করোনা সংকটে শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে চলবে
- ড. মনজুর আহমেদ
- প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২০, ০৫:৪৮ PM , আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২০, ০৬:৪৪ PM
করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার রোধে, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আগামী ৯ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে সামনে এই বন্ধ যে আরও বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না তা বলা যায় না। বাংলাদেশের সব ধরণের প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩০ মিলিয়ন শিক্ষার্থী এবং প্রায় এক মিলিয়ন শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষাকর্মী এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে এখন গৃহবন্দী।
ইউনেস্কোর মতে, ২৪ মার্চের মধ্যে ১৩০টিরও বেশী দেশ স্থানীয় শাটডাউন বাদে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করেছে, যা বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীর উপর প্রভাব ফেলছে। বিশ্বের এই পরিস্থিতিতে শিক্ষা কর্তৃপক্ষগণ শিক্ষাক্ষেত্রে সংকট সামলাতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে এবং এই অবস্থার পরবতী দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কি হতে পারে তা বোঝার চেষ্টা করছে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিগুলো ২৮ মার্চ থেকে টেলিভিশনে প্রচার করতে বলেছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এই কার্যক্রম শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য সংস্থাগুলোর পাশাপাশি ব্র্যাকের শিক্ষা বিভাগের তথ্য অ্যাক্সেসের (এটুআই) ইউনিট সহযোগিতা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। জাতীয় সংসদের সম্প্রচার কার্যক্রমের জন্য নিবেদিত বাংলাদেশ টেলিভিশনের পাবলিক টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচারের জন্য ব্যবহার করা হবে।
ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির স্কুলের বিষয়গুলোর জন্য প্রতিদিন ছয় থেকে সাতটি ক্লাসের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ক্লাসগুলো আগেই অভিজ্ঞ শিক্ষক দ্বারা রেকর্ড করা হবে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়ির কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং পরের দিনের পাঠে সেটি আলোচনা করা হবে। নিয়মিত প্রোগ্রাম শুরু করার আগে পরীক্ষামূলকভাবে পাঠগুলো প্রস্তুত করে টেস্ট করা হবে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাসগুলির জন্য অনুরূপ পাঠ্য কার্যক্রম সম্প্রচার করার কথা ভাবছে।
২০০৯ সালে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময়, গণসাক্ষরতা অভিযান, সুশীল সমাজের শিক্ষাবিদরা ক্লাসরুম শিক্ষার পরিপূরক হিসাবে বিভিন্ন বিষয়ে ক্লাস রেকর্ড করে সম্প্রচারের জন্য বিটিভি চ্যানেলটি নিয়মিত ব্যবহারের জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে ধারণাটি এগিয়ে নেয়ার মতো কোনো লক্ষ্য বা পরিকল্পনা ছিল না। বর্তমান পরিস্থিতি সরকারকে এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে। এটি যতটা সম্ভব কার্যকরভাবে পরিচালনা করা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
পাঠসূচির টিভি সম্প্রচারকে আকর্ষণীয় এবং সার্থক করে তোলার জন্য কিছু অত্যাবশ্যক বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন। এর মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ নিম্নরূপ।
আকর্ষণীয় করে তোলা: পাঠগুলো দেখে যেন মনে না হয় যে একজন গদবাধা কথা বলে যাচ্ছেন। একটি ভালো পাঠদানের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে সেগুলো পাঠের মধ্যে যথাযথভাবে প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
ইন্টারেক্টিভ করা: একটি টিভি সম্প্রচারের ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং শিক্ষাথীর মধ্যে মিথষ্ক্রিয়তার অভাব দেখা যায়। তাই স্কুল শিক্ষকদেরকে ব্রডকাস্টগুলি দেখে তাদের শিক্ষার্থীদের সাথে ফোন এবং মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে উৎসাহিত করা উচিত। তবে জানা প্রয়োজন যে বড় মোবাইল ফোন সংস্থাগুলি বাংলাদেশ টেলিযোগযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এর সহায়তায় পাঠ সম্পর্কে শিক্ষার্থী-শিক্ষকের যোগাযোগের জন্য বিনা খরচে টেলিফোন লাইন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে পারবে কি?
মনে রাখা প্রয়োজন: স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং সেই সাথে শিক্ষার্থী ও পিতামাতার জন্য সামাজিক বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় বার্তাগুলি নির্বাচিতভাবে সম্প্রচারে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। অভিভাবক এবং স্কুল শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করা এই সম্প্রচারের একটি অংশ হওয়া উচিত।
আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
পাবলিক পরীক্ষা: সারা দেশে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা অস্থায়ীভাবে স্থগিত করা নিয়ে উদ্বিগ্ন। যুক্তরাজ্যে মাধ্যমিক স্তরের জেনারেল সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন (জিসিই) এই বছর বাতিল করা হয়েছে। স্কুল পরীক্ষা এবং শিক্ষকের সুপারিশের ভিত্তিতে তাদের সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে। কিন্তু বাংলাদেশে এটা করা সম্ভব নয়।
যেটি করা যায় তা হ'ল এসএসসির জন্য প্রাথমিক বিষয়গুলো যেমন বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের শুধুমাত্র একটি পত্রের উপর ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নিয়ে পরীক্ষা সহজ ও সংক্ষিপ্ত করা। এইচএসসির জন্য একই নিয়ম প্রয়োগ করা যেতে পারে তবে বিজ্ঞান বিভাগের জন্য আরও তিন বা চারটি বিষয় যুক্ত করতে হতে পারে।
এটি ব্যাপারটিকে সহজতর করবে এবং শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের উদ্বেগ দূর করবে। তবে এ বিষয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজন।
শিক্ষার জন্য ডিজিটাল অবকাঠামো নির্মাণ: স্মার্ট ফোনের কল্যাণে বর্তমানে দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত। তবে শিক্ষাক্ষেত্রে ইন্টারনেটের কার্যকর ব্যবহার এখনও এদেশে দেখা যায়নি। ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরির বিভিন্ন উদ্যোগ এবং অগ্রগতি সত্ত্বেও শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বেশ ধীরগতির এবং কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে।
যেহেতু দেশের অনেক জায়গা বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে ইন্টারনেট এখনও সহজলব্ধ হয়নি তাই শিক্ষাক্ষেত্রে ইন্টারনেটের কার্যকরী ব্যবহার সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায়নি। তবে এই সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব যদি দেশের মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো, বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলো এবং নিয়ন্ত্রণকারী এজেন্সিগুলি দীর্ঘসময় একসাথে কাজ করতে রাজি হয়।
প্রযুক্তি সরবরাহকারীদের সাথে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাজ করা: টেনসেন্ট, চীনের বৃহত্তম ইন্টারনেট ও বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সার্ভিস প্ল্যাটফর্ম এবং ইডান শিক্ষা পুরষ্কার ফাউন্ডেশনের স্পনসর, দেখিয়েছে কীভাবে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষককে দূরবর্তী অঞ্চল থেকেও কার্যকরীভাবে সংযুক্ত করা যায় যখন করোনা মহামারীর দরুন তাদের দেশে প্রায় ১২০ মিলিয়ন শিক্ষার্থী ছিল গৃহবন্দী।
টেনসেন্ট এবং ইডান ফাউন্ডেশন এই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার করার প্রস্তাব দেয়। তারা ইউনেস্কোর সংকটের বিষয়ে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়াতে অংশ নেওয়ার এবং পুরষ্কারপ্রাপ্তদেরকে আমন্ত্রণ করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। ব্র্যাক শিক্ষা প্রোগ্রাম শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য ২০২০ সালের ইডান পুরষ্কারপ্রাপ্ত।
শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়াই: যেহেতু আইসিটিভিত্তিক শিক্ষা এখন একটি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত বিষয়, সেহেতু সকল ক্ষেত্রে এর গ্রহণযোগ্যতা এবং বিভিন্ন উপায়ে সুবিধাবঞ্চিতদের দ্বারা এটির সুবিধাগুলি উপলব্ধি এখন একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণত যাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ভাল এবং সমৃদ্ধ তারা ডিজিটাল প্রযুক্তিগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হন। যাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্যের প্রয়োজন তারাই এখন সবচেয়ে পেছনে। ফলে ডিজিটাল বিভাজন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সকলের সমান অংশগ্রহণ এবং শিক্ষাক্ষেত্রে কার্যকরী ফলাফল প্রাপ্যতা শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্ভাবনের জন্য দিকনির্দেশক হওয়া উচিত। প্রতিকূলতা এই লক্ষ্যে সুযোগে পরিণত হোক।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দ্যা ডেইলি স্টার