বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ট্রান্সজেন্ডার জটিলতা ও শব্দের ধাঁধা

  © টিডিসি ফটো

হালের সামসময়িক এক বিষয় হচ্ছে ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু। শিক্ষিত-বুদ্ধিজীবী মহলে বেশ জোরে-শোরে শোনা যাচ্ছে এই টার্মটি। সাধারণ মানুষ যতটুকু কনসেপ্টচুয়াল মিনিং বুঝতে সক্ষম হচ্ছে, তার থেকে ঢের ম্যানিপুলেটেড অর্থ ধারণ করছে। এর পেছনে অবশ্য হালের মিডিয়াগুলোর দিকে আঙুল তুললেও ভুল হবে না। কেননা ট্রান্সজেন্ডার টার্মটি গণমাধ্যমে এমনভাবে প্রচারিত হয়েছে যা অধিকাংশ মানুষের জন্য শব্দটির প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারা দুরূহ করে তুলেছে। ফলস্বরূপ দেশের অধিকাংশ মানুষ এমনকি শিক্ষিত শ্রেণির মাঝে রয়ে গেছে ধোঁয়াশা ও ভুল ধারণা।

সিংহভাগ লোক ট্রান্সজেন্ডার বলতে হিজড়া জনগোষ্ঠীকেই বুঝে থাকে। অথচ আক্ষরিক অর্থে ট্রান্সজেন্ডার দ্বারা রূপান্তিরত নারী কিংবা রূপান্তরিত পুরুষ বুঝানো হয়। প্রশ্ন আসতে পারে সমাজে যারা হিজড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত তারাও তো প্রকৃত অর্থে নারী কিংবা পুরুষ নয়। তারা রূপান্তরিত নারী কিংবা পুরুষের বেশই তো ধারণ করে। তাহলে ট্রান্সজেন্ডার দ্বারা হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সংজ্ঞায়িত করতে সমস্যা কোথায়? 

উত্তরে বলব সমস্যা নেই। তবে তা এক ম্যানিপুলেটেড অর্থই প্রকাশ করবে। এর উদাহরণ অনেকটা কল্পলোকের Mermaid তথা মৎসকন্যার মতো। দৈহিকভাবে মাছের অর্ধাবয়ব এবং সুন্দর এক রমণীর অর্ধেক অবয়বের সমন্বয় করে মৎসকন্যার কাল্পনিক চরিত্র ফুটিয়ে তোলা হয় বিভিন্ন ফিকশানে। সেখানে গল্পের চরিত্ররা যেমন ভুল করে মৎসকন্যাকে একজন মানুষ বলতে চান এখানেও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপারটি তেমন। শুধুমাত্র বেশ ধারণের ওপর একজনের পরিচয় তুলে ধরবার এক কৃত্রিমতা নিঃসন্দেহে হাস্যকর ও কৌতূহলোদ্দীপকও বটে। খুব জটিলতায় প্রবেশ করলে লোকে আবার ধৈর্য হারাবে। তাই বরং এবার ঝেড়ে কাশি। 

আরও পড়ুন: বিজয় ভাবনা: মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী সাংবাদিকদের ভূমিকা ও আমাদের শ্রদ্ধা

মেডিকেল কিংবা সায়েন্টিফিক টার্মে একজন ট্রান্সজেন্ডার দ্বারা রূপান্তরিত পুরুষ কিংবা নারী বোঝানো হয়। যাদের জীবনের কোনো এক দশায় XY অথবা XX ক্রোমোজোম ছিল। শারীরিকভাবে তারা সম্পূর্ণ সুস্থ একজন নারী অথবা পুরুষ ছিলেন। তবে মানসিকভাবে নিজদের পুরুষ/নারী পরিচয়ে সন্তুষ্ট ছিল না বিধায় তা পরিবর্তন করে বিপরীত লিঙ্গের পরিচয় গ্রহণ করেছে। এই রূপান্তরিত পরিচয় গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা অনেক সময় বডি সার্জারির আশ্রয় নেন ও পোশাক-পরিচ্ছেদে তাদের জৈবিক পরিচয়ের বিপরীতে থাকা লিঙ্গের বেশ ধারণ করে।

সহজ ভাষায় নারী হয়ে জন্মে পুরুষের বেশ ও পুরুষত্ব ধারণ করা কিংবা পুরুষ হয়ে জন্মে নারীর পরিচয় ও নারীত্বকে গ্রহণ করা। এই হচ্ছে ট্রান্সজেন্ডার নামক টার্মটির ভাবার্থমূলক ব্যাখ্যা। যার সাথে সমাজে নিগৃহীত, নিষ্পেষিত হিজড়া জনগোষ্ঠীর দূরতম সম্পর্ক নেই। হিজড়া জনগোষ্ঠী গ্লোবাল পারস্পেকটিভে 'ইন্টারসেক্স' নামে পরিচিত। তাদের বহির্বিশ্বে ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় না। 

ইন্টারসেক্স দ্বারা বুঝায় যেসব লোকেদের, যাদের লৈঙ্গিক পরিচয় বুঝতে পারা যায় না। অর্থাৎ ব্যক্তিটি পুরুষ নাকি নারী তা আলাদা করতে পারার মাঝে জটিলতা দেখা দেয়। পাশপাশি একজন ব্যক্তির জন্যে এই সমস্যা জৈবিকভাবে প্রকাশ পায়। এটি জন্মগত হরমোনাল সমস্যা থেকে সাধারণত হয়ে থাকে। অন্যদিকে ট্রান্সজেন্ডার পরিচয় ব্যক্তির  ইচ্ছাবশত গ্রহণ করা এক কৃত্রিম পরিচয়। যা জন্মগত নয়। এটি সম্পূর্ণ মানসিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। বিপরীতে হিজড়া তথা ইন্টারসেক্স পরিচয়ের ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি তার শারীরিক প্রতিকূল অবস্থার স্বীকার। কেননা এ অবস্থার ওপর তার নিজস্ব কোনো প্রভাব ছিল না। 

ট্রান্সজেন্ডার পরিচয়কে যেভাবে হিজড়াদের ব্যবহার করে নরমালাইজড করা হচ্ছে, পাশাপাশি জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে ন্যাক্কারজনক ও হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকারের সাথে একপ্রকার তাচ্ছিল্যের কৌতুকও বটে। কেননা ট্রান্সজেন্ডার পরিচয় গ্রহণ সম্পূর্ণভাবে একজন লোকের ব্যক্তিস্বাধীনতার দরুন হয়ে থাকে। একইসাথে এটি অনেক জটিলতাও তৈরি করে। দেশের বিদ্যমান আইন, সামাজিক এবং নৈতিক মূল্যবোধের সাথে তা বহুলাংশে সাংঘর্ষিক।

একজন পুরুষ কৃত্রিমভাবে নারীর পরিচয় গ্রহণ করলেও সে শারীরিকভাবে ও জিনগত দিক থেকে পুরুষই রয়ে যায়। তার মাঝে XY ক্রোমোজোম বিদ্যমান থাকে। এর মাধ্যমে যদিও তাকে ট্রান্সজেন্ডার নারী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তবুও সে অভ্যন্তরীণভাবে একজন পুরুষই রয়ে যায়। দিনশেষে তা সমাজে অনেক জটিলতার সৃষ্টি করে। কেননা রূপান্তরিত তথা ট্রান্সজেন্ডার নারী যদি নিজের শারীরিক চাহিদা মেটাতে একজন পুরুষকে আকাঙ্ক্ষা করে তবে তা সমকামিতার চর্চাকে প্রমোট করবে। কারণ বায়োলজিক্যালি রূপান্তরিত নারীটি লোকচক্ষুর আড়ালে একজন পুরুষই থাকেন। শুধুমাত্র অবয়ব ধারণ করেন একজন নারীর। আর দেশের আইন অনুযায়ী তা সম্পূর্ণ অবৈধ।  

দেশের দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা মোতাবেক পায়ুমৈথুন তথা সমকাম শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ, যার শাস্তি দুই বছর থেকে শুরু করে দশ বছর কারাদণ্ড এবং উপরন্তু জরিমানাও আরোপযোগ্য। সুতরাং দেশীয় মূল্যবোধ, নীতি-আদর্শ, সংস্কৃতির আলোকে ট্রান্সজেন্ডার নামক সমাজ ও রাষ্ট্রীয় আইনবিরোধী মানসিক বিচ্যুতি এবং চর্চার বিরুদ্ধে সকলকে সজাগ হওয়া অতীব জরুরি।

সরকারের পলিসিমেকারদের উচিত চোখ-কান খোলা রেখে নীতি প্রণয়ন করা। পাশাপাশি মিডিয়া এবং এদেশে কার্যক্রম চালানো পশ্চিমা এনজিওগুলোর ওপর বিশেষ নজরদারি আরোপ করা। নয়তো আমাদের এক অনাকাঙ্ক্ষিত যুগের মধ্য দিয়েই যেতে হবে যার বলি হতে হবে শারীরিকভাবে সুস্থ নারী-পুরুষ, আমাদের অনাগত প্রজন্ম ও সামাজিকভাবে নিগৃহীত হিজড়া জনগোষ্ঠীকে।

লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ