ওয়েবসাইট খুলে সার্টিফিকেট বিক্রি করছে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি

প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি কার্যক্রম চালালেও ইউজিসি বা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেই
প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি কার্যক্রম চালালেও ইউজিসি বা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেই  © ওয়েবসাইট

নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদন। কোর্স ও প্রোগ্রাম-পাঠ্য বিষয়েরও অনুমোদনের কোনো বালাই নেই। তবুও শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি দিচ্ছে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি। নামসর্বস্ব এ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব কেবল ওয়েবসাইটেই সীমাবদ্ধ।

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেশ কয়েকজন শিক্ষক প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি  অব টেকনোলজির সনদ দিয়ে এমপিওভুক্তির আবেদন করেন। তবে তাদের আবেদন বাতিল করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করেছে সরকারের আরেক সংস্থা পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। অনুসন্ধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অস্তিত্ব পায়নি ডিআইএ।

এ বিষয়ে ডিআইএ’র পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ্ মো. আজমতগীর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, একাধিক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি নামক প্রতিষ্ঠানের সনদ দিয়ে এমপিওভুক্তির আবেদন করেছিলেন। তবে এ নামে কোনো ইউনিভার্সিটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ প্রতিষ্ঠানের সনদ দিয়ে এমপিওভুক্তির সুযোগ নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তদারক সংস্থা ইউজিসি বলছে, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি নামে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নেই। যাদের অনুমোদন রয়েছে তাদের নাম ইউজিসির ওয়েবসাইটে দেওয়া রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে সবকিছু যাচাই করে ভর্তি হওয়ার তাগাদা দিয়েছেন তারা।

আমাদের ইউজিসির অনুমোদনের দরকার নেই। ভারত, মালয়েশিয়ার অনুমোদন রয়েছে। আমরা স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। এছাড়া আমাদের সরকারের অনুমোদন রয়েছে—ডা. সাইদুর রহমান ওরফে এন এম হক, সনদ বাণিজ্যের মূল হোতা

এ বিষয়ে ইউজিসি সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি নামে কোনো ইউনিভার্সিটির অস্তিত্ব নেই। এটি একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান। এদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। যারা এ ভুয়া প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’

জানা গেছে, প্রায় দুই যুগ ধরে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সনদ বাণিজ্য করে আসছে। প্রতারণার কাজ ভালোভাবে চালিয়ে নিতে তারা ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করেছে। এছাড়া নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে বিভিন্ন পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করে। নিজেদের পক্ষে যুক্তি দেখাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভুয়া আদেশ ও হাইকোর্টের জাল রিট প্রদর্শন করে।

২০২২ সালে ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হন প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ছয়জন

প্রতিষ্ঠানটি এমবিবিএস, বিডিএস, এমফিল, পিএইচডি, ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাডভোকেটশিপসহ ১৪৪টি বিষয়ের ওপরে অসংখ্য ভুয়া সার্টিফিকেট দেওয়ার নামে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ভুয়া সনদ বিক্রির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সেসময় জেলও হয়েছিল তাদের।

‘দেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করতে হলে অবশ্যই ইউজিসির অনুমোদন নিতে হবে। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নেই আর কোনটির অনুমোদন রয়েছে তা আমাদের (ইউজিসি) ওয়েবসাইটে রয়েছে। এ ধরনের ভুয়া প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে’—অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর, চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব), ইউজিসি

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি পূর্বে রাজধানীর মালিবাগের প্যারামাউন্ট টাওয়ারে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করত। তবে বর্তমানে খিলক্ষেত বাজারের একতা প্লাজায় নিজেদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। ভর্তির জন্য ওয়েবসাইটে একাধিক নম্বরও দেওয়া রয়েছে। সে নম্বরে যোগাযোগ করা হলে ডিসেম্বর মাস থেকে শিক্ষার্থীদের ভর্তির আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে।

সূত্র জানায়, ভুয়া সার্টিফিকেট দেওয়ার অভিযোগে 'প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি'র ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। শুধু প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিই নয়; 'পিচ ব্লেন্ড ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি' ও 'পিস ল্যান্ড ইউনিভার্সিটি' নামে আরও দুটি ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বিক্রি করত চক্রটি। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য ছিলেন ডা. মো. সাইদুর রহমান। চক্রটির মূলহোতা তিনি নিজেই।

সনদ বাণিজ্য চালাতে ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি

সূত্র আরও জানায়, ২০২২ সালে ডিবির অভিযানে ডা. মো. সাইদুর রহমান ছাড়াও ভুয়া সনদ বিক্রির অভিযোগে—নুরুল হক সরকার ওরফে শেখ মনি সরকার, মোয়াজ্জেম হোসেন, ডা. মো. সাইদুর রহমান ওরফে নজরুল, মাহফুজুর রহমান মাহফুজ, ডা. মো. আমান উল্লাহ ও দেবাশীষ কুণ্ডু নামে আরও পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

জামিনে মুক্তি পেয়ে ডা. সাইদুর রহমান নিজের নাম পরিবর্তন করে বর্তমানে নিজেকে অধ্যাপক এন এম হক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। চক্রটি আবারও একই ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে অভিযোগ এসেছে।

ওয়েবসাইট নির্ভর প্রতিষ্ঠানটির দাবি, তারা ইউজিসির আইনের ওপর নির্ভরশীল নয়। ভারতসহ কয়েকটি দেশের অনুমোদন রয়েছে তাদের। এ অনুমোদনের দ্বারা তারা নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তাদের নিবন্ধনও রয়েছে। তারা ১৮৬০ সালের ২১ ধারা মোতাবেক সোসাইটি আইন ১৯৭৯ এর মাধ্যমে পরিচালিত। কারা এখান থেকে সনদ নিয়েছে, আর কারা নেয়নি সে তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে রয়েছে। 

এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান পরিচয়দানকারী এন এম হক ওরফে ডা. সাইদুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কিছু সমস্যার কারণে আমাদের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। আগামী সপ্তাহে আমরা আবার আমাদের কার্যক্রম শুরু করব। শিক্ষার্থী ভর্তিসহ যাবতীয় বিষয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে।

ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া কীভাবে সনদ দিচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের ইউজিসির অনুমোদনের দরকার নেই। ভারত, মালয়েশিয়ার অনুমোদন রয়েছে। আমরা স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। এছাড়া আমাদের সরকারের অনুমোদন রয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘দেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করতে হলে অবশ্যই ইউজিসির অনুমোদন নিতে হবে। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নেই, আর কোনটির অনুমোদন রয়েছে- তা আমাদের (ইউজিসি) ওয়েবসাইটে রয়েছে। এ ধরনের ভুয়া প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে।’


সর্বশেষ সংবাদ