্জা এবং গোলাম ফরিদা ছন্দা। বিশ্ববিদ্যালয়টির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে নায়ক ফেরদৌস, অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম, অভিনেত্রী তাজিন আহমেদ, বন্যা মির্জা, বিপাশা হায়াত, ব্যবসায় প্রশাসনে ব্যাচেলর (মার্কেটিং) ও মাস্টার্স (ফাইন্যান্স) শেষ করেন তাহসান খান।
চারুকলা থেকে পাশ করেছেন টেলি সামাদ, আফজাল হোসেন, বিপাশা হায়াত, চঞ্চল চৌধুরী, সাজু খাদেম, প্রাণ রায়সহ এমন বেশ ক’জন তারকা শিল্পী। মিশা সওদাগর (ব্যবস্থাপনা), পরিচালক ও অভিনেতা অনিমেশ আইচ, রাফিয়া রশীদ মিথিলা (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরীরর (গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা) মত অসংখ্য বিখ্যাত গায়ক, নায়ক, নাট্যকার, নৃত্যশিল্পী বেড়ে উঠেছে ঢাবির আলো বাতাসে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
দেশের সাংস্কৃতিক, নাট্য এবং সংগীতাঙ্গনেও পিছিয়ে নেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষার্থীরা। দেশের সংগীতাঙ্গনের পুরোধাদের অধিকাংশই চবির শিক্ষার্থী। সোলসের পার্থ বডুয়া, রেঁনেসা ব্যান্ডের নকীব খানসহ বাপ্পা মজুমদার, এস আই টুটুল এবং নাট্যকার হাসান মাসুদ, নাট্যকার সোহেল খান, নাট্য অভিনেত্রী ঊর্মিলা শ্রাবন্তি কর, চিত্রলেখা গুহ সবাই চবির শিক্ষার্থী ছিলেন।
বুয়েট
দেশসেরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট থেকেও অনেক গুণী শিল্পী পড়ালেখা করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেযোগ্য কয়েকেজন হলেন, অভিনেতা ও পরিচালক আবুল খায়ের, গাজী রাকায়েত, তৌকির আহমেদ বুয়েটে ছাত্র ছিলেন। তানজির তুহিন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করেছেন ব্যান্ড দল শিরোনামহীন পরে আভাস। অভিনেত্রী অপি করিম বুয়েটের স্থাপত্যবিদ্যায় পড়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও মিলেছে বেশ কয়েকজন গুনী অভিনয় শিল্পী। কালজয়ী অভিনেতা হুমায়ূন ফরিদী (অর্থনীতি ৫ম ব্যাচ) নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন, ফারুক আহমেদ (ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ৮ম ব্যাচ), শহীদুজ্জামান সেলিম জাবির ছাত্র ছিলেন। সজল ও বিন্দু আইবিএতে, জাকিয়া বারী মম পড়েছেন নাট্যকলায়। পরিচালক দীপংকর দীপন, নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদসহ আরও অসংখ্য শিল্পী এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়েছেন। সুমাইয়া শিমু করেছেন পিএইচডি। গরিবের ডাক্তার খ্যাত অভিনেতা ডা. এজাজুল ইসলাম রংপুর মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় এটি। কিংবদন্তী গায়ক এন্ডু কিশোর (ব্যবস্থাপনা), অভিনেতা আহমেদ শরীফ, নায়ক রিয়াজ, পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিম, অভিনেতা মনোজ প্রামাণিক রাবির ছাত্র ছিলেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
কিংবদন্তী চলচ্চিত্র অভিনেতা প্রবীর মিত্র, মীর সাব্বির, অভিনেত্রী নাজনীন হাসান চুমকি, তানিয়া আহমেদ, নায়িকা রত্না।
এইতো গেলো অতীতের কথা। বর্তমান প্রজন্মের কি অবস্থা। এবার সেটা দেখা যাক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থক্যটা তৈরি হয়েছে এখানেই। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র, বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর, উইকিপিডিয়ার তথ্য ঘেটে দেখা যায় বর্তমান সময়ে বিনোদন অঙ্গনের পরিচিতমুখগুলো অধিকাংশই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
জানা যায়, মাহিয়া মাহি শান্ত মরিয়মে পড়াশোনা করছেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন সোহানা সাবা। মেহজাবিন বিবিএতে পড়ছেন। নুসরাত ফারিয়া এআইইউবিতে। পিয়া বিপাশা সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজে পড়ছেন। অভিনেত্রী ভাবনা ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস থেকে ইংরেজিতে পড়েছেন। শিশুশিল্পী থেকে চিত্রনায়িকা হওয়া জনপ্রিয় তারকা প্রার্থনা ফারদিন দীঘিও সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টির মিডিয়া স্টাডিজ ও জার্নালিজম বিভাগে ভর্তি হয়েছেন।
নাঈম, ঈশিতা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স শেষ করেছেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন সাবিলা নূর । নায়িকা ববি হক ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ শেষ করেছেন। নায়িকা আঁচল স্ট্যামফোর্ড থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেছেন।
অর্চিতা স্পর্শিয়া ইউল্যাব থেকে বিবিএ শেষ করেছেন। জোভান ইউনাইটেড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক করছেন। সিয়াম যুক্তরাজ্যে থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক করেছেন। মৌসুমী হামিদ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে খুলনার একটি কলেজে অনার্স পড়ছেন। লাক্স সুন্দরী বাঁধন বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজ থেকে সাফল্যের সঙ্গে বিডিএস (গ্র্যাজুয়েশন) সম্পন্ন করেছেন।
বিদ্যা সিনহা মিমকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও ছাড়তে হয়। নতুন করে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। চিত্রনায়ক বাপ্পী চৌধুরী সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করছেন ইউল্যাবে। তমা মির্জা আইনে পড়ছেন মানারাত ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিল্ম স্টাডিজের ওপর স্নাতক শেষ করেছেন স্বাগতা।
এদের মধ্যে প্রায় সবাই মিডিয়াতে নিয়মিত অভিনয় করছেন। কিন্তু পড়াশোনাটা কোন এক স্তরে এসে থমকে আছে। ব্যস্ততা যেমন বেড়েছে তেমনি শিক্ষার দৌড়ে পিছিয়েছে। অনেকের নামের সঙ্গে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও নিয়মিত নন তারা।
অন্যদিকে, সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বলা হয় ক্যাম্পাসের প্রাণ। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠন যত সুসংগঠিত সে ক্যাম্পাস তত প্রাণবন্ত। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন অর্থ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দিনদিন প্রাণহীন হয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষ কোনো বরাদ্দ না থাকায় নানা জায়গায় হাত পেতে টেনেটুনে চলছে সংগঠনগুলো। এর কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৈরী হচ্ছে না শিল্পী। সম্ভাবনা থাকলেও অনেকেই আবার পরিবার হাল ধরতে দ্রুত চাকরিতে যোগ দেন। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই শুরু করেন চাকরির প্রস্তুতি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য সংগঠন ‘চিরকুট’ এর সদস্য সচিব মেহেদী মামুন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, করোনা মহামারীর পর বিভিন্ন কারণে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে গেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আর্থিক ও ক্যারিয়ার সুরক্ষার চিন্তা বেড়ে যাওয়া তার একটি কারণ। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পেলে সেটি কাটিয়ে ওঠা কঠিন কিছু হবে না বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কালচারাল সোসাইটির সাবেক সভাপতি হিল্লোল শিখর সমাদ্দার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, টিএসসি কেন্দ্রিক সংগঠনগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে না। আমি যখন সভাপতি ছিলাম তখন ডাকসু সক্রিয় ছিলো। তখন টিএসসসিতে প্রচুর অনুষ্ঠান হয়েছে। চর্চা করা এবং প্রদর্শনীর সুযোগ থাকায় ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক চর্চার ধারা অব্যাহত ছিলো। ডাকসু নিস্ক্রিয় হবার পর থেকে এই ধারা থেমে যায়। সংগঠনগুলো নিজের টাকা সব সময় অনুষ্ঠান আয়োজন করা এবং অনুশীলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। ডাকসু সচল হলে এই সমস্যা সমাধান হবে বলে আশা করেন তিনি।
তবে এই অনগ্রসরতার জন্য সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ারভিত্তিক পড়াশোনাকে দায়ী করে তিনি বলেন, এখনও দারুন প্রতিভাবান অনেক শিক্ষার্থী আসে। ১ম-২য় বর্ষ পর্যন্ত তারা সক্রিয় থাকলেও পরে চাকরির জন্য প্রস্তুতি শুরু করে। এরপর তাদেরকে আর পাওয়া যায় না। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ক্যারিয়ার অনিশ্চিত তাই কেউ ঝুঁকি নিতে চায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি জয়দীপ ভট্টাচার্য দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা অতীত ইতিহাস ঘাটলে দেখতে পাই সাংস্কৃতিক চর্চা বেগবান হয় শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম, প্রতিবাদের মাধ্যমে। এখন সেই আন্দোলন করার সুযোগ দিচ্ছে না। সাংস্কৃতিক চর্চা একটি বৈচিত্রের বিষয়। ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া এট সম্ভব নয়। ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পর থেকে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। তখন থেকে এটা কমে গেছে। এজন্য ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক বিবেক অনুপ বলেন, ছাত্রলীগ সব সময় টিএসসি কেন্দ্রিক সংগঠনগুলোর পাশে ছিলো এবং থাকবে। তারা যখন কোন অনুষ্ঠান করে আমরা অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করার চেস্টা করি। অনুষ্ঠানের অনুমতি নিয়ে দেয়া, নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। ছাত্রলীগ যখন কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এসব সংগঠনেগুলোকে সাথে নিয়েই আয়োজন করে। টিএসসিকে মৌলবাদীদের দখল থেকে মুক্ত রাখার জন্য ছাত্রলীগ সব সময় কোন না কোন কার্যক্রম পরিচালনা করে।
তবে ডাকসুর অভাবের কথা স্বীকার করেছেন ছাত্রলীগের এই নেতা। তিনি বলেন, ডাকসু যখন সচল ছিলো তখন অনেক অনুষ্ঠান হয়েছে। টিএসএসসি সব সময় জম-জমাট ছিলো তখন। ঢাকসু নিস্ক্রিয় হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো সিনেটে উপস্থাপন হচ্ছে না। তবুও আমরা শিক্ষকদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসব সংগঠনের দাবিগুলো তুলে ধরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, একটা সময় দেশের সাংস্কৃতিক চর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিলো ঢাবির টিএসসি। টিএসসিতে সাংস্কৃতি চর্চা কমে যাওয়ার পর থেকে দেশে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ধ্বস নেমে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ঢাকসু) টিএসসিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। ঢাকসুর সাংস্কৃতি সম্পাদক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতো। তখন ছাত্র রাজনীতি ছাত্রদের কল্যাণে কাজ করতো। এখনতো ঢাকসু সক্রিয় না। ছাত্ররাজনীতিও ভিন্ন পথে তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব কার্যক্রম কমে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুর্বলতা তুলে ধরে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সহ-কার্যক্রমকে কোন গুরুত্ব দেয় না। এসব সংগঠনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করে না। তাই ঢাবিতে সাংস্কৃতিক চর্চা শূণ্যের কোঠায় নেমে আসছে। এদিকে কারও কোন নজর নেই। শিক্ষার্থীদেরও আগ্রহ কমে গেছে। ২য় বর্ষে উঠলে ক্লাসের প্রথম সারির শিক্ষার্থীরা বিদেশ যাওয়ার চিন্তা করে আর বাকীরা বিসিএসের পিছনে ছুটে। সবাই লাইব্রেরীতে গিয়ে চাকরির পড়া মুখস্ত করেন।
তিনি আরও বলেন, টিএসসির পরিবেশ পরিবর্তন করতে হবে। বড় অডিটরিয়াম করতে হবে। সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকসু সচল করতে হবে। ঢাকসুর তত্ত্বাবধানে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। অতীতে যেমনটা হতো। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে দলীয়করণ করা যাবে না।
তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক রশিদ হারুন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এখনও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সবখানেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই যাচ্ছে। টেলিভিশন, নাটক, সিনেমায় পর্দার আড়ালে সবাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে এসব বিষয়ে পড়ালেখা করে তারা কোথায় যাচ্ছে? তারতো এ অঙ্গনেই কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, বলা হচ্ছে অতীতে যারা বিনোদন অঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলো। কারণ তখনতো বেসরকারি কোন বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো না। তবে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এগিয়েছে। সাধারণত যাদের টাকা আছে বেশিরভাগ তারাই এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ে। তাদের টাকা আছে তারা শখের বশে এ অঙ্গনে আসছে। যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তারা অধিকাংশই নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের উপর পরিবারের একটা চাপ থাকে তাই শিক্ষাজীবন থেকেই তারা চাকরির পিছনে ছুটতে হয়। এজন্য এ অঙ্গনে কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে পেলে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এ বিষয়টার সাথে আমি একমত। মাঝে কয়েক বছর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে গিয়েছিলো। ক্যাম্পাসগুলোতে অপসংস্কৃতি, মৌলবাদী রাজনীতির বিস্তারের কারণে এ সংকট তৈরি হয়েছিলো।
শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতি বিমুখতার কারণ হিসেবে তিনি আরও বলেন, পৃথিবী পরিবর্তনশীল। সবকিছু দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে তাই অতীতের সাথে বর্তমানের তুলনা করলে হবে না। আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে শিক্ষার্থীরা ভিন্ন সংস্কৃতির দিকেও ঝুঁকছে। তবে এর অন্যতম একটি কারণ বিসিএস চাকরি। বিসিএস নিয়ে পড়ালেখা করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা এসব থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমরা বিষয়টা বুঝতে পেরে এখন আবার প্রচণ্ড ভাবে সাংস্কৃতিক চর্চা শুরু করেছি। আবার আগেরমত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড চালু হয়েছে।
তবে এই দাবি অস্বীকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আকতারুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা কোথাও পিছিয়ে নেই। সব ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক সবক্ষেত্রে ঢাবির শিক্ষার্থীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
খেলাধুলায় আধিপত্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের
সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক খেলাধুলার সবচেয়ে বড় আসর ‘বঙ্গবন্ধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপ’। ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো এই আয়োজন শুরু হয়। সর্বশেষ চলতি মাসের ২৩ নভেম্বর শেষ হয় এটির তৃতীয় আসর।
এতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। ১০টি স্বর্ণ, ৭টি রৌপ্য ও ৭টি ব্রোঞ্জসহ সর্বমোট ৮৮ পয়েন্ট পেয়ে পদক তালিকায় শীর্ষস্থান অর্জন করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। ২৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলোয়াড়দের হাতে এ চ্যাম্পিয়ন ট্রফি তুলে দেন।
এবারের আসরের পদক তালিকায় শীর্ষ ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ছয়টিই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তৃতীয় আসর পদক তালিকায় ড্যাফোডিলের পরে ৬৭ পয়েন্ট নিয়ে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান দ্বিতীয়। তাদের ৬টি স্বর্ণ, ৮টি রৌপ্য ও ১৩টি ব্রোঞ্জ। ৫৮ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘গণ বিশ্ববিদ্যালয়’। তাদের ৫টি স্বর্ণ, ১০টি রৌপ্য ও ৩টি ব্রোঞ্জ।
এরপর ৪৪ পয়েন্ট নিয়ে চতুর্থ স্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘উত্তরা ইউনিভার্সিটি’, ৩৩ পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম স্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি’। ২৭ পয়েন্ট নিয়ে ৬ষ্ঠ স্থানে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৮ পয়েন্ট নিয়ে সপ্তম স্থানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ১২ পয়েন্ট নিয়ে অষ্টম স্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অন্যদিকে, ১টি স্বর্ণ, ১টি রৌপ্য ও ১টি ব্রোঞ্জ অর্জন করে সমান পয়েন্ট (৯) নিয়ে নবম স্থানে যৌথভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি’ ও ‘সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি’। ২টি রৌপ্য ও ৩টি ব্রোঞ্জ অর্জন করে ৯ পয়েন্ট নিয়ে দশম স্থানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রসঙ্গত, প্রতিটি স্বর্ণের জন্য ৫, রৌপ্যের জন্য ৩ এবং ব্রোঞ্জের জন্য ১ পয়েন্ট হিসাব করা হয় বলে জানায় আয়োজকরা।
বঙ্গবন্ধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপ এর ৩য় আসরে ১২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণে ফুটবল, ক্রিকেট, সুইমিং, অ্যাথলেটিক্স, টেবিল টেনিস, বাস্কেটবল, ভলিবল, হ্যান্ডবল, সাইক্লিং, দাবা, কাবাডি ও ব্যাডমিন্টনসহ ১২টি ইভেন্টের সমন্বয়ে নারী, পুরুষ উভয় বিভাগে ৭ হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণে করে ।
আগের মতো ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব তৈরি হচ্ছে না ঢাবিতে
এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, হ্যান্ডবল, বাস্কেটবল, দাবা, টেবিল টেনিস, সাঁতারসহ সব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপকভাবে। দাপুটে অংশগ্রহণ ছিল। যার প্রমাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রে সংরক্ষিত ১৯৮৫ সালের একটি ছবি। ছবিতে দেখা যায় তখনকার জাতীয় ক্রিকেট দলের সাতজন খেলোয়াড়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অথচ আজ সেই ঐতিহ্য আর নেই।
একমাত্র বিকেএসপি থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে খেলোয়াড় কোটায় ছাত্র ভর্তির নিয়ম থাকলেও বেশ কয়েক বছর ধরে কেউ আসছে না ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানটি থেকে। এরপরও যারাই ভর্তি হয়ে ক্রীড়াঙ্গনে অবদান রেখেছেন, তারা সবাই নিজস্ব মেধা ও যোগ্যতায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে ২০১৪ সালে খেলোয়াড় কোটা সংশোধন করে আইন করা হয়; যদি কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় ৪৮ পায় তাহলে তার জন্য কোটা কার্যকরে সুপারিশ করা হবে। কিন্তু এ কোটার শর্ত পূরণ করে বিকেএসপিরও কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারেনি।
২০১৫ সালের ২৯ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে ২০০০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ক্রীড়াঙ্গনে অবদানের জন্য ৪৮ সাবেক শিক্ষার্থীকে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্লু’ প্রদান করা হয়। পুরস্কারপ্রাপ্তদের অধিকাংশই নিজস্ব মেধা ও যোগ্যতায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।
‘ব্লু’ প্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন- জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক সহ-অধিনায়ক শাহরিয়ার নাফিস, ক্রিকেটার জহিরুল ইসলাম অমি, মোশাররফ হোসেন রুবেল, ফুটবলার জাকারিয়া পিন্টু, ফিরোজ মাহমুদ হোসেন (টিটু), মো. মনোয়ার হোসেন, মো. শাহানুর রহমান, অ্যাথলেটিকস মো. রকিব দোজা আকন্দ, হকি খেলোয়াড় মো. মওদুদুর রহমান, ভলিবলের জেসমিন খান, হ্যান্ডবলের নুসরাত শারমীন, সায়মা মাহমুদা, ফারজানা আক্তার ভূঁইয়া, টেবিল টেনিসের ফারহানা পারভীন টুম্পা, ব্যাডমিন্টনের আফসানা ফেরদৌস।
তাদের আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়াঙ্গনে আরো অনেক নামি দামি ক্রীড়া ব্যক্তিত্বকে সৃষ্টি করেছেন। যারা মাঠে খেলেছেন কিংবা মাঠের বাইরে সংগঠকের ভূমিকায় ছিলেন। আইসিসির ধারাভাষ্যকার আতাহার আলী খান, নির্বাচক ফারুক আহমেদ, ইমতিয়াজ সুলতান জনি, দেওয়ান আরিফ টুটুল, সাঈদ-উর-রব, সুলতানা কামাল, সালাম মুর্শেদী, শফিউল ইসলাম মানিক, সাব্বির আহমেদ অন্যতম। এছাড়া শেখ কামালের মতো ক্রীড়া সংগঠকও ছিলেন ঢাবির শিক্ষার্থী।
তবে এমন ঐতিহ্য হারিয়ে বর্তমানে খেলাধুলায় আগ্রহ হারিয়েছে শিক্ষার্থীরা। বিকেএসপি থেকে আসা শিক্ষার্থীদের কোটা ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও আসছে না কোনো শিক্ষার্থী। অন্যদিকে নিয়মিত খেলাধুলার পাশাপাশি মফস্বল থেকেও কেউ ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারছেন না। তৈরি হচ্ছে না আগের মতো ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব।