বাংলার ছাত্রী শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম  © সংগৃহীত

বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশ শতকের ষাটের দশক ছিল উত্তাল এক সময়। পাকিস্তানে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে পঞ্চাশ দশকের শেষ দিকে। ষাটের দশকজুড়ে জেনারেল আইয়ুব খানের একনায়কত্বে চলতে থাকে ফ্যাসিস্ট সামরিক শাসন। পূর্ব বাংলাকে দাবিয়ে রাখার জন্য ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে গৃহীত সংবিধান এবং সাধারণ নির্বাচন বাতিল করা হয়, যাতে বাঙালিরা পাকিস্তানে ক্ষমতায় যেতে না পারে। ষাটের দশকের শুরুতে জেনারেল আইয়ুব পূর্ব বাংলাকে পদানত রাখার জন্য মোনেম খানকে গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন এবং তিনিও কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করছিলেন। পূর্ব বাংলার সামরিক স্বৈরশাসনবিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের প্রায় সবাইকেই কারাগারে নিক্ষেপ এবং রাজনৈতিক দল ও কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। মৌলিক গণতন্ত্রী বা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানদের ভোটে আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন; পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকদের ভোটাধিকার বাতিল করা হয়।

ষাটের দশকের প্রথমার্ধে ঐ রকম এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা সামরিক স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত করে ছাত্রসমাজ, যার নেতৃত্ব প্রদান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলো। শরিফ কমিশনের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলা ছাত্রসমাজ ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে, যেখানে ছাত্ররা চ্যান্সেলর মোনায়েম খানের হাত থেকে ডিগ্রি নিতে অস্বীকার করে। কনভোকেশন মঞ্চ থেকে হেলমেট মাথায় গভর্নর মোনায়েম খান স্বয়ং পুলিশি অভিযান পরিচালনা করেন ছাত্রদের ওপর। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোনায়েম খান নিযুক্ত ড. মো. ওসমান গনি। ছাত্রসমাজের ওপর দমননীতি যতই বাড়তে থাকে ছাত্র আন্দোলন ততই তীব্র হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনকে অন্য পথে পরিচালনার জন্য ঢাকা এবং অন্যান্য স্থানে বিহারিদের দিয়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো হয়। পূর্ব বাংলার মানুষ তখন শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রুখে দাঁড়ায়। এভাবে ষাটের দশকের প্রথমার্ধজুড়ে একদিকে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসন, অপরদিকে পূর্ব বাংলার মানুষের সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠছিল। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান বারবার গ্রেফতার ও হয়রানি সত্তে¡ও সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামের নেতা রূপে আবির্ভুত হন।

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের ফলে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে সময়টাতে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর ৯০ শতাংশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। পূর্ব বাংলায় মাত্র এক ডিভিশন পদাতিক সৈন্য এবং এক স্কোয়াড্রন জেট জঙ্গি বিমান ছিল, নৌবাহিনী বলতে এখানে কিছুই ছিল না। ১৯৬৬ সালের পটভ‚মিকায় লাহোরে বিরোধী দলের এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তি সনদ ৬-দফা পেশ এবং স্বাধিকার আন্দোলন শুরু করেন। পরিণতিতে শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ এবং প্রতিক্রিয়ায় ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়েছিল।

ষাটের দশকের অপরাধের ঐ প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ বিশেষত আইয়ুব-মোনায়েম-ওসমান গনির পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্র আন্দোলন দমনের জন্য ‘এনএসএফ’ বা ‘ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন’ ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল খুবই উত্তপ্ত। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলছে; প্রতিদিন সংবাদপত্রে শুনানির বিবরণী প্রকাশ পাচ্ছে। সারাদেশ ফুঁসছে, আন্দোলন সামরিক স্বৈরাচার চরম দমননীতির প্রতিক্রিয়ায় সহিংস হয়ে উঠছে, বিশেষত ছাত্র নেতা আসাদ, আগরতলা মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহার নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বাংলায় আগুন জ্বলে ওঠে। পূর্ব বাংলা ’৬৯ সালের আগে কখনো এমন উত্তেজিত, উত্তপ্ত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেনি। সারাদেশ পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচার বিশেষত আইয়ুব-মোনায়েম এবং তার চেলাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড রকম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

ঐ প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি কেমন ছিল তা সহজেই অনুমান করা চলে। ছাত্র-শিক্ষক সবাই পাকিস্তান সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়। এমন এক অশান্ত পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসেন। বাংলা বিভাগে তার ভর্তির ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য যে, বায়ান্নর বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময় যখন মুনীর চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়, তখন শেখ সাহেবও ঢাকা জেলে বন্দি ছিলেন, উভয়ের মধ্যে তখন গভীর সখ্য গড়ে ওঠে। মুনীর ভাই প্রায়ই বলতেন, অকমিউনিস্টদের মধ্যে একমাত্র শেখ মুজিব জেল খাটতে জানেন। জেলখানায় গড়ে ওঠা মুনীর চৌধুরী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্কে কখনো চিড় ধরেনি। ১৯৫৭ সালে মুনীর চৌধুরী ভাষাতত্ত্বে উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান সপরিবারে। সে-সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে তার বিশেষ দূত রূপে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করেন। শেখ সাহেব আমেরিকায় ওয়াশিংটন ডিসিতে বা বড় বড় শহরে তার সফর সীমাবদ্ধ না রেখে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং মুনীর চৌধুরীর বাড়িতে অবস্থান করেন। তিনি তখন মুনীর চৌধুরীকে বলেছিলেন, “স্যুট টাই পরে আর বিদেশি খানা খেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, তোমার বাসায় বসে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরতে পেরে আর ডাল-ভাত খেতে পেরে শান্তি পেলাম। শেখ সাহেব যখন বন্দি এবং বিচারাধীন তখন তার মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে ভিসি ওসমান গনির ভয়ে অনেক বিভাগীয় প্রধানই আতঙ্কিত ছিলেন কিন্তু বাংলা বিভাগে সে সমস্যা ছিল না। এ বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষক তখন শেখ সাহেবের অনুরাগী এবং তাঁর প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সহানুভ‚তিশীল।

শেখ মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনা বাংলা বিভাগের ছাত্রী হলেন কিন্তু আর দশজন ছাত্রছাত্রীর মতোই তার চাল-চলন ছিল। শিক্ষকদের প্রতি তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। নিয়মিত ক্লাস করতেন আবার ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। সাবসিডিয়ারি পরীক্ষায় তিনি যথারীতি উত্তীর্ণ হয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষে নিয়মিত ক্লাস করতে শুরু করলেন।

শেখ সাহেব যখন বন্দি তখন বাংলা বিভাগের ছাত্রী শেখ হাসিনার বিয়ে হয় ফিজিক্সের প্রাক্তন কৃতী ছাত্র ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে। ওয়াজেদ মিয়া ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করতেন এবং ফজলুল হক হলের ভিপি ছিলেন। তিনি যে সময় শেখ সাহেবের বড় মেয়ে শেখ হাসিনাকে বিয়ে করেন তখন দেশের পরিস্থিতি ছিল খুবই অনিশ্চিত, সুতরাং কাজটি যে বেশ সাহসী ছিল তাতে সন্দেহ নেই, কারণ তখন দেশের যা অবস্থা তাতে শেখ সাহেবের পরিবার পরিজনের সঙ্গে কোনো প্রকার সম্পর্ক থাকাটা ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। যা-ই হোক ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে আগরতলা মামলা উঠে গেলে শেখ সাহেব মুক্ত হয়ে বাংলার জনগণের ভালোবাসায় ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠলেন। রাতারাতি পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল। যে ৩২ নম্বরে আগে মানুষ ভয়ে যেত না সেই ৩২ নম্বর হয়ে উঠল লোকে লোকারণ্য। দেশ-বিদেশের অভ্যাগতদের অভ্যর্থনা ও আপ্যায়নের দায়িত্ব পড়ল শেখ হাসিনার ওপর। ৩২ নম্বরের পাশের বাড়িতে সংসার পাতলেও শেখ হাসিনাকে ৩২ নম্বরেই অধিকাংশ সময় কাটাতে হতো, ফলে পড়াশোনা বিঘ্নিত হতে লাগল। তবুও শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা, ক্লাস, টিউটোরিয়াল করা বন্ধ করেননি।

বিশ শতকের ষাটের দশকের অপরাহ্নে পাকিস্তানে যেসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল পাকিস্তানের বেতার ও টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধকরণ, যুক্তি ছিল রবীন্দ্রসংগীত পাকিস্তানের আদর্শবিরোধী। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন পাকিস্তান জাতীয় সংসদে এই ঘোষণা দিলে ঢাকা থেকে আমরা ১৯ জন বুদ্ধিজীবী প্রথম তার প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান করি। আমাদের এই প্রতিবাদের নিন্দা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষক ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনের নেতৃত্বে একটি পাল্টা বিবৃতি দেন। শুরু হয়ে যায় ‘রবীন্দ্র বিতর্ক’। পক্ষে-বিপক্ষে বুদ্ধিজীবী ও লেখক শিল্পীদের সভা, সমাবেশ এবং বিবৃতি। এ সময় রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের তদানীন্তন কর্মকর্তাদের কারসাজিতে ৪০ জন বেতার শিল্পী রবীন্দ্রসংগীতের বিপক্ষে একটি বিবৃতি প্রচার করেন। পরবর্তী সময়ে তারা ‘খাজা শাহাবুদ্দিন ও চল্লিশ চোর’ নামে খ্যাত হয়েছিলেন।

আগরতলা মামলা বন্ধ হয়ে গেলে শেখ সাহেব বিজয়ীর বেশে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। রমনা ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রে জাতির পক্ষ থেকে ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমদ তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভ‚ষিত করেন। বস্তুত আগরতলা মামলার আগে ও পরে শেখ মুজিব ভিন্ন ব্যক্তিত্ব, শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধুতে রূপান্তর এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। বঙ্গবন্ধু আগরতলা মামলার পর দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত মানুষ, সব পথ তখন ৩২ নম্বরের দিকে, দেশ-বিদেশের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকরা তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ছুটে আসছেন। সংবর্ধনার পর সংবর্ধনা চলছে। এর মধ্যে একটি সংবর্ধনার চিঠি পেয়ে আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ি। যেসব শিল্পী রবীন্দ্রসংগীতের বিরোধিতা করে সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়েছিলেন তারা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে বঙ্গবন্ধুর সংবর্ধনার আয়োজন করছেন। আমি বাংলা বিভাগে গিয়ে শেখ হাসিনাকে ডেকে পাঠালাম, বললাম, “আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চাই, তুমি ব্যবস্থা কর।” সেদিনই বাড়ি গিয়ে হাসিনা আমাকে টেলিফোন করলেন যে পরের দিন সকাল ১০টায় ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব আমাকে ৩২ নম্বরে নিয়ে যাবেন, রব আমাদের ছাত্র ছিলেন।

পরদিন যথাসময়ে আ স ম আবদুর রব একটা গাড়ি চালিয়ে এসে আমাকে ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে পৌঁছে দিলেন। এই আমার প্রথম ৩২ নম্বরে যাওয়া, বাড়ি লোকে লোকারণ্য; শেখ হাসিনা আমাকে বঙ্গবন্ধুর বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে সহাস্য বদনে জড়িয়ে ধরে অভ্যর্থনা জানালেন, আমি বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের উষ্ণতা অনুভব করতে পারছিলাম। মানুষকে কাছে টেনে আপন করার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। বঙ্গবন্ধুর বসার ঘরটি ছিল সাধারণ কিন্তু চারদিকে আলমারিতে ঠাসা বই আর রবীন্দ্রনাথের একটি বড় ছবি ঘরটিকে অনন্য করে রেখেছিল। কুশল বিনিময়ের পর বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলেন কি উদ্দেশ্যে আমার আগমন? তিনি আমাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করছিলেন, সম্ভবত হাসিনার শিক্ষক বলেই, অন্যথা প্রায় সবাইকেই তিনি ‘তুমি’ বা ‘তুই’ সম্বোধন করতেন। আমি বললাম, “বঙ্গবন্ধু, যে শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছিল আজ হাওয়া বদলের সাথে সাথে তারা সুর পাল্টে আপনাকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সংবর্ধনা জানানোর আয়োজন করেছে, আপনি সেখানে যাবেন না, এই নিন সেই শিল্পীদের তালিকা।” আমি রবীন্দ্র বিতর্কের সব পেপার ক্লিপিং একটা ফাইলে সাজিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেটা আমি বঙ্গবন্ধুকে দিলাম। তিনি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে ফাইলটা পড়লেন এবং ঐ শিল্পীদের কয়েকটা নাম দেখে বিস্মিত হয়ে বলছিলেন আশ্চর্য তিনি গভীরভাবে বললেন, আমি সংবর্ধনায় যাব, আপনিও যাবেন এবং মজা দেখবেন। তারপর তিনি হাসিনাকে ডেকে বললেন, “তোমার স্যারকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাও।” হাসিনা আমাকে একটি লম্বা ঘরের মধ্যে দিয়ে মায়ের কাছে নিয়ে গেলেন, ঐ ঘরে দেখলাম সারি সারি চৌকি পাতা, আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে হাসিনা বললেন, স্যার আমাদের বাড়িটা একটা হোটেল। ঢাকার বাইরে থেকে যারা বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন, তাদের অনেকেই এখানে রাত্রিযাপন করে যান, আর এর মধ্যেই আমাদের ভাই-বোনদের পড়াশোনা করতে হয়। বেগম মুজিব আমাকে খুবই আন্তরিকভাবে আপ্যায়ন করলেন এবং হাসিনার পড়াশোনার দিকে খেয়াল রাখতে অনুরোধ জানালেন।

নির্দিষ্ট দিনক্ষণে সংবর্ধনাস্থলে গিয়ে হাজির হলাম এবং হলের পেছন দিকে বসলাম। মিলনায়তনটি বেতার ও টেলিভিশনের শিল্পীতে ঠাসা। যথাসময়ে বঙ্গবন্ধু এসে উপস্থিত হলেন, হাতে তার আমার দেওয়া সেই ফাইলটি, যার মধ্যে রয়েছে রবীন্দ্রসংগীত বিরোধিতা করা শিল্পীদের তালিকা এবং তাদের সংবাদপত্রে দেওয়া বিবৃতি। সভার কাজ শুরু হলো, শিল্পীরা একের পর এক মঞ্চে উঠে বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তারা ভাষণ দিতে লাগলেন। এ যেন ভূতের মুখে রাম নাম। আমি অবাক হয়ে এই সুর বদলানো শিল্পীদের চেহারা দেখতে লাগলাম। শেষে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বললেন, “আমি একজন সাধারণ মানুষ। গান-বাজনা বিশেষ বুঝি না তবে আজ এই সভায় এসে আপনাদের কথা শুনে আমি অবাক না হয়ে পারছি না, আপনারা আজ যারা আমার এবং রবীন্দ্রনাথের প্রশস্তি গাইছেন, তারাই না কিছুকাল আগে সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রচার করে পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করানোর সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছিলেন? এবং রবীন্দ্রসংগীত আমাদের আদর্শ ও ঐতিহ্যবিরোধী আখ্যা দিয়েছিলেন?

আজ হাওয়া বদলের সঙ্গে সঙ্গে আপনাদেরও সুর পরিবর্তন হয়েছে দেখে আমি খুশি হয়েছি। সে যা-ই হোক, দীর্ঘকাল আমি বন্দি ছিলাম, গান শোনার সুযোগ হয়নি, আজ এই শিল্পীদের মাঝে এসে আমার রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি খুব শুনতে ইচ্ছে করছে, আপনারা গানটি শোনালে আমি খুব খুশি হব।”

বঙ্গবন্ধুর ঐ ভাষণের পর শিল্পীদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল, “শোনা গেল জাহেদুর রহিম কই, অজিত রায় কোথায়?” ইত্যাদি। কয়েকজন আধুনিক শিল্পী মঞ্চে জড়ো হলেন, তাদের মধ্যে দু-একজন গানটা জানতেন, তারা কোনোরকমে গানটি গাইলেন, বাকি শিল্পীরা ঠোঁট মেলালেন। শেখ সাহেব শিল্পীদের বক্তৃতা ও গান শুনতে শুনতে হাতের ফাইলটা খুলে রবীন্দ্রবিরোধীতাকারী শিল্পীদের তালিকা দেখে নিচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে যেই উদ্দেশ্যে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল তা আর সফল হতে পারল না। বলাবাহুল্য যে, হাসিনা যদি আমাকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে না দিতেন, তাহলে এই মজার ঘটনাটি ঘটত না এবং আমরাও বঙ্গবন্ধুর রসবোধের এমন চমৎকার দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হতাম।

বঙ্গবন্ধু আগরতলা মামলা থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, সে-সময় থেকে ২৬ মার্চ ১৯৭১ সাল কালরাত্রিতে গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত, সত্তরের নির্বাচন ও মহাপ্রলয়, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলো ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য সবচেয়ে কঠিন ও ব্যস্ত সময়। এ সময়টাতে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ছিলেন তিনি, আর এ সময়টাতেই হাসিনাকে অনার্স পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে হচ্ছিল। একাত্তর সালে অনার্স পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল, হাসিনা তখন পরিবারের সঙ্গে বন্দি এবং সন্তানসম্ভবা। একাত্তর সালে নামকাওয়াস্তে একটা পরীক্ষা হয়েছিল, হাসিনার পক্ষে সে-সময় পরীক্ষা দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সে-সময় তিনি প্রথম সন্তান ‘জয়’-এর মা হন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর একাত্তর সালে গৃহীত পরীক্ষাগুলো বাতিল হয়ে যায় এবং আবার বাহাত্তর সালে অনার্স পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু হাসিনা পরীক্ষা দিতে পারেননি, কারণ একদিকে মা হিসেবে সদ্যোজাত সন্তানকে মানুষ করা, অপরদিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যস্ত মানুষ তার বাবাকে নানা কাজে সাহায্য করা। এ অবস্থায় হাসিনা আমার কাছে এসে পরামর্শ চাইলেন। আমি তাকে বললাম, সাবসিডিয়ারি যখন পাস করা আছে তখন এবার না হয় পরেরবার অনার্স পরীক্ষা দিয়ে দিতে। হাসিনা বললেন, অনার্স পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণের সময় বা অবস্থা তার নেই। একদিকে বাবাকে সাহায্য করা, অপরদিকে নিজের সংসার ও সন্তান, এই দুইদিক সামলে তার পক্ষে অনার্স আট পেপার পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। আমি তখন তার অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে একটা পরামর্শ দিলাম। বললাম, বিশ^বিদ্যালয়ের আইন অনুসারে যেসব ছাত্রছাত্রী সাবসিডিয়ারি দুটি বিষয় পাস করেছে কিন্তু অনিবার্য কারণবশত অনার্স পরীক্ষা দিতে পারেনি তারা যদি একটি ইলেকটিভ বিষয় এবং বিএ পাস কোর্সে বাধ্যতামূলক ইংরেজি ও বাংলা দুই পেপার পরীক্ষা দিয়ে পাস করে তাহলে তারা বিএ ডিগ্রি পেতে পারে। আমি হাসিনাকে স্পেশাল বেঙ্গলি এবং আবশ্যিক ইংরেজি ও বাংলা দুই পেপার পরীক্ষা দেওয়ার পরামর্শ দিলাম। হাসিনা তাই করলেন (তিনি স্পেশাল বেঙ্গলি বা বাংলা সাহিত্য) ৩০০ নম্বর এবং ইংরেজি ও বাংলা ২০০ নম্বর মোট ৫০০ নম্বর পরীক্ষা দিলেন। আগে তার দুটি বিষয়ে ৬০০ নম্বর পাস করা ছিল এবং এবার ৫০০ নম্বর মোট ১১০০ নম্বরের পরীক্ষা দিয়ে শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বিএ পাস করলেন অর্থাৎ গ্র্যাজুয়েট হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিএ পাস করার পর তিনি যথারীতি বাংলায় এমএ প্রিলিমিনারি ক্লাসে ভর্তি হলেন, তার সঙ্গে সঙ্গে সাজেদা চৌধুরী এবং আইভি রহমানও বাংলা এমএ প্রথম পর্বে ভর্তি হলেন এবং নিয়মিত ক্লাস করতে লাগলেন। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে একদিন হাসিনা তার স্বামী ড. ওয়াজেদকে নিয়ে আমার বাসায় উপস্থিত, আমি তখন শহিদ মিনারের উল্টো দিকে বিশ্ববিদ্যালয় আবাসের বাসিন্দা। হাসিনা বললেন, তিনি আর তার বোন শেখ রেহানা ড. ওয়াজেদের সঙ্গে ইউরোপে বেড়াতে যাচ্ছেন। ফিরে এসে এমএ প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেবেন। আমি বললাম, “যাও ভালোয় ভালোয় ঘুরে আস তারপর পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে হবে।” আমি ওদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন কামনা করলাম। ওরা ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে বিদেশ ভ্রমণে গেলেন আর তারপর ১৫ আগস্ট সেই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি ঘটে গেল। হাসিনা আর রেহানা হারালেন তাদের বাবা, মা, ভাই ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন, বাঙালি হারালো তাদের স্বাধীনতার মহানায়ককে, পরে অন্য নায়কদের। একাত্তরে পরাজিত শত্রু তাদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস ট্র্যাজেডি ঘটাল চরম বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে দেশি ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের শিকার হতে হলো বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঢাকাস্থ অনেককে।

শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশে উপস্থিত থাকলে তাদের একই পরিণতি হত্যার কারণ খুনিরা নারী, শিশু এমনকি গর্ভবতী মাকেও রেহাই দেয়নি। শুরু হলো শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নির্বাসিত জীবন আর বাংলাদেশে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট-পরবর্তী ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও রক্তারক্তির ইতিহাস। ঘটে গেল ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ৩ তারিখে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। তার কয়েকদিন পর নিহত হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হায়দার ও কর্নেল হুদা। সিপাহী বিপ্লবের নামে চলতে লাগল অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান। বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে ফাঁসির যুপকাষ্ঠে প্রাণ দিতে হলো। বঙ্গবন্ধুর পরিবার এবং জাতীয় চার নেতার রক্তের ঋণ পরিশোধিত হলো রক্ত দিয়ে, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল এক অভিশপ্ত দেশে।

১৯৮১ সালের শুরুর দিকে এক অপরাহ্নে শেখ হাসিনা তার নির্বাসন জীবন শেষে দিল্লি থেকে বিমানযোগে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। তখন শীতকাল, বৃষ্টি হওয়ার কথা নয় কিন্তু সেদিন অঝোর ধারায় বর্ষা নামলো, মনে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রকৃতি অঝোর ধারায় ক্রন্দনরত। বিমানবন্দর ঐ অকাল বর্ষার ঘনবর্ষণেও লোকে লোকারণ্য। হাসিনা পিতা, মাতা, ভাই, নিকট আত্মীয় পরিজনহীন ঢাকায় নামলেন অশ্রুসিক্ত হয়ে; কিন্তু তার পাঁচ বছরের রুদ্ধ আবেগকে তিনি সংবরণ করতে পারলেন না, তিনিও প্রকৃতি ও জনতার অশ্রান্ত ক্রন্দনের শামিল হয়ে একটি ট্রাকে উঠলেন। আমি আর ড. শামসুল হুদা হারুন বিমানবন্দরে দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে অশ্রু সংবরণ করতে পারছিলাম। আমাদের গাড়ি এই অঝোর ধারার বৃষ্টির মধ্যে হাসিনার দীর্ঘ শোভাযাত্রার অনুসরণ করতে লাগল। বিমানবন্দর থেকে বনানী গোরস্তান, সেখানে সারি সারি শুয়ে আছেন মা ও ভাইয়েরা, আত্মীয়-পরিজন ও তিন জাতীয় নেতার কবরগুলো তখনও বাঁধানো বা ঠিকমতো চিহ্নিত করা হয়নি। পঁচাত্তরের খুনিরা বঙ্গবন্ধুর কবর ঢাকাতে হতে দেয়নি, তার লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে গেছে এবং তড়িঘড়ি যেনতেন প্রকারে দাফন করেছে। ফলে দেশের মাটিতে নেমে হাসিনা একসঙ্গে বাবা-মা ও ভাইদের কবর দেখতে পাননি। বনানী গোরস্তানে সেই বর্ষাসিক্ত বিকেলে এক মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। মা ও ভাইদের কবরে আছড়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন হাসিনা। তিনি তার এতদিনকার সঞ্চিত বেদনা ও কান্নার স্রোতে ভেসে গেলেন। বনানী থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ, সেখানে এই অক্লান্তবৃষ্টির মধ্যে হাসিনার জনসভা। এক শোকার্ত জনসমুদ্রে অশ্রু ভারাক্রান্ত শেখ হাসিনা যা বললেন তার মর্ম এই যে, তিনি সব হারিয়েছেন তার আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই, কিন্তু যে দেশের মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে তার পিতা সপরিবারে জীবন দিয়ে গেছেন সেই দেশের মানুষের মুক্তির জন্য তিনি নিজেকে উৎসর্গ করলেন। ঐ কথাগুলো বলতে বলতে বারবার তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। প্রকৃতির কান্না, জনতার কান্না হাসিনার কান্নার সঙ্গে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। ঐ বিরল দৃশ্য দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল, আমি শুধু আমার ছাত্রীর জন্য মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম আর ভাবছিলাম, তিনি যখন মৃত্যুপুরী ৩২ নম্বরে বা টুঙ্গিপাড়ায় বাবার কবরে যাবেন তখন কি অবস্থা হবে, তিনি কি পারবেন নিজেকে সংবরণ করতে? ৩২ নম্বরে তিনি ঢাকায় ফিরে সঙ্গে সঙ্গে যেতে পারেননি, ঐ মৃত্যুপুরীর মালিকানা ফেরত পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল, তবে টুঙ্গিপাড়ায় তিনি গিয়েছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর অযত্নে পড়ে থাকা কবরে লুটিয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু সে দৃশ্য দেখার সুযোগ আমার হয়নি। হাসিনা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর নয়নমণি। হাসিনাও বাবাকে ভালোবাসতেন সবচেয়ে বেশি। অমন এক বাবার মেয়ে কীভাবে বাবার কবরে গিয়ে নিজেকে সংযত রাখতে পারেন?

হাসিনা যখন নির্বাসন শেষে ১৯৮১ সালের শুরুর দিকে দেশে আসেন তখন ঢাকায় তার নিজের বাড়িঘর বলতে কিছু ছিল না। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ৩২নং ধানমন্ডি যে বাড়িটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাড়ি, সেটি ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে বঙ্গবন্ধু পরিবারের রক্তে রঞ্জিত এক ভয়াবহ মৃত্যুপুরী। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরে আসেন তারপরও তিনি বঙ্গবন্ধু ভবনের অধিকার ফিরে পাননি, সে-বাড়ি তখনও ক্ষমতাসীন সরকারের দখলে। হাসিনা দেশে ফিরে আসার পর প্রথম তার সঙ্গে আমার দেখা ঝিগাতলার দিকে এক বাড়িতে। আমার ঠিক মনে নেই সেটা কার বাড়ি? সেদিন হাসিনা বিশেষ কথাবার্তা বলতে পারেননি। দেশে ফিরে এসে তখন পর্যন্ত হাসিনা নিজেকে বাবা, মা, ভাই এবং অন্যান্য পরিবার-পরিজন ছাড়া মানিয়ে নিতে পারেননি। ৩২ নম্বরের বাড়িটি ফিরে পেতে তাকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল বলে শুনেছি। শেখ হাসিনা দেশে ফেরার আগেই আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৩২ নম্বরের বাড়িটি ফিরে পাওয়ার পর সে-বাড়ির একটা ঘর সংস্কার করে হাসিনা মাঝে মাঝে সেখানে বসতেন। এক সন্ধ্যায় তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, দেখলাম নিঃসঙ্গ হাসিনা রক্তাক্ত স্মৃতির ভারে বেদনার্ত হয়ে বসে আছেন। মনে হলো, এ ভুতুড়ে বাড়িতে একা একা বসে থেকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

পরেরবার যখন আমি ৩২ নম্বরে তার সঙ্গে দেখা করতে যাই তখন আমি তার জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার একটি করে মানচিত্র নিয়ে গেলাম। ঐগুলি তাকে দিয়ে বললাম, “তুমি তো এখন আওয়ামী লীগের সভাপতি, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সবাই তোমার দিকে তাকিয়ে আছে, তুমি প্রতিটি জেলার মানচিত্র দেখে এবং তোমার দলের কোন বিশ^স্ত নেতা-কর্মী কোথায় আছেন তার তালিকা প্রণয়ন ও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।” আমার উদ্দেশ্য ছিল তাকে কাজে ঢুকিয়ে দেওয়া, যাতে এই নিঃসঙ্গ জীবনে একটা অবলম্বন পায়। আমার জানা নেই, সেই মানচিত্রগুলি তার কোনো কাজে লেগেছিল কি না! তবে ঐ বাড়িতে হাসিনা বা রেহানা কেউই বসবাস করেনি, তা সম্ভবপরও ছিল না। ঐ বাড়িতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর স্থাপন করে তা জাতির উদ্দেশে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন তারা। এরপর হাসিনা যখন দলের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন তখন আর তার সঙ্গে আমার বিশেষ যোগাযোগ হয়নি, তবে কালেভদ্রে কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হয়ে গেলে হাসিনা দুঃখ করে বলতেন, “স্যার, আমার আর বাংলায় এমএ পরীক্ষা দেওয়া হলো না।” এই দুঃখ মনে হয় হাসিনা কোনোদিন ভুলতে পারেননি। হাসিনা শিক্ষাজীবন অসম্পূর্ণ রেখেই তার পিতার হাতে গড়া দলের নেতৃত্ব গ্রহণ এবং সামরিক স্বৈরাচারের দলন-পীড়ন ছিন্নভিন্ন দলকে একতাবদ্ধ করে তোলেন। যে অপশক্তি ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব মুছে যাবে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিলুপ্ত হয়ে বাংলাদেশ বেনামে পাকিস্তান হয়ে উঠবে, তাদের ক‚টকৌশল বানচাল হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠল। বলা বাহুল্য যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হওয়ার ফলে তা সম্ভবপর হয়েছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আবার জেগে উঠল।

আশির দশকে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর প্রায় দেড় দশক হাসিনাকে প্রথমে সামরিক স্বৈরাচার এবং পরে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠন ও তাতে নেতৃত্ব প্রদান করতে হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেন। প্রায় ২০ বছর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল ক্ষমতায় আসে কিন্তু যে মুজিবুর রহমান এবং তার বিশ^স্ত সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান তখন নেই; তাদের নেতৃত্বের অভাব পূরণ করতে হয় শেখ হাসিনাকে প্রায় এককভাবে। পরিবার-পরিজনহারা শেখ হাসিনা দেড় দশকের অবিরাম প্রয়াসে সমস্ত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের জাল ছিন্ন করেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দেশ এক দীর্ঘস্থায়ী প্রলয়ঙ্করী বন্যার কবলে পড়ে, হাসিনা সরকার সাফল্যের সঙ্গে সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করে এবং নিত্যব্যবহার্য ভোগ্যপণ্যের দাম পুরো শাসনামলে স্থিতিশীল রাখে। এটা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ প্রায় দুই দশক বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের নাম-নিশানা মুছে ফেলে দেওয়া হয়েছিল সুপরিকল্পিত উপায়ে, শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। দুই দশকজুড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে আগ্রাসন চালানো হয়েছিল, শেখ হাসিনার শাসনামলে তার অবসান ঘটে। শেখ হাসিনার দেশে ফেরার আগে পর্যন্ত পাঁচ বছর টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবর পড়ে ছিল অবহেলা ও অযতেœ। হাসিনা দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধুর কবরের পরিচর্যা যথারীতি হতে লাগল। প্রতি ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর কবরে কোরআন খানি ও দোয়া মাহফিল এবং আলোচনা সভার আয়োজন হতে থাকে, হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কবর রুচিসম্মতভাবে বাঁধিয়ে দেন। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধুর কবরের ওপর যথাযোগ্য সমাধি সৌধ নির্মিত হয়। পাঁচ বছর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর কবরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। গার্ড রেজিমেন্ট সামরিক সালাম জানায়, বিউগলে ‘লাস্ট পোস্ট’ বাজানো হয়। বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ হয়ে ওঠে জাতীয় তীর্থক্ষেত্র। কিন্তু ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫- ২০ বছর জাতিকে এজন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, ১৯৯৮-২০০০ সাল জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন এবং ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা। ১৯৯৮ সালের প্রথমার্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি দফতরে নজরুল জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের আয়োজনের জন্য এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় আমি প্রস্তাব করি জাতীয় পর্যায়ে ‘নজরুল জন্মশতবার্ষিকী’ উদযাপনের। প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং বেগম সুফিয়া কামালকে সভাপতি রূপে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সহ-সভাপতিদের মধ্যে আমি এবং প্রফেসর আনিসুজ্জামান ও প্রফেসর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ছিলেন। তবে কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা। আর সংস্কৃতি, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ছিলেন নজরুল জন্মশতবার্ষিকী উৎসবের প্রধান অভিভাবক। প্রফেসর আনিসুজ্জামান বাংলা একাডেমির সভাপতি হয়ে গেলে আমি নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হই এবং আমি ও কবি নুরুল হুদা নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশে দুই বছরব্যাপী মহাসমারোহে সফলভাবে নজরুল জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে সক্ষম হই।

বঙ্গবন্ধু বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে বাংলাদেশে রেখেছিলেন। এই বাংলাদেশের মাটিতে নজরুলের শেষ শয়ান রচিত এবং ধানমন্ডি কবি ভবনে পরে নজরুল ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়। আবার শেখ হাসিনা যখন ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী, তখন ‘নজরুল জন্মশতবার্ষিকী’ উদযাপিত হয়। নজরুল জন্মশতবর্ষেই কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশ থিম কান্ট্রি রূপে মর্যাদা পায় এবং সেই মেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে-বছরই বিশ্বভারতী শেখ হাসিনাকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করে এবং প্রধানমন্ত্রী নজরুলের জন্মস্থান চুরুলিয়া পরিদর্শন করেন।

শান্তিনিকেতনে বিশ^ভারতীর যে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ^ভারতীর সর্বোচ্চ সম্মান ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভ‚ষিত করা হয় তাতে সভাপতিত্ব করেন বিশ^ভারতীর চ্যান্সেলর ও ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আইকে গুজরাল। উক্ত সমাবর্তন উৎসবে আমি ও প্রফেসর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান উপস্থিত ছিলাম। শেখ হাসিনা তার প্রথমবারের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে বেশ কয়েকটি নামকরা বিদেশি বিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। আমার মনে হয় এর মধ্যে বিশ্বভারতীর সম্মানটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শেখ হাসিনা ছিলেন বাংলার ছাত্রী আর বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং। সমাবর্তন উৎসবে বিশ^ভারতীর উপাচার্য ছাড়াও শেখ হাসিনা এবং আই কে গুজরাল সমাবর্তন ভাষণ দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার ভাষণটি ছিল বাংলা ভাষায় এবং সুলিখিত ও সুপঠিত। সমাবর্তন উৎসবে শেখ হাসিনা কৌতুক করে আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি পাস করেছেন কি না অর্থাৎ তার ভাষণটি কেমন হয়েছে? আমি তার প্রশ্নের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বলেছিলাম, “তুমি খুব ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয়েছ, আশা করি বাংলায় এমএ পরীক্ষা দিতে না পারার বেদনা রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি পাওয়ার ফলে প্রশমিত হবে।” সমাবর্তন উৎসব শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারযোগে বোলপুর থেকে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মভ‚মি চুরুলিয়ায় যান এবং সেখানে এক বিশাল জনসভায় নজরুলের প্রতি জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন এবং নজরুলের চুরুলিয়া সফর যেমন ঐতিহাসিক, তেমন তাৎপর্যপূর্ণ।

শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী ছিলেন, বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তার রয়েছে প্রগাঢ় অনুভ‚তি, যার পরিচয় বিধৃত রয়েছে অপর একটি ঘটনায়। ঢাকার সাতমসজিদ রোডে যে জমিটির ওপর ছায়ানট সাংস্কৃতিক ভবন স্থাপিত হয়েছে সেই জমিটি শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলেই বরাদ্দ করা হয়েছিল। নজরুল জন্মশতবর্ষে ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে কলকাতা, শান্তিনিকেতনে, দিল্লি, লন্ডন এবং ফ্লোরিডায় মহাসমারোহে নজরুল জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের পেছনে বাংলাদেশের জাতীয় কমিটির নেপথ্য সাহায্য, সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা ছিল, যে কমিটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন শেখ হাসিনা। সর্বোপরি ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘নজরুল সমাধি সৌধে’র নকশা অনুমোদন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, যার নির্মাণকাজ শেষ হয় ১০ বছর পর ২০০৯ সালে নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর আগে। এই সমাধি সৌধেরও উদ্বোধক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব ঐতিহাসিক ঘটনা আমাদের ঐতিহ্য ও প্রতি শেখ হাসিনার গভীর শ্রদ্ধার পরিচয় করে।

১৯৭২ সালের ২৪ মে স্বাধীন বাংলাদেশে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নজরুলকে সপরিবারে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ধানমন্ডিতে একটি সুদৃশ্য বাড়িতে অধিষ্ঠিত করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বিদ্রোহী কবিকে নিয়ে তার জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হয়। ১৯৭৫ সালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু নজরুলকে পিজি হাসপাতালে একটি বিশেষ কেবিনে স্থানান্তর করেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হলে নজরুল হাসপাতালেই থেকে যান এবং ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে নজরুল এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। নজরুলের দাফন হলো বিশ^বিদ্যালয় মসজিদের পাশে। নজরুলের কবরে একটি যথাযোগ্য সমাধি সৌধ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় নজরুল জন্মশতবার্ষিকী বছরে। শেখ হাসিনা তার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে ১৪০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৯৯৯ সালের ২৫ মে) নজরুলের সমাধি সৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন কিন্তু সরকার পরিবর্তনের কারণে প্রায় ১০ বছর নজরুলের সমাধি সৌধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি। শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সমাধি সৌধ নির্মাণকাজ শুরু হয়, তবে সমাধি সৌধ নির্মাণকাজ শেষ হয় শেখ হাসিনার দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে নজরুলের ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকী ১২ ভাদ্র ১৪১৬ (২৭ আগস্ট ২০০৯) সুতরাং কবির সমাধি সৌধ উদ্বোধনের জন্য ঐ দিনটাই উপযুক্ত। আমরা অর্থাৎ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী, উপ-উপাচার্য ড. হারুন অর রশিদ, কোষাধ্যক্ষ ড. মিজানুর রহমান এবং আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করি ২৫ আগস্ট অপরাহ্নে তার তেজগাঁওস্থ দফতরে এবং তাকে অনুরোধ জানাই একদিন পর ২৭ আগস্ট সকাল ৭টায় নজরুল সমাধি সৌধ উদ্বোধন করতে। শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি রাজি হন এবং ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ২৭ আগস্ট সকাল ৭টায় নজরুল সমাধি প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হন। তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলি, ‘ঝড়’ নজরুলের প্রিয় প্রতীক সুতরাং ঝড়-ঝঞ্ঝা ছাড়া নজরুলের কোনো কিছুই হয় না। তিনি হেসে সম্মতি জানালেন। শেখ হাসিনা প্রতিক‚ল আবহাওয়ার মধ্যে প্রথম সমাধি সৌধ উদ্বোধন এবং পরে কবির কবরে ফুল দিয়ে ফাতেহা পাঠ করে যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে আমার আর যেতে ইচ্ছে করে না”, আমি তাকে আবার আসার অনুরোধ জানিয়ে বিদায় নিলাম।

১৯৭৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় ভাষণ দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। তার ৩৫ বছর পর ২০০৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আবার বাংলায় ভাষণ দিয়ে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এছাড়া তিনি এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের অন্যতম সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করে। বর্তমানে জাতিসংঘের ব্যবহৃত ভাষা হলো ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, চাইনিজ ম্যান্ডারিন প্রভৃতি। জনসংখ্যার দিক থেকে বর্তমান পৃথিবীতে বাংলা ভাষার স্থান চতুর্থ। সুতরাং তৃতীয় বিশ্বের কোনো ভাষাকে যদি জাতিসংঘের ব্যবহারের জন্য নির্বাচন করতে হয় তাহলে বাংলা ভাষার দাবি অগ্রগণ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বসভায় বাংলা ভাষা দাবি উত্থাপন করে এক ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ভ‚মিকা পালন করলেন।

লেখক : শিক্ষাবিদ
২০.০৮.২০০৯
[‘শেখ হাসিনা’ বই থেকে]


সর্বশেষ সংবাদ