ঈদুল ফিতর: সম্প্রীতির বন্ধনে এক মহিমান্বিত উৎসব
- মোঃ মিজানুর রহমান
- প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৬ PM , আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৬ PM

ঈদ মানেই আনন্দ, উৎসব, উচ্ছ্বাস। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে আসা রমজানের মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা শেষে শাওয়ালের একফালি উদিত চাঁদ যেন বিপুল খুশির বার্তা হয়ে ধরণিতে আনন্দের ফল্গুধারা বইয়ে দেয়। সাম্য, সৌহার্দ্য, ভালোবাসা ও মিলনের মহিমা নিয়ে উপস্থিত হয় পবিত্র ইদুল ফিতর, অশেষ তাৎপর্য ও মহিমায় অনন্য মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব।রোজাদার যে পরিচ্ছন্নতার ও পবিত্রতার সৌকর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, উদারতা, বদান্যতা, মহানুভবতা ও মানবতার গুণাবলি দ্বারা উদ্ভাসিত হন, এর গতিধারার প্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে আসে পবিত্র ঈদুল ফিতর।
“ঈদ” শব্দটি আরবি থেকে এসেছে, যার অর্থ আনন্দ, এবং "ফিতর" মানে রোজা ভাঙা বা ভোজ। রোজা ভাঙার এই দিনটি মুসলিমদের জন্য আনন্দের, তবে এর পাশাপাশি রয়েছে আরও অনেক গভীরতা। আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ, এবং সহানুভূতির প্রতীক ঈদুল ফিতর কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়,বরং মানবতার জয়গান, ধনী-গরিব, ছোট-বড় নির্বিশেষে সবাই একত্রিত হয়ে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার এক অপার সম্ভাবনা।
ঈদের প্রস্তুতি শুরু হয় রমজানের শেষের দিকে। নতুন পোশাক কেনা, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং ঈদের দিনটি উৎসবমুখর করার জন্য নানা পরিকল্পনায় কাটে ব্যস্ত সময়। তবে ইদুল ফিতরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সদকাতুল ফিতর প্রদান। সামজিক মেল বন্ধনের এক চমৎকার সুযোগ সদকাতুল ফেতর। এর মাধ্যমে ধনী-গরিবের মধ্যে ব্যবধান কমে, মানবিক সম্পর্ক আরও গভীর হয়। এটি আমাদের শেখায়, ঈদ কেবল নিজের জন্য নয়, বরং অন্যদের মুখেও হাসি ফোটানোর এক উপলক্ষ।
ইসলাম ধর্মে ঈদের আনন্দকে সর্বজনীন করার জন্য সদকাতুল ফিতর প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়াও পবিত্র রমজান মাসে রোজাদারদের ভুল-ত্রুটির ক্ষতিপূরণ হিসেবে সবাইকে সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হয়। নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ঈদের নামাজের আগেই ফিতরা আদায় করতে হবে, যাতে সমাজের দরিদ্র মানুষরাও ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে।
এ ব্যাপারে হাদিস শরিফে এসেছে,
ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) সব মুসলিমের ওপর সদকাতুল ফিতর ফরজ করেনে। চাই সে দাস বা স্বাধীন হোক, পুরুষ বা নারী হোক, প্রাপ্ত বয়স্ক বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক হোক তা দিতে হবে। তা খেজুর বা যব থেকে এক সা পরিমাণ (বা এর সমূল্যের অর্থ) পরিশোধ করতে হবে। মানুষ ঈদের নামাজে বের হওয়ার আগেই তিনি তা পরিশোধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫০৩)
শুধু ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক উদযাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় ঈদুল ফিতর বরং একটি বৃহত্তর সামাজিক ও মানবিক দায়িত্বের স্মারক। ঈদের প্রকৃত আনন্দ তখনই পূর্ণতা পায়, যখন সমাজের অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানো যায়।
ঈদের দিন শুরু হয় ফজরের নামাজের মাধ্যমে। এরপর গোসল করে সুগন্ধি মেখে নতুন বা পরিষ্কার পোশাক পরিধান করে এবং মিষ্টি জাতীয় খাবার খেয়ে ইদগাহ মাঠের দিকে রওনা হয় মুসল্লিরা। ঈদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ঈদের জামাত। সমাজের ধনী গরীব,জেলে, কামার, কুমার নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে, দোয়া করে এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করে। নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে বিশেষ খাবার গ্রহণ করা হয়। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন, সেমাই-পায়েসসহ বাহারি খাবার পরিবেশন করা হয়। এরপর আত্মীয়স্বজনের বাসায় যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং দরিদ্রদের মাঝে দান করা ঈদের অন্যতম সৌন্দর্য।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদুল ফিতরের উদযাপন ভিন্ন হলেও এর মূল ভাবনা এক—সংহতি, ভালোবাসা ও মানবিকতা। মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিমরা ঈদ উদযাপন করেন। ভৌগোলিক ও আর্থ সামাজিক অবস্থার কারনে ঈদ উদযাপনে কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ করা যায় তবে মূল চেতনা অটুট রয়েছে। বিশ্বজনীন এ উৎসব জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির পার্থক্য ভুলিয়ে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে।
সংযম,সম্প্রীতি ও মানবতার অপূর্ব সম্মিলনের এ উৎসবে মুসলমানরা আত্মশুদ্ধি, ত্যাগ ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়। ঈদ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে একে অপরকে ভালোবাসার, সহমর্মিতা প্রদর্শনের এবং ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার গুরুত্ব। ইদ নিয়ে আসে সমাজের ধনী-গরিব, সুখী-অসুখী সকল স্তরের মানুষের জন্য আনন্দের বার্তা গড়ে তোলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্প্রীতির সেতুবন্ধন।
আমাদের একান্ত প্রত্যাশা, ঈদের মহিমান্বিত শিক্ষা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিফলিত হোক। সমগ্র বিশ্ব শান্তি, কল্যাণ ও সৌহার্দ্যের আলোয় উদ্ভাসিত হোক। আসুন, ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিই, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় করি, এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মাধ্যমে একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করি। ঈদ মোবারক!
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।