বিবিএতে আগ্রহ কমছে শিক্ষার্থীদের

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ ডিগ্রিতে আগ্রহ কমছে শিক্ষার্থীদের
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ ডিগ্রিতে আগ্রহ কমছে শিক্ষার্থীদের  © ফাইল ফটো

দু’দশক আগে ব্যবসার পরিবেশ অনুকূল হয়ে ওঠায় ব্যবসায় প্রশাসনের বিষয়গুলোয় উচ্চশিক্ষিত ও দক্ষ কর্মীর চাহিদা তৈরি হয়। ফলে স্নাতক পর্যায়ে ব্যবসায় প্রশাসনবিষয়ক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বিবিএ) এর চাহিদাও বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়ে বেসরকারি খাতও। ব্যাপক চাহিদা থাকায় সেসময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিকাশও ঘটেছে বিবিএ কার্যক্রমকে ঘিরেই।

তবে চাকরির বাজার সঙ্কুচিত হওয়ায় বিবিএর চাহিদা এখন কমতে শুরু করেছে। এর বিপরীতে প্রকৌশল এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয়গুলোয় আগ্রহ বাড়ছে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত কয়েক বছরে দেশে বিবিএ ডিগ্রিধারী বেরিয়েছে চাকরি বাজারের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। ফলে তাদের বড় অংশই কর্মসংস্থানের বাইরে থেকে গেছেন। এ জন্য শিক্ষার্থীরা এখন বিবিএ পড়তে আগ্রহী হচ্ছেন না।

জানা যায়, ১৯৯২ সালের দিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিকাশ ঘটে বিবিএ ডিগ্রির ওপর ভর করে। তখন বেসরকারি ব্যাংক, বীমা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফলে বিবিএ স্নাতকদের কদরও বাড়ে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চালু হয় বিবিএ প্রোগ্রামএরপর থেকে প্রতি বছরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে লক্ষাধিক বিবিএ স্নাতক বের হচ্ছে।

তবে কয়েক বছর ধরে আর্থিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে। নতুন শিল্পোদ্যোগ না থাকায় কর্মসংস্থানও আর সেভাবে তৈরি হচ্ছে না। ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিবিএ প্রোগ্রামে ভর্তি সংখ্যাও কমছে। বিপরীতে প্রকৌশল-সংশ্লিষ্ট শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেড়েছে।

পরিসংখ্যান মতে, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিবিএ ডিগ্রিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে কয়েক বছর ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৬৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৩ সালে বিবিএ ডিগ্রিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থী ছিল এক লাখ ৩৪ হাজার ১১২ জন। অথচ ২০১৯ সালে দেশের ৯৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ের শিক্ষার্থী কমে ৮৭ হাজার ৬৯৫ জনে দাঁড়িয়েছে। ছয় বছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থী কমেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ।

অপরদিকে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোয় শিক্ষার্থী অনেক বেড়েছে। ২০১৩ সালে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ বিষয়গুলোয় শিক্ষার্থী ছিল এক লাখ চার হাজার ৬০৪ জন। ২০১৯ সালে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৬৭ হাজার ৮৯১ জনে। ছয় বছরে এসব বিষয়ে শিক্ষার্থী বেড়েছে ৬০ শতাংশেরও বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই)।

এ বিষয়ে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটা অংকের অর্থ ব্যয় করে পড়ালেখা করে শিক্ষার্থীরা। এজন্য তারা বিষয় নির্বাচনে খুব সতর্ক। চাকরির বাজারে চাহিদা থাকায় আগে অনেকে বিবিএ পছন্দ করতো। এখন বিবিএ গ্র্যাজুয়েটদের সুযোগ কমেছে, স্বাভাবিকভাবেই পড়ার আগ্রহও কমবে। অন্যদিকে অটোমেশনের জন্য প্রকৌশল ও কারিগরি সাবজেক্টগুলোর চাহিদা বাড়ছে। সেজন্য শিক্ষার্থীরা সিএসই, ইইই, মেকানিক্যালের মতো বিষয়গুলো পড়ছে। বৈশ্বিক চাকরির বাজারেও এর চাহিদা বাড়ছে।

বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) প্রেসিডেন্ট কামরান টি রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, বেসরকারি খাতে একসময় প্রচুর বিবিএ গ্র্যাজুয়েটের কর্মসংস্থান হয়। তা দেখে বিবিএ ডিগ্রি নিতে শুরু করে অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি করে। তবে কর্মবাজারে আগের মতো বিবিএ’র চাহিদা নেই। অনেক শিক্ষার্থী বিবিএ ডিগ্রি নিয়েও চাকরি পাচ্ছেন না। এজন্যই হয়তো শিক্ষার্থীরা আর আগের মতো আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথের ভিত্তি গড়ে ওঠে বিবিএ প্রোগ্রামে নির্ভর করে। আগে বিশ্ববিদ্যালয়টির মোট শিক্ষার্থীর ৭০-৮০ শতাংশই বিজনেস স্কুলের ছিল। তা এখন কমে ৫০ শতাংশের নিচে রয়েছে। ২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ব্যবসায় শিক্ষার মোট শিক্ষার্থী ছিল ১২ হাজার ৮৯৬ জন। আর ২০১৯ সালে সে সংখ্যা নেমে ১০ হাজার ২১৫ জনে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছয় বছরে শিক্ষার্থী কমেছে দুই হাজার ৬৮১ জন। একইভাবে ব্র্যাক, এআইইউবি, ইস্ট ওয়েস্ট, আইআইইউসি, আইইউবি, ইউআইইউ, এশিয়া প্যাসিফিক, আইইউবিএটি, স্টামফোর্ড, নর্দানসহ বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় শিক্ষার বিষয়গুলোয় শিক্ষার্থী কমেছে।

এ বিষয়ে নর্থ সাউথের স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকসের ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল হান্নান চৌধুরী বলেন, নর্থ সাউথে বিবিএর শিক্ষার্থী কমলেও সে হার বেশি নয়। দু-একটি ছাড়া প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থী কমেছে। এর অন্যতম কারণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলো বিকম ডিগ্রির নাম পরিবর্তন করে বিবিএ রেখেছে। অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানভেদে ডিগ্রির মানের পার্থক্য বুঝতে পারে না।

এদিকে প্রকৌশলের শিক্ষার্থী বৃদ্ধিরতে বেশি সাফল্য দেখিয়েছে বেসরকারি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৩ সালে  প্রতিষ্ঠানটিতে প্রকৌশল বিষয়ে শিক্ষার্থী ছিল এক হাজার ২০২ জন। আর ২০১৯ সালে এসে তা দাঁড়ায় ছয় হাজার ৮২৬ জনে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক মিজানুর রহমান রাজু বলেন, ‘আমাদের এখানে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হওয়ার পরপরই ল্যাপটপ পায়। পাশাপাশি বিশ্বমানের ল্যাব সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। এখান থেকে বের হয়ে কেউ আর বেকার থাকছে না। এ কারণেই ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশেষ করে ইইই, সিএসই, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয়গুলোর জনপ্রিয়তা বেশি বলে জানান তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ