‘তিন সিটের সোফা’র গল্পটা আসলে কী?

ছবি: পোরাহ দ্যা ব্যান্ড-এর অভিযোগ গান থেকে
ছবি: পোরাহ দ্যা ব্যান্ড-এর অভিযোগ গান থেকে  © সংগৃহীত

গত কয়েকদিন ধরে ‘তিন সিটের সোফা’ নামক একটি গল্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাসছে। এ নিয়ে ব্যাঙ্গত্মক পোস্ট যেমন চলছে, তেমনি বানানো হচ্ছে নানা ধরনের মিম ভিডিও।  কিন্তু কোথা থেকে এলো এই গল্প, কোথায়-ই বা এর সূত্রাপাত?

জানা যায়, স্বামী-স্ত্রীর অম্ল মধুর সম্পর্ক নিয়ে গত কয়েকদিন আগে একটি পোস্ট করেন শারমিন আক্তার শেফা নামে এক নারী। ওই গল্পের বিপরীতে আরেকটি পোস্ট করেন আহমেদ ইশতিয়াক নামে এক ফেসবুকার। এরপরই বিষয়টি সবার সামনে আসতে থাকে; যা নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই মেতে আছেন নেটিনেজরা। নাসির উদ্দিন নামে একজন লিখেছেন, এর আগে দেখছিলাম কাকলি ফার্নিচার। এখন দেখছি তিন সিটের সোফা। বাংলার ফেইসবুক সমাজ কি ফার্নিচার ফেটিশ? আরেকজন লিখেছেন, ‘তিন সিটের সোফা, চার ফিটের পর্দা এই রকম আরো বহু কিছুই ভাইরাল হবে। কিন্তু ৩০০ টাকার মজুরীর গল্প ভাইরাল হবে না।’

পড়ুন: বিসিএস ছেড়ে দুদকের এডিতে যোগদান

তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, শারমিন আক্তার শেফা নামে এক নারী তার ফেসবুকে লিখেন, ‘‘৩ সিটের সোফা; আমি বসেছিলাম এক সাইডে অন্য সাইডে ছিলো আমার স্বামীর কাজিন, মাঝখান টা ফাকা। বাসায় বেড়াতে এসেছে সবাই পরিবারের সবাই মিলে গল্প করছিলাম।

আমার স্বামী অফিস থেকে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আর বাসায় ঢুকতেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেহমানদের ভালোমন্দ বড় দের সালাম কিছুই করলো না আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এরপর ও রুমে চলে গেলো আমিও দ্রুত উঠে রুমে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম কি হইছে কোনো উত্তর দিচ্ছিলো না। খেয়াল করলাম চোখ লাল হয়ে গেছে মুহূর্তেই গলার রগ বেয়ে গেছে।

এমন সাধারণত ওর তখন হয় যখন খুব রেগে যায়। আমি ভয়ে ভয়ে পাশে গিয়ে ওর মাথায় হাত দিয়ে বসিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম। তখনও আমি জানিনা কি হচ্ছে, কিন্তু সে একদম টাচও করতে দিতে ইচ্ছুক না।

ওর এমন ব্যবহারে ভয়ে আমি কেঁদে দেই, এরপর হঠাৎ বলে উঠে তার সাথে সোফায় বসতে তো ভালোই লাগছিলো তাইনা? যাও গিয়ে বসো আমার সামনে আর আসবানা। এই কথা শুনার পর আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতেছিলাম না। এত বড় সোফায় দুজন দু’মাথায় এটা দেখেই ওর এই অবস্থা? সাথে সাথে তাকে বিছানায় বসিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম শান্ত হও প্লিজ শান্ত হও। যখন জড়িয়ে ধরি ওর শরীর রাগে কাঁপছিলো। ধীরে ধীরে একদম শান্ত হয়ে যায়।

এরপর ওয়াদা করি আর কখনই এমন হবেনা আমাকে মাফ করে দাও। প্রেম করে বিয়ে করেছি ৩ বছর হয়ে গেলো। পাগলটা এখনও সেই আগের মতই আছে। মনে পড়ে গেলো ৫ বছর আগে একদিন সিএনজিতে বসছিলাম পাশে এক লোক ছিলো সেদিনও সে ঠিক একই কর্মকাণ্ড করেছিলো। একটা মানুষ এতটা ভালো কিভাবে বাসতে পারে?‘’

এদিকে শারমিনের ওই গল্পের বিপরীতে আরেকটি গল্প লিখেছেন ইশতিয়াক নামে এক ফেসবুকার। তিনি লিখেন, ৩ সিটের সোফা। আমি বসেছিলাম এক সাইডে, অন্য সাইডে ছিলো আমার বউয়ের সুন্দরী  কাজিন। মাঝখানটা ফাঁকা। বেড়াতে এসেছে সবাই। আমরা গল্প করছিলাম। আমার বউ অফিস থেকে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই আমাদের এই অবস্থায় দেখে দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর কী জানি বিড়বিড় করতে করতে রুমে চলে গ্যালো। আমিও দ্রুত উঠে রুমে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হইছে?’

বউ চুপচাপ। খেয়াল করলাম তার চোখ লাল হয়ে গেছে। গলার রগটাও কেমন ফুলে ফুলে উঠছে। রেগে গেলেই তার এমনটা হয়। আমি ভয়ে ভয়ে বউয়ের পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম। তখনো আমি জানি না যে, কী হচ্ছে! ওর এমন ব্যবহারে  আমি মিনমিন করতে থাকি। হঠাৎ বউ বলে উঠলো, ‘তার সাথে সোফায় বসতে তো ভালোই লাগছিলো, তাই না? যাও, গিয়ে বসে থাকো। আমার সামনে আর আসবা না।’ এই কথা শুনে আমি বললাম, ‘ওকে! তুমি এত সহজে রাজি হবা, বুঝি নাই। যাইতেছি।’

এরপর আমি সোফায় বসে বউয়ের সুন্দরী কাজিনের সাথে বসে গল্প করতে থাকলাম। বউ আড়াই মিনিটের মধ্যেই ব্যাগ গুছিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। বললো, ক্যারেকটারলেস কোথাকার! তোরে তালাক দিলাম। সবাই আমার বউকে বোঝানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু বউ বুঝলো না। সে একটা গালি দিয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে গেলো। তার কিছুদিন পরেই তালাকের নোটিশ পেলাম। এই ঘটনার পর আমি খুব ভেঙে পড়লাম। সবাই আমার অবস্থা দেখে আমার বউয়ের সেই কাজিনের সাথেই আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলো। 

বিয়ের এক বছরের মাথায় আমার নতুন বউ ওর কাজিন, মানে আমার সুন্দরী এক্স বউয়ের পরিবারের সবাইকে দাওয়াত দিলো। এক্স বউয়ের সাথে আমি সোফায় বসে গল্প করছিলাম। নতুন বউ বাথরুম থেকে বের হয়ে আমাদের আমাদের এই অবস্থায় দেখে দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর কী জানি বিড়বিড় করতে করতে রুমে চলে গ্যালো। আমিও দ্রুত উঠে রুমে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হইছে?’

নতুন বউ চুপচাপ। খেয়াল করলাম তার চোখ লাল হয়ে গেছে। গলার রগটাও কেমন ফুলে ফুলে উঠছে। রেগে গেলে আমার এক্স বউয়ের মতো তারও এমনটা হয়। আমি ভয়ে ভয়ে নতুন বউয়ের পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম। তখনো আমি জানি না যে, কী হচ্ছে!

ওর এমন ব্যবহারে  আমি মিনমিন করতে থাকি। হঠাৎ নতুন বউ বলে উঠলো ‘তার সাথে সোফায় বসতে তো ভালোই লাগছিলো, তাই না? যাও, গিয়ে বসে থাকো। আমার সামনে আর আসবা না।’ এই কথা শুনে আমি বললাম, ‘ওকে! তুমি এত সহজে রাজি হবা, বুঝি নাই। যাইতেছি।’
এরপর আমি সোফায় বসে এক্স বউয়ের সাথে গল্প করতে থাকলাম। নতুন বউ আড়াই মিনিটের মধ্যেই ব্যাগ গুছিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। বললো, ক্যারেকটারলেস কোথাকার! তোরে তালাক দিলাম। সবাই আমার নতুন বউকে বোঝানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু নতুন বউ বুঝলো না, সে একটা গালি দিয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে গেলো। তার কিছুদিন পরেই তালাকের নোটিশ পেলাম। এই ঘটনার পর আমি খুবই ভেঙে পড়লাম। পরিবারের সবাই আমার অবস্থা দেখে আমার নতুন বউয়ের কাজিন, মানে আমার এক্স বউয়ের সাথেই আমাকে আবার বিয়ে দিয়ে দিলো।

বউ আমাকে বাসর রাতে চিৎকার করে বললো, আর এমন বিয়ের চক্র শুরু করলে আমাকে শুটিয়ে লাল করে দেবে। এই শুনে আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ও শান্ত হয়ে এলো। আমি ওয়াদা করলাম, আর এমনটা হবে না। এই দফায় তিন বছর পার করে ফেললাম আমরা। বউ আর ওর কাজিনকে দাওয়াত দেয় না। আমি দাওয়াত দিতে বললে গালাগালি করে। কিন্তু আমি তো বুঝি, এই গালাগালিটা বউ কেন করে! আসলে  ও আমাকে আর হারাতে চায় না। 
একটা মানুষ এতটা ভালো কীভাবে বাসতে পারে!

পড়ুন: বিয়ের ভয়ে পালিয়ে সেই বিয়েই করলেন সুকন্যা

বিষয়টি নিয়ে সমালোচনাও করেছেন অনেকে। আরিফ আজাদ নামে একজন লিখেছেন, ‘‘তিন সিটের সোফার যে গল্পটা ভার্চুয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা কয়েকবার পড়লাম। কিন্তু এতোবার পড়েও এটার মধ্যে ঠিক কোথায় যে ট্রল করার বিষয়বস্তু কিংবা ব্যাপক হাস্যরসের উপাদান লুকিয়ে আছে তা ধরতে পারলাম না৷

তিন সিটের একটা সোফা। একপাশে বসে আছে গল্পের নায়কের চাচাতো ভাই। অন্যপাশে বসে আছে নায়কের বউ। মাঝখানটায় খালি। নায়ক অফিস থেকে ফিরে এই দৃশ্য দেখে রাগে গজগজ করতে করতে রুমে ঢুকে পড়ে। কেনো সে একজন পুরুষের পাশে, একই সোফায় বসেছে সেটা মেনে নিতে পারেন নাই গল্পের নায়ক তথা মেয়েটার স্বামী।
এই জায়গায় পাবলিক যেভাবে হাসাহাসি করছে ব্যাপারটা নিয়ে তা বেশ আশ্চর্যজনক বৈকি! গল্পকথক মেয়েটা এই অবস্থাকে ডিফাইন করেছে তার প্রতি স্বামীর অনির্বাণ আকর্ষণ আর ভালোবাসা হিশেবে। ভালোবাসার মানুষকে সে অন্যকারো পাশে দেখাটা বরদাস্ত করতে পারছে না।
দেখুন— 'বিয়ের কয়েক বছর যেতে না যেতেই জামাইয়ের বউকে ভালো না লাগা, আর বউয়ের জামাইকে ভালো না লাগার' এই মহামারীর দিনে, এক জামাই তার বউকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসছে, অন্য আরেক পুরুষের পাশে তার বসাটাকেও সহ্য করতে চাইছে না স্রেফ ভালোবাসার জায়গা থেকে— এখানে হাস্যরসের উপকরণটা ঠিক কী?

কারো বউকে কেউ যেকারো পাশে বসতে দেখতে পছন্দ করতেই পারে। সেটা একান্তই যার যার নিজস্ব ব্যাপার। আবার একইভাবে— কেউ একজন তার বউকে অন্যকারো পাশে দেখতে অপছন্দ করতে পারে। সেটাও ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপারের মধ্যেই পড়ে। আপনি যেটা পছন্দ করছেন না, সেটা কেনো অন্যের ঘাঁড়ে চাপিয়ে দিতে হবে?

জামাই যে তাকে অন্য ছেলের পাশে বসতে দেখে রাগে ফেটে পড়ছে, সেটা নিয়ে গল্পকথক মেয়েটারও কোন আপত্তি চোখে পড়লো না। সে না থানায় নারী নির্যাতনের মামলা করেছে, আর না বাপের বাড়িতে নালিশ পাঠিয়েছে। সে বরং জামাইয়ের এই কাজকে আহ্লাদে গ্রহণ করেছে এবং ভালোবাসা-সুলভ আচরণে 'স্যরি' বলে জামাইয়ের ভালোবাসাটাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। সুন্দর দৃশ্য!

কিন্তু, যারা গল্পটা পড়েছে তাদের অধিকাংশই কেমন জানি মেয়েটার পক্ষের লোক সাজতে গিয়ে ছেলেটাকে 'টক্সিক মেন্টালিটি', 'এটা ভালোবাসা নয়, অসুস্থতা' ইত্যাদি বিশেষণ দিতে শুরু করেছে।

মেয়েটাকে বিয়ে করেছে সে, খাওয়ানো-পরানোর দায়িত্ব তার, সুখে-দুঃখেও পাশে থাকবে সে, কিন্তু মেয়েটা কার পাশে বসবে আর কার পাশে বসবে না সেটা বাতলিয়ে দিবে আমাদের ফেবু-বাসী!!

পুরো ঘটনা নিয়ে মেয়েটার কোন আপত্তি কিন্তু নেই, কিন্তু ফেবু-বাসীর যেন এতে কান্নায় একেবারে বুক ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা!

যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়াপড়শির ঘুম নাই।’’


সর্বশেষ সংবাদ