বর্ণাঢ্য ক্রিকেট ক্যারিয়ারে একের পর এক সাফল্য ছিল ওয়ার্নের
- টিডিসি স্পোর্টস
- প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২২, ০৯:০৩ PM , আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২২, ০৯:১৩ PM
অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি ক্রিকেটার শেন ওয়ার্ন মারা গেছেন। ৫২ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। ফক্স ক্রিকেট জানিয়েছে, ওয়ার্নের ম্যানেজমেন্ট সংস্থা অস্ট্রেলিয়া সময় শনিবার জানায়, থাইল্যান্ডে মারা গেছেন ওয়ার্ন। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শেনকে অচেতন অবস্থায় তাঁর ভিলায় পাওয়া গেছে। মেডিকেল স্টাফের সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। পরিবার এ সময়ে গোপনীয়তা রক্ষার অনুরোধ জানিয়েছে। বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
সম্প্রতি তাইল্যান্ডে নিজের বাংলোয় গিয়ে থাকছিলেন তিনি। সেখানেই হৃদরোগে আক্রান্ত হন ওয়ার্ন। ওয়ার্নের জন্ম ১৯৬৯ সালে। টেস্ট ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার মুরলিধরনের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট টেকার। আইপিএলের প্রথম জয়ী দল রাজস্থান রয়্যালসের অধিনায়ক ছিলেন শেন।
অস্ট্রেলিয়া তথা বিশ্বের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের মধ্যে একেবারে সর্বোচ্চ সারিতে শেন ওয়ার্নের নাম থাকবেই। ১৪৫টি টেস্ট ৭০৮ উইকেট নেওয়া ওয়ার্ন, লাল বলের ক্রিকেট ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক। ১৯৪টি ওয়ানে ডেতে ২৯৩টি উইকেটও রয়েছে তাঁর দখলে। সম্প্রতি অ্যাসেজেও তাঁকে ধারাভাষ্য দিতে দেখা গিয়েছে। ওয়ার্নের আকস্মিক এই মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ গোটা ক্রিকেটবিশ্ব।
আরও পড়ুন: মারা গেছেন শেন ওয়ার্ন
ক্রিকেটের শুরু
১৯৯১ সালের মেলবোর্ন শহরের জংশন ওভালে ভিক্টোরিয়ার হয়ে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া বিপক্ষে শুরু হয় নিজের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ক্যারিয়ার। সে ম্যাচে ভিক্টোরিয়ার হয়ে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১ম ইনিংসে ১১ রানে ০ উইকেট ও ২য় ইনিংসে ৪৪ রানে ১ উইকেট দিয়ে শুরু হয় যাত্রা। তবে এর আগে তিনি ক্রিকেটের পাশাপাশি খেলেছেন ফুটবলও।
ক্রিকেটে শুরুটা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৮৩ সালে। ১৯৮৭ সালে সেন্ট কিল্টা দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়ান নিয়ম অনুসারে ফুটবল দলে যোগ দেন। ১৯৮৮ তে সেন্ট কিল্টো অনু-১৯ দলের হয়ে ফুটবল খেলেন পরে তিনি ক্রিকেটে পুরোপুরি ক্রিকেটে মনোযোগী হন।
১৯৯০ সালে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট একাডেমীতে প্রশিক্ষনের জন্য পাঠানো হলে পরের বছরই ইংলিশ ক্লাব অ্যাক্রিংটন ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে বল হাতে ১৫.৩১ গড়ে ৩ উইকেট নিয়েছিলেন আর ব্যাট হাট হাতে ১৫ গড়ে ৩৩০ রান করেছিলেন। ১৯৯১ সালে হারারে স্পোর্টস ক্লাবে অস্ট্রেলিয়া বি দলের হয়ে ১ম ইনিংসে ৫ উইকেট বা তার বেশি উইকেট নেয়ার দখল করেন। পরে আর সেভাবে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার
বল হাতে তার তরুপের তাস লেগ স্পিনে ব্যবহার করে জিতেছেন নানা নিশানা বোকা বানিয়েছেন বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদেরকে। আব্দুল কাদিরের পর ক্রিকেট বিশ্বে লেগ স্পিনে আলো ছড়ানো বোলারদের মাঝে শেন ওয়ার্ন নিঃসন্দেহে সেরা। ক্রিকেট এই মহাতারকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় ১৯৯২ সালের ২ রা জানুয়ারীতে। অস্ট্রেলিয়ার ৩৫০তম টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে নিজের প্রথম টেস্ট খেলতে নামেন শেন ওয়ার্ন।
যতটা প্রত্যাশার বারুদ নিয়ে তাকে ভারতের সাথে অভিষেক করানো হয়েছিলো তাঁর ছিঁটে ফোঁটাও অভিষেক ম্যাচে মিটাতে পারেনি। নিজের অভিষেক ম্যাচে মাত্র একটি ইনিংসেই তিনি বল করার সুশোগ পেয়েছিলেন যেখানে কি না ১৫০ রান দিয়েন নেন ১ উইকেট।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ১ম উইকেট হিসেবে ২০৬ রান করা রবি শাস্ত্রীকে ফেরান। অভিষেক ম্যাচে আলো ছড়াতে না পারলেও সময়ের বিবর্তনে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে রাজত্ব করে গেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকের পরের বছরই ২৪ শে মার্চ ১৯৯৩ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তার অভিষেক হয়। তারপর থেকে নিজের পারফরম্যান্সের জন্য কখনো পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
বল হাতে জাদুকর
লেগস্পিনের জাদুকর হিসেবে ক্রিকেট মহারথে বেশ পরিচিত। বল হাতে তাঁর জাদুর শৈল্পিকতা স্মৃতির পাতায় বাধিঁয়ে রাখার মত যেখানে শুধুই সাফল্যের রুপকথা। সেই ১৯৯২ সালে অভিষেক আর ২০০৭ সালে বিদায়ের আগ পর্যন্ত সৃষ্টি করেছেন নানা রুপকথা। ১৯৯২ সালে টেস্টে অভিষেকটা দারুন না হলেও পরে আলো ছড়িয়েছেন নিজের মত করে।
টেস্টে খেলেছেন ১৪৫ ম্যাচের ২৭৩ ইনিংসে বল করার সুযোগ হয়েছিলো তার। ২৭৩ ইনিংসে ৪০৭০৫টি বল করে ১৭৯৯৫টি রান দিয়ে ২৫.৪১ গড়ে নেন ৭০৮টি উইকেট। ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ বোলিং ফিগার এক ইনিংসে ৭১ রানে ৮ উইকেট আর এক ম্যাচে নেন ১২৮ রানে ১২ উইকেট।
ক্যারিয়ারে ১০ উইকেট নেন ১০ বার, ৫ উইকেট নেন ৩৭ বার আর ৪ উইকেট করে নেন ৪৮ বার। ওয়ানডে তে ১৯৪ ম্যাচের ১৯১ ইনিংসে ১০৬৪২টি বল করে ৭৫৪১ রান দিয়ে ২৫.৭৩ গড়ে ও ৪.২৫ ইকনোমিতে নেন ২৯৩ উইকেট। সর্বোচ্চ বোলিং ফিগার ৩৩ রানে ৫ উইকেট আর ৫ উইকেট নেন ১ বার ৪ উইকেট নেন ১২ বার।
ব্যাট হাতে ওয়ার্ন
একজন জেনুইন লেগস্পিনার হিসেবেই অজি দলে তার অন্তর্ভুক্তি তবে দলের প্রয়োজনে লোয়ার অর্ডারে ব্যাট হাতেও মোটামুটি ভালোই সামলাতে পারতেন তিনি। টেস্ট ক্রিকেটে তার ব্যাটটা যেন একটু বেশিই সাবলীল। ১৪৫ ম্যাচের ১৯৯ ইনিংসে ব্যাট করে ৫৪৭০টি বল মোকাবেলা করে ১৭.৩২ গড়ে করেন ৩১৫৪ রান। টেস্ট ক্যারিয়ারে শতক না থাকলেও রয়েছে ১২টি হাফ-সেঞ্চুরি।
তার ব্যাট থেকে আসে সর্বোচ্চ ৯৯ রাবের একটি ইনিংস সাথে চাররে মার ছিলো ৩৫৩টি আর ছয়ের মার ছিলো ৩৭টি। ক্যারিয়ারে ওয়ানডে খেলেছেন ১৯৪টি ম্যাচ যেখানে ব্যাট করার সুযোগ হয়েছিলো ১০৭ ম্যাচে। ১০৭ ম্যাচে ১৪১৩ বল মোকাবেলা করে তার সংগ্রহ ১০১৮ রান। ফিফটি রয়োছে একটি, সর্বোচ্চ স্কোর ৫৫ সাথে চার মেরেছেন ৬০টি আর ছক্কা মেরেছেন ১৩টি।
অর্জন
১৬ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে অর্জন করেছেন অনেক কিছুই ছুঁয়েছেন নানাবিধ রেকর্ড। দেখে নেয়া যাক তাঁর কিছু অর্জন: ১. ১৯৯৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলের অন্যতম সদস্য ২. ১ম ৬০০ উইকেট নেয়া বোলার। ৩. ১ম ৭০০ উইকেট নেয়া বোলার। ৪. সেমিফাইনাল ও ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় ৪. অ্যাশেজে মাইক গ্যাটিংকে করা বল টা বল অফ দ্যা সেঞ্চুরি হিসেবে স্বীকৃতি। ৫. ১৯৯৪ সালে উইজডনের সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন ৬. ১৯৯৭ সালে জাতীয় পুরষ্কার জিতেন ৭. ২০০৪ সালে এক বছরে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেন।
‘বল অব দ্য সেঞ্চুরি’
১৯৯৩ সালে ওল্ড ট্রাফোর্ডে অনুষ্ঠিত অ্যাশেজ সিরিজে স্পিন বিশেষজ্ঞ ইংলিশ ব্যাটসম্যান মাইক গ্যাটিংকে যখন বোল্ড করে দিলেন শেন ওয়ার্ন, তখন তার ঝুলিতে ছিল মাত্র ১১ টেস্ট ম্যাচের অভিজ্ঞতা। ওই বলের ভিডিও আজও বিস্ময় জাগায়। অবিশ্বাস্য লেগব্রেক, হুট করেই লেগ স্ট্যাম্প থেকে বল অসম্ভব বাঁক নিয়ে মাইক গ্যাটিংকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করে অফ স্ট্যাম্পের বেল ফেলে দিলে মাঠে উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে যান।
বেচারা গ্যাটিং তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না কি করে এটা হলো। কারণ, তিনি ভেবেছিলেন লেগ স্ট্যাম্পের বেশ বাইরের একটা বল ছেড়ে দেওয়াই স্বাভাবিক খেলা। কিন্তু তরুণ এক লেগ স্পিনারের কীর্তি তার স্বাভাবিক খেলাকেও পরাস্ত করে দিলো। ওই একটা বলই সারাবিশ্বে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলে ওয়ার্নকে। ক্রিকেটে ফাস্ট বোলারদের স্বর্ণযুগে স্পিন আধিপত্যের প্রথম উদ্যোক্তা বলা হয় তাকেই। তার এক বলেই ক্রিকেটের ইতিহাসের পাতা উল্টে যায়।
এবার শেন ওয়ার্ন সম্পর্কে সাতটি অজানা তথ্য জেনে নেওয়া যাক
১. শেন ওয়ার্ন যখন প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলতে নামেন তখন তার ওজন ছিল ৯৭ কেজি!
২. তার একটা চোখ সবুজ, একটা চোখ নীল। এমনটা হওয়ার কারণ ‘হেটেরোক্রমিয়া’ নামক একটি রোগ।
৩. সাবেক স্ত্রী সিমোনে কালাহানের ঘরে তার তিন সন্তান- ব্রুক, সামার ও জ্যাকসন।
৪. অবসর নেওয়ার পর অসুস্থ ও অবহেলিত শিশুদের জন্য সেবামূলক কাজে যুক্ত হন তিনি।
৫. অভিনেত্রী এলিজাবেথ হার্লির সঙ্গে ২০১১ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন এই লেগ স্পিনার। কিন্তু ২০১৩ সালেই তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
৬. ১৯৯৫ সালে এক জুয়াড়ির কাছে পিচের তথ্য প্রকাশ করায় বোর্ড কর্তৃক জরিমানার মুখে পড়েন তিনি।
৭. ধূমপান ছাড়ার জন্য অজি ক্রিকেট বোর্ড তাকে একবার আলাদা খরচ দিয়েছিল। একসময় সিগারেট ছাড়া থাকতেই পারতেন না ওয়ার্ন।
আরও পড়ুন: স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ফুল-ফ্রি স্কলারশিপ দিচ্ছে অস্ট্রেলিয়া
বিতর্ক
ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তার সাফল্যের জন্য যেমন বেশ পরিচিত আর সম্মানিত তেমনি তার বিতর্কিত ইস্যুতেও বেশ আলোচিত । সবসময়ই কিছু না কিছুতে আলোচনায় আসতেন শেন ওয়ার্ন কখনো বান্ধুবী,কখনো নেশা,ক্যাসিনো এসবে। তিনি ধুমপানে খুবই আসক্ত ছিলো যেকারনে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তাকা আলাদা টাকা দিতো নেশা ছাড়ার জন্য তবুও তিনি ছাড়তে পারেন নি। ২০০৩ সালে বিশ্বকাপের আগে ডোপ টেস্টের ফল পজেটিভ হওয়ায় বিশ্বকাপে খেলতে পারেননি।
এছাড়াও নানাবিধ বিতর্কে বিতর্কিত ছিলেন শেন ওয়ার্ন। ২০০৭ সালে অ্যাশেজ দিয়ে ক্যারিয়ারের ইতি টানেন শেন ওয়ার্ন। ক্যারিয়ারে অনেকবার সমালোচিত হলেও তাঁর ক্রিকেট কীর্তির জন্য তিনি সারা জীবন প্রশংসনীয়। পাকিস্তানের লেগ স্পিনার আব্দুল কাদিরের পর ক্রিকেট বিশ্বে আলো ছড়ানোর মাঝে বিখ্যাত একজন তবে সর্বকালের সেরা লেগস্পিনার বললেও হয়তো ভুল হবে না।
ক্রিকেটে তার যখন আসা তখন চলছিলো পেসারদের আধিপত্য তার মাঝেও নিজেকে গড়ে তুলেছেন বিশ্বসেরা বোলারে। পেস বোলিংয়ের দেশে একজন শেন ওয়ার্নের জন্ম সত্যিই অবাক করার মত। ক্রিকেটের মহারথ থেমে গেলেও হাজার বছর পরও হাজারও লেগস্পিনার স্বপ্ন বুনবেন একজন শেন ওয়ার্ন হওয়ার।