‘জয় বাংলা’ স্লোগান কি আ.লীগের একক সম্পত্তি?
- এস এম তৌফিকুল ইসলাম
- প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৫, ০৮:০৪ PM , আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৫, ০৮:১১ PM

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতা যুদ্ধ করেছেন নানা শ্রেণির মানুষ। সবাই কণ্ঠে তুলে নিয়েছিল একই স্লোগান জয় বাংলা। স্বাধীনতার পর ওই স্লোগান ধীরে ধীরে কুক্ষিগত করেছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ও তার দলীয় নানা সংগঠন। এ কাজটা ঠিক হয়নি, অনেকদিন পর তা বুঝতে পারছেন অনেকেই।
এটা সবাই জানেন, মানেন যে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে 'জয় বাংলা' স্লোগানটি ছিল বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণশক্তি। স্লোগানটি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। কিন্তু আজ, অর্ধশতাব্দী পর, এই স্লোগানটিই রাজনৈতিক বিভাজনের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে একটি জাতীয় স্লোগান দলীয় রাজনীতির হাতিয়ারে রূপান্তরিত হলো? আর কেনই-বা এই স্লোগান দেওয়া আজ ‘অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে?
১৯৭১ সালে ‘জয় বাংলা’ ছিল বাঙালির মুক্তির মন্ত্র। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিটি প্রাণের সংগ্রামে, প্রতিটি রণাঙ্গনে এই স্লোগানই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যুগিয়েছে। শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিটি অঙ্গনে— কবিতা, গান, নাটক, চলচ্চিত্র ‘জয় বাংলা’ ছিল স্বাধীনতার স্বপ্নের প্রতীক। এমনকি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও এই স্লোগান শুনেই মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করত, করত আক্রমণ। স্লোগানটি নির্ধারণ করে দিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষ-বিপক্ষ।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ পরবর্তীতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে তাদের দলীয় স্লোগান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এই স্লোগান তো কোনো একটি দলের সম্পত্তি নয়— এটি সমগ্র বাংলাদেশের। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো কেন এই স্লোগান থেকে দূরে সরে গেল? এটি কি রাজনৈতিক সংকীর্ণতা, নাকি ইতিহাসের বিকৃতি? প্রশ্নের উত্তর নিয়ে বিস্তর আলোচনা সমালোচনা হতেই পারে।
বর্তমানে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়াকে অনেকেই আওয়ামী লীগের সমর্থন হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। এই মানসিকতা জাতিগত বিভেদকে আরও গভীর করছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী যেমন ‘জয় বাংলা’ বললেই মানুষকে টার্গেট করত, আজও কি একই মনোভাব দেখা যাচ্ছে? একটি স্লোগান কীভাবে রাজনৈতিক পরিচয়ের পরিমাপক হয়ে দাঁড়াল?
‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া কোনো ফৌজদারি অপরাধ নয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই স্লোগান নিষিদ্ধও করা হয়নি। তাহলে কেন এই স্লোগান দেবার জন্য মানুষকে আক্রমণ বা গ্রেপ্তার করা হবে কেন? রাষ্ট্রের উচিত ছিল এই স্লোগানকে সুরক্ষা দেওয়া। সেটা অন্তর্বর্তী সরকার করতে পারেনি। বাংলাদেশের রাজনীতির যে নয়া বন্দোবস্তের কথা বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, তার বাস্তনায়নের শুরু দৃশ্যমান হতো। আদর্শ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জয় বাংলার মত জনপ্রিয় জাতীয় স্লোগান দেওয়ার অপরাধে কাউকে আক্রমণ করা বা গ্রেপ্তার করা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
সম্প্রতি কিছু মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে: একাত্তর বড় নাকি চব্বিশ বড়? ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান ৫ আগস্টের পর মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভাঙ্গা হচ্ছে, স্বাধীনতার স্মৃতি চিহ্ন মুছে ফেলার প্রাণান্ত অপচেষ্টা করা হচ্ছে। কারা জড়িত এই কর্মকাণ্ডে? তারা কি ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তিরই উত্তরসূরি? ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের বিরুদ্ধে আক্রমণ কি আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধেই আক্রমণ?
‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি কেড়ে নেওয়ার অর্থ হলো বাঙালির সংস্কৃতি ও ইতিহাসের একটি গর্বের অংশকে মুছে ফেলা। স্লোগানটি একসময় ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সবাইকে এক করেছিল। আজও সেই ঐক্য প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার চেষ্টা যারা করবে, ইতিহাস তাদের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে সে কথা নিশ্চিত। অতীতেও বার বার এই অপচেষ্টা সফলতার মুখ দেখেনি, অদূর ভবিষ্যতেও দেখবে না সে কথা বলাই যায়।
‘জয় বাংলা’ কেবল একটি স্লোগান নয়, এটি বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাসের অঙ্গ। এটিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার না করে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ধারণ করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঁচাতে হলে ‘জয় বাংলা’কে ফিরে পেতে হবে তার সার্বজনীন রূপে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট
যোগাযোগা: smtawfiqulislam@gmail.com