ছাত্র রাজনীতির সুদিন ফিরবে কবে?

ছাত্র রাজনীতি
ছাত্র রাজনীতি  © সংগৃহীত

বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায় হয়েছে। রায়ে ২০ আসামিকে ফাঁসি এবং ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। আদালত বলেছেন, ২৫ আসামির সবাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। আসামিরা সবাই বুয়েটের শিক্ষার্থী  এবং একই হলে থাকতেন তারা।

দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। কঠিন ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েই তারা এখানে পড়ার সুযোগ পান। তাদের শৈশব-কৈশোরও কেটেছে মেধাবী ও ভদ্র ছেলের তকমা নিয়ে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই কেন তারা সহিংস হয়ে পড়ছেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা সহিংস আচরণের পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ‘এ সমস্ত ঘটনাগুলো দুঃখজনক। এগুলোর জন্য নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দায়ী নয়।’

আরও পড়ুন- ছাত্ররাজনীতির একাল সেকাল

ছাত্র নিগ্রহের এসব ঘটনার পর বরাবরই অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি করেন। আবরার হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটে কমিটি থাকলেও সরাসরি কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে ছাত্রসংগঠনগুলো। এ রায়ের পর বিভিন্ন সময়ে নিহত নেতাকর্মীদের হত্যার বিচারের দাবিতে কর্মসূচি পালন করেছে ছাত্রলীগ। 

সম্প্রতি খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষক ড. সেলিম হোসেনের মৃত্যু ঘিরেও রহস্য তৈরি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ছাত্রলীগের একটি পক্ষের চাপে পড়ে তিনি মৃত্যুবরণ করে থাকতে পারেন। প্রতিষ্ঠানটিতেও ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আওয়াজ উঠেছে। আলোচনায় এসেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলের সংঘর্ষের ঘটনা। আহত শিক্ষার্থীর মাথার খুলি খুলে রেখে চিকিৎসা দেয়ার ছবি ভাইরাল হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা চলার সময়েই ছাত্রলীগের দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে কর্তৃপক্ষ কলেজের হলগুলো বন্ধ করে দেন। এসব ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ১৫০ জন খুন হন। তাদের মধ্যে ১৪৬ জন শিক্ষার্থী।

আরও পড়ুন- ছাত্র রাজনীতি নয়, অপরাধী সংগঠন নিষিদ্ধ করুন

তবে ছাত্র রাজনীতি নয়, এর নামে যে অপরাজনীতি রয়েছে তা বন্ধ করতে হবে বলে মত দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আবরারের ঘটনার মতো আমরা আর কোন ঘটনা দেখতে চাই না। এই অপরাজনীতি কোনভাবেই চলতে পারে না। দেশের ও মানুষের প্রয়োজনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির চর্চা হোক সেটাই চাই।’

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশ স্বাধীন এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সফলতার সিংহভাগই এসেছে ছাত্র রাজনীতির হাত ধরেই। কিন্তু ষাটের দশকের ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল সেই ইতিহাস পরবর্তীতে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারে নি। বারবারই হোঁচট খেয়েছে। মূল দলের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার হাতিয়ার হয়েছে ছাত্র সংগঠনগুলো। অর্থ উপার্জন ও আধিপত্য ধরে রাখার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সংগঠনগুলো। যার কারণে শিক্ষার্থীরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সংগঠনগুলো থেকে।   

আরও পড়ুন- করোনাকালে নাজুক জাবির ছাত্র রাজনীতি, বাড়ছে কোন্দল-হতাশা

ক্যাম্পাসগুলোতে দেখা যায়, হলগুলোতে কর্তৃপক্ষের সমান্তরাল প্রশাসন চালায় ছাত্র সংগঠনগুলো। কাগজ-পত্রে স্বাক্ষর করা ছাড়া হল প্রশাসনের কার্যত আর কোনো ভূমিকাই থাকে না। হলে শিক্ষার্থী ওঠানো, কক্ষ বরাদ্দ, হলের বিভিন্ন নিয়োগ, ক্যান্টিনে নিয়োগ সবই করে সংগঠনগুলো। ফলে শিক্ষার্থীরা বাধ্য থাকে সংগঠনগুলোর প্রতি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিভিন্ন কাজে তাদের থাকতে হয়। র‌্যাগিং, গেস্টরুম নির্যাতনে অতিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক বিমুখ হয়ে যান সহজেই। যার কারণে জাতীয় রাজনীতিতে ক্ষমতার পালাবদল হলে ছাত্র সংগঠনগুলোর কর্মী সংখ্যারও রদবদল হয়।

ক্যাম্পাসগুলোতে অপরাজনীতি বন্ধে চলমান রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন জরুরি বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খান। তিনি বলেন, ‘এখন দেখা যায়, ক্ষমতায় যারা থাকেন বা আগে পরেও যারা ছিলেন তাদের ছাত্র সংগঠনগুলো মাস্তানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেখতে হবে জাতীয় রাজনীতিতে কাদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। টাকা খেয়ে খারাপ লোকটিকেই মনোনয়ন দিয়ে একটা জায়গায় নিয়ে আসছি। নেতা বানাচ্ছি। তারাই পরে ছাত্র সংগঠনগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে ছাত্র রাজনীতির সুদিন ফিরবে না।’


সর্বশেষ সংবাদ