পহেলা বৈশাখ: কালের স্রোতে উৎসব হয়ে ওঠার গল্প

  © সংগৃহীত

বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখ, বাঙালির জীবনে শুধুমাত্র একটি ক্যালেন্ডার পরিবর্তনের দিন নয়—এটি হয়ে উঠেছে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পরিচয়ের প্রতীক। কিন্তু এই দিনটি কিভাবে এলো? কেনই বা আমরা এত ঘটা করে নববর্ষ উদযাপন করি?

বাংলা সনের উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে নানা মত। সবচেয়ে জনপ্রিয় মতানুসারে, মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ সালে বাংলা সনের সূচনা করেন। তার শাসনামলে ফসলি কর আদায়ের সুবিধার্থে একটি নতুন ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করা হয়, যা হিজরি সন ও সৌর পঞ্জিকার সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছিল। একে বলা হয় “ফসলি সন”, যা পরে “বাংলা সন” নামে পরিচিতি পায়। এই সনের প্রথম দিনই পহেলা বৈশাখ।

প্রথমদিকে পহেলা বৈশাখ মূলত ছিল অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। কৃষিজীবী মানুষ এই দিন নতুন করে খাজনা দিত, জমিদাররা আয়োজন করত “হালখাতা”—যেখানে ব্যবসায়ীরা পুরোনো হিসাব শেষ করে মিষ্টিমুখ করিয়ে নতুন খাতা খুলত। সময়ের সঙ্গে এই হিসাবনিকাশের দিন পরিণত হয় মিলনমেলায়, উৎসব-আয়োজনে।

আরও পড়ুন: পান্তা-ইলিশ: বৈশাখের রীতি নাকি আধুনিক রূপকথা?

আজকের দিনে পহেলা বৈশাখ মানেই এক বর্ণিল, বহুমাত্রিক উৎসব। সকাল শুরু হয় রমনা বটমূলে ছায়ানটের গানে—"এসো হে বৈশাখ"। এরপর চারুকলা ইনস্টিটিউটের আয়োজনে হয় শোভাযাত্রা—যা ইউনেস্কো কর্তৃক মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত।

বৈশাখ মানেই বৈচিত্র্য। নারীরা পরেন লাল-সাদা শাড়ি, ছেলেরা পাঞ্জাবি। খাওয়াদাওয়ায় থাকে পান্তা-ইলিশ, চালভাজা, আলুভর্তা। ঘরে ঘরে চলে আতিথেয়তা। বিভিন্ন স্থানে বসে বৈশাখী মেলা, হয় লোকসংগীত, পুতুলনাচ, ঘুড়ি ও নাগরদোলার আনন্দ।

বাংলাদেশের গ্রামবাংলায় এখনও পহেলা বৈশাখ মানে মেলা, গরুর দৌড়, লাঠিখেলা আর পুকুরঘাটে উৎসবের আমেজ। শহরে এটি হয়ে উঠেছে একটি কসমোপলিটন সংস্কৃতির অংশ। ব্যবসায়ীরা হালখাতা চালু রেখেছেন আধুনিক পদ্ধতিতে, আর তরুণ প্রজন্ম উদযাপন করে ফেসবুকে নববর্ষের স্ট্যাটাস দিয়ে, বন্ধুদের সঙ্গে বৈশাখী ফটোশুট করে।

তবে এই উৎসব শুধু আনন্দে সীমাবদ্ধ নয়—এটি একধরনের আত্মপরিচয়ের খোঁজ। ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই এই উৎসবে শরিক হন। একে বলা যায় বাঙালির সার্বজনীন সংস্কৃতি।

বিশেষ করে ১৯৬০–৭০ দশকে বাঙালির জাতীয়তাবাদের জাগরণে পহেলা বৈশাখ রাজনৈতিক তাৎপর্যও লাভ করে। পাকিস্তান আমলে ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক চর্চা দমন করা হলেও পহেলা বৈশাখ হয়ে ওঠে প্রতিরোধের ভাষা।

আজকের দিনে পহেলা বৈশাখ শুধু একটি তারিখ নয়—এটি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও গণচেতনার প্রতিফলন। এটি আমাদের শেখায় পুরোনোকে বিদায় দিয়ে নতুনকে আলিঙ্গন করতে, কালের ঘুর্ণিতে টিকে থাকতে আমাদের শিকড়ে ফিরে যেতে।


সর্বশেষ সংবাদ