নবায়নযোগ্য জ্বালানি গবেষণার বাতিঘর ইউআইইউ’র সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ
- খাঁন মুহাম্মদ মামুন
- প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৪, ১০:২১ PM , আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২৪, ০৭:৪২ AM
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য এবং টেকসই জ্বালানি শক্তি নিয়ে অধিকতর গবেষণা, এর ব্যবহার, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নে উত্তরোত্তর এগিয়ে যাচ্ছে সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ বা জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্র (সিইআর)। দেশের অন্যতম বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (ইউআইইউ) এ বিশেষায়িত ল্যাবটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে। মূলত এরপর থেকেই দেশে নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্র পরীক্ষা এবং অধিকতর গবেষণার পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন জ্বালানি পরিকল্পনা এবং নীতিমালা প্রণয়নে সরাসরি পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে ইউআইইউ’র সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, প্রচলিত ধারার জ্বালানির বিকল্প এবং পরিবেশবান্ধব, টেকসই নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাব্যতা এবং বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় আলোর মশাল হাতে সবসময়ই অগ্রগামী ছিল ইউআইইউ’র এ জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্রটি। আগামী দিনগুলোতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
জামালপুরের সরিষাবাড়িতে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ডিজাইন করে সিইআর। ছবি: সৌজন্যে প্রাপ্ত।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে গত দেড় থেকে দুই দশক আগেও বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ছিল মাত্র ৪৫ শতাংশ মানুষ। সরকারের নানামুখী উদ্যোগে সেটি বর্তমানে শতভাগের কোটায় পৌঁছেছে। এরপর নানা আর্থ-সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে সরকারের সোলার প্যানেল স্থাপন, বায়ু ও জলবিদ্যুৎসহ নানা উদ্যোগে আলোর মুখ দেখে দেশের শতভাগ মানুষ। শুরু থেকেই সরকারের এসব প্রকল্পে নীতি-নির্ধারণী এবং পরামর্শক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল ইউআইইউ’র সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ (সিইআর)।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে নবায়নযোগ্য এবং টেকসই জ্বালানি কাঠামো নিয়ে এখন পর্যন্ত ২০০টিরও অধিক গবেষণা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সিইআর। আর এসব কাজ শুরু থেকেই দক্ষ হাতে সামনে এগিয়ে নিয়েছেন ইউআইইউর সেন্টার ফর এনার্জির রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে চাকুরিকালীন বিদেশে উচ্চশিক্ষা এবং সেখান থেকে ফিরে পুরোদস্তুর গবেষণা এবং দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত নিয়ে কাজ শুরু করেন এই স্বপ্নদ্রষ্টা।
আরও পড়ুন: এমআইটি-হার্ভার্ডের মতো গবেষণাগারের সুযোগ ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে
শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী বলছেন, যখন ২০০৭ এর দিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা সৌরশক্তি নিয়ে কথা হয়, তখন এটি খুব বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তবে সময়ের সাথে সাথে দেশের এ পরিস্থিতি বদলেছে। সবাই এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়ে সচেতন এবং এটি নিয়ে কাজ করতেও আগ্রহী। শুরু থেকেই নানা চ্যালেঞ্জ ছিল এবং সামনেও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে জানিয়ে এই গবেষকের অভিমত, দেশের জ্বালানি ব্যবস্থাকে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব করতে আমাদের আরও বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং টেকসই পরিবেশবান্ধব জ্বালানি নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ২ হাজারের বেশি প্রকৌশলী ও শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে সিইআর। নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক সোলার প্রযুক্তির ওপর এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর আগে বিগত ২০১০ সালে যখন সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ চালু হয়, তখন এ প্রকল্পে অর্থায়ন করে বিশ্বব্যাংক। ইউআইইউ’র তৎকালীন ধানমন্ডির ক্যাম্পাসে চালু হওয়া সম্পূর্ণ সৌর জ্বালানিনির্ভর এ ল্যাবটিতে দেশের জ্বালানি ব্যবস্থাপনা, নীতিমালা গঠন এবং এর যথাযোগ্য ব্যবহারের উপায় নিয়ে গবেষণায় অর্থায়ন করে এ আর্থিক সহায়তা প্রতিষ্ঠানটি।
রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ে স্থাপিত দৃষ্টিনন্দন সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ডিজাইনও করে সিইআর। ছবি: সৌজন্যে প্রাপ্ত।
এছাড়া বর্তমান সরকারের নবায়নযোগ্য শক্তি বিষয়ক বেশকিছু নীতিমালা প্রণয়নেও যুক্ত ছিল সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ। ল্যাবটির হাত ধরেই ২০১৭ সালে সূর্যের আলো থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রথমবারের মতো যুক্ত হয় বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডে। এ প্রকল্পটি জামালপুর জেলার সরিষাবাড়িতে পিডিবি প্রাঙ্গণে আট একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠে। সূর্যের আলো থাকলে বর্তমানে এ প্ল্যান্ট থেকে ৩ দশমিক ২৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হয় জাতীয় গ্রিডে। বিশাল এ সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ডিজাইন করা হয়েছে সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ ল্যাবে।
ইউআইইউ’র সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ ল্যাবের হাত ধরেই বাস্তব রূপ পায় বাংলাদেশের প্রায় বেশিরভাগ সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় সকল মিনি-গ্রিড সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, কাপ্তাই সোলার প্যানেলভিত্তিক প্রকল্প অন্যতম। সংশ্লিষ্টদের মত, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে কাজের ধারা শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ রাখেনি সিইআর, দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির এই ‘পাওয়ার হাউস’ আলো জ্বালিয়েছে নাইজেরিয়া, কেনিয়াসহ কয়েকটি দেশের সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রেও। কাজ করছে তাদের পরামর্শক হিসেবে।
আরও পড়ুন: পরিশ্রম ও শৃঙ্খলাময় পড়াশোনায় সোনা মোড়ানো সাফল্য তাদের
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ (সিইআর) ল্যাবের অর্জনের পাল্লাও কম ভারি নয়। দেশে এবং দেশের বাইরে নানা সময়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দেশি-বিদেশি সম্মানজনক পুরস্কার অর্জন করেছে সিইআর। এর মধ্যে ‘পিয়ার-টু-পিয়ার স্মার্ট ভিলেজ গ্রিড’ প্রকল্পটি ২০১৬ সালে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পায়। মরক্কোতে সংস্থাটির ২২তম জলবায়ু সম্মেলনে ‘ইউএন মোমেন্টাম ফর চেঞ্জ’ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। সাধারণত ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য যেসব প্রযুক্তিকে আলোকবর্তিকা হিসেবে বিবেচনা করা হয় বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে তাদেরই এমন পুরস্কারে ভূষিত করে জাতিসংঘ।
এছাড়াও একই বছরে ‘পিয়ার-টু-পিয়ার স্মার্ট ভিলেজ গ্রিড’ প্রকল্পটি ‘ইন্টারসোলার অ্যাওয়ার্ড ২০১৬’ জয় করার মধ্য দিয়ে জার্মানির মিউনিখ থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সবচেয়ে সম্মানজনক অর্জন ঘরে তোলে সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ (সিইআর)। একই বছরে বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘অদম্য বাংলাদেশ পুরস্কার আসে সিইআরের ‘স্মার্ট সোলার ইরিগেশন সিস্টেম’—শীর্ষক প্রকল্পে। ছোট বড় সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত মোট ১৩টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে সিইআর।
দেশের শেষ সীমানা পঞ্চগড়েরর তেতুলিয়ায় সৌর বিদ্যুৎ পৌঁছেছে সিইআরের হাত ধরে। ছবি: সৌজন্যে প্রাপ্ত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে ‘ডিমান্ড রেসপন্স অ্যানাবলড স্মার্ট গ্রিড’—নামে একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন সিইআরের গবেষকরা। তাদের এ উদ্ভাবনী প্রকল্প স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের লোড ব্যবস্থাপনা এবং বিদ্যুৎ চুরির বার্তা পাঠাতে পারবে সেবাদাতার কাছে। মোবাইলের মাধ্যমে গ্রাহকের বৈদ্যুতিক সেবার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে—এমন ধারণার এ প্রযুক্তিভিত্তিক এ প্রকল্প গবেষণার জন্য প্রায় ৪ কোটি টাকার গবেষণা অনুদান পেয়েছে সরকারের বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কেন্দ্র থেকে।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস কথা বলে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চের (সিইআর) পরিচালক অধ্যাপক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরীর সাথে। তিনি বলেন, আমরা দেশের মোট ২৫টি চরাঞ্চলে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সোলার মিনি-গ্রিড ডিজাইন করেছি। প্রত্যন্ত এসব অঞ্চলের মানুষের কাছে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছানোর কারণে তাদের জীবন ধারণাই পরিবর্তন হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন: ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জে যেভাবে শ্রেষ্ঠত্বের জয়মালা বুঁনলো ইউআইইউ
নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে শুরুর দিকে উপলব্ধি জানতে চাইলে তিনি বলেন, পিডিবিতে থাকার সময় উপলব্ধি করেছিলাম, প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়া আমাদের নিজস্ব অন্য কোনো জ্বালানির সম্ভার নেই। প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডারও ক্রমশ কমতির পথে। ফলে নবায়নযোগ্য শক্তিই যে আমাদের ভবিষ্যৎ হতে যাচ্ছে—তা নিয়ে সন্দেহ ছিল না। পৃথিবীর তাপমাত্রা নিরাপদ মাত্রায় রাখতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে রেখে যেতে হলে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার ছাড়া উপায় নেই। এই চিন্তা থেকেই কাজ শুরু হয় এবং চলমান রয়েছে।
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে সৌরশক্তির প্রাপ্যতা সবচেয়ে বেশি। যত বিষুবরেখার দিকে যাবেন সূর্যের কিরণ তত খাড়াভাবে পড়বে। সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অনেকটা জায়গা লাগে। এই কাজে কৃষিজমি ব্যবহার না করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যেমনটা রয়েছে কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রেও। আমাদের দেশে পতিত বা অনাবাদি জমি তুলনামূলক উত্তরাঞ্চল, নদীর তীরবর্তী চর ও সাগরের মোহনা এলাকায় বেশি। তাই এসব অঞ্চলে বড় আকারের সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের পরিকল্পনা হচ্ছে। নেট মিটারিংয়ের আওতায় বাংলাদেশে রুফটপ সৌর বিদ্যুতেরও একটি বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের গবেষণা বাড়ানোর পাশাপাশি সচেতনতা এবং উদ্যম বাড়াতে হবে। তবেই আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত থেকে সর্বোচ্চ সুফল লাভ করতে পারবো—জানান সিইআর পরিচালক।