৯৮ নম্বর পেয়েও গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করতে পারবেন না ১৬তম ইনডেক্সধারীরা

এনটিআরসিএ লোগো, এবং ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক
এনটিআরসিএ লোগো, এবং ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক  © ফাইল ফটাে

১৫তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার সনদ দিয়ে নিজ বাড়ি থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরের প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ পেয়েছিলেন মো. আনোয়ার হোসেন। নম্বর কম থাকায় তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে ভালো প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ পাননি। শিক্ষকতার পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ৯৮ নম্বর পেয়েছেন। আশা ছিল চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিজ বাড়ির কাছের প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ পাবেন। তবে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের আবেদনের সুযোগ সাময়িক বন্ধ রাখায় আনোয়ারের আর বাড়ির কাছে যাওয়া হচ্ছে না। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে আনোয়ার জানান, আমার বাসা রাজশাহীতে। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আমি চুয়াডাঙ্গার দর্শনা উপজেলার দারুসসুন্নাত সিদ্দিকীয়া ফাজিল মাদ্রাসায়  নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছিলাম। সেখানে যোগদান করার পর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছি। এই সনদ দিয়ে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে নিজ বাড়ির কাছের প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ পাওয়ার আশা ছিল। তবে ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগ বন্ধ করায় আমি আর সেই সুযোগ পাব না। 

আনোয়ারের মতো আরেক প্রার্থী নজরুল ইসলাম। ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯৭ নম্বর পেয়েছেন। স্ত্রী-পরিবার ছেড়ে হাওড় অঞ্চলের একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন। তবে তিনিও নিজ বাড়ির কাছের প্রতিষ্ঠানে যেতে চান। তবে হঠাৎ করে একটি সিদ্ধান্ত তার সেই আশায় গুড়েবালি দিয়েছে। স্বপ্ন ভঙ্গের পথে নজরুলের।

নজরুল ইসলাম জানান, অনেক কষ্ট করে ১৬তম নিবন্ধন পরীক্ষায় ৯৭ নম্বর পেয়েছি। তবে আমাদের আবেদনের সুযোগ নিয়ে যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে তা হতাশার। বর্তমানে আমি হাওড় অঞ্চলে কর্মরত আছি। বর্তমান প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করে স্ত্রীর কর্মস্থলের পাশে কিংবা ঢাকায় আসতে আগ্রহী। পরিবার-পরিজনের কাছে যাওয়ার সুযোগ হিসেবে ১৬তম সনদ দিয়ে অন্তত একবার আবেদনের সুযোগ চাই।

শুধু আনোয়ার কিংবা নজরুল নন; ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার সনদ অর্জন করেছেন এমন অসংখ্য শিক্ষকের স্বপ্ন ভঙ্গের পথে। নিজ বাড়ি থেকে শতশত কিলোমিটার দূরের প্রতিষ্ঠানে মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকায় চাকরি করছেন এই শিক্ষকরা। ১৬তম নিবন্ধন পরীক্ষায় অনেক ভালো নম্বর পেয়েও ইনডেক্স থাকার কারণে আবেদনের সুযোগ হারাতে হচ্ছে তাদের। বিষয়টির সমাধান চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এনটিআরসিএ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে স্মারকলিপিও জমা দিয়েছেন শিক্ষকরা। তবে কোনো পক্ষই তাদের এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়নি।

ভুক্তভোগী শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার ৭ নম্বর ধারার কার্যকারিতা সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। এই ধারার বদৌলতে এতদিন ইনডেক্সধারী শিক্ষকরা গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুযোগ পেয়েছেন। তবে ধারার কার্যকারিতা স্থগিত করায় ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগ রহিত করা হয়েছে। এর ফলে যারা ১৬তম নিবন্ধনে ভালো নম্বর পেলেও আবেদনের সুযোগ পাবেন না তারা।  

শিক্ষকরা জানান, এনটিআরসিএ প্রতিষ্ঠা হয়েছে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করার জন্য। তারা সেই কাজটি বেশ সুনামের সাথেই করে যাচ্ছে। তবে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে ১৬তম নিবন্ধনের সনদ অর্জনকারী ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের আবেদনের সুযোগ না দিলে জাতি মেধাবী শিক্ষক পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। আমরা সর্বশেষ ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধনের সনদ দিয়ে একটি গণবিজ্ঞপ্তিতেও আবেদনের সুযোগ পাই নি। এমনকি তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতেও আবেদনের সুযোগ পাইনি। করোনা-লকডাউন ও নানা কারণে দীর্ঘ ৪ বছর অপেক্ষা করেছি। এত কিছুর পরও এত কষ্টে অর্জিত আমাদের এ ১৬তম সনদে আবেদন করতে না পারলে এ সনদ আমাদের কী কাজে আসবে আর এর মূল্যই বা কী? তাই যেকোনো শর্ত দিয়ে হলেও আমরা চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুযোগ চাই।

১৪তম শিক্ষক নিবন্ধনের সনদ দিয়ে ইনডেক্স পাওয়া শিক্ষক টুম্পা ঘোষ। ১৬তম নিবন্ধনে তিনি ৮৮ নম্বর পেয়েছেন। হতাশা প্রকাশ করে এই শিক্ষক জানান, আমি বাবা-মায়ের আয়ের একমাত্র অবলম্বন হওয়ায়  স্বামীর কর্মস্থল থেকে অনেক দূরে চাকরি করতে হচ্ছে। ফলে নিজের স্বামী, সমাজ ও আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে অনেক কথা শুনতে হয় যা আমাকে দিন দিন মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আসন্ন ৪র্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে ১৬তম সনদ দিয়ে আবেদন করতে পারলে আমার সব কষ্টের অবসান হবে এই আশাতেই সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করছি। এখন যদি আমি ১৬তম সনদ দিয়ে অন্তত একবার হলেও যেকোনো শর্তে আবেদন করতে না পারি তবে আমার আত্মহত্যা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকবে না।

মো. আব্দুস সালাম নামে আরেক শিক্ষক জানান, ১৫তম নিবন্ধনে শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের সনদ দিয়ে ইনডেক্স পেয়েছি। ১৬তম নিবন্ধন পরীক্ষায় ৮৮ নম্বর পেয়েছি। নিজ বাড়ি থেকে ৫৫০ কিলোমিটার দুরে একটি নির্জন পল্লীতে চাকরি করতে হচ্ছে আমাকে। আমার মার বড় আশা ছিল যে, আমি বাড়ির পাশে চাকরি করবো। কিন্তু হঠাৎ করে আমার মায়ের এই স্বপ্ন এভাবে ভেঙ্গে যাবে, তা বুঝতে পারিনি।

তিনি আরও বলেন, আমার বৃদ্ধ মা-বাবাকে আমি ছাড়া দেখার কেউ নেই। আমি ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে চাকরি করি। বর্তমান বাজার অনুযায়ী এই টাকা দিয়ে আমার নিজের চলতেই কষ্ট হয়। খেয়ে না খেয়ে কোনো রকম দিন পার করি। এই অবস্থায় আমার সব আশা ভেঙ্গে গেল। সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের কাছে আমার একটাই দাবি যেকোনো মূল্যে যেন আমাদের আবেদনের সুযোগ দেয়। 

পরিতোষ কুমার বিশ্বাস বলেন, নিজ বাড়ি হতে ৫৫০ কিলোমিটার দূরে একটি প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলে  চাকরি করি। এই অল্প বেতন দিয়ে দিনাতিপাত করা খুবই কষ্টকর। বিশেষ করে বাবা-মাকে ছেড়ে এত দূরে থাকা এই বেতনে আর সম্ভব হচ্ছে না। ১৬তম নিবন্ধনে আমি ৮৫ নম্বর পেয়েছি। এই নম্বর দিয়ে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করার সুযোগ দিলে আমি নিজের বাড়ির কাছের প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ পাব। বাড়ি কাছে গেলে বাবা-মায়ের সেবা করতে পারবো। তাই যেকোনো শর্তে ১৬তম নিবন্ধনের সার্টিফিকেট দিয়ে ইনডেক্সধারীদের ৪র্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুযোগ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

শিক্ষকদের এসব বিষয়ে জানতে এনটিআরসিএ’র চেয়ারম্যান এনামুল কাদের খানকে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে প্রতিষ্ঠানটির সচিব দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগের বিষয়টি সাময়িক স্থগিত করেছে মন্ত্রণালয়। ১৬তম নিবন্ধনের সনদধারীরা চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুযোগ চেয়ে আমাদের কাছে লিখিত দিয়েছেন। আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে দেখবো।


সর্বশেষ সংবাদ