১৪ বছর বেতন নেই, বন্ধ হয়ে গেল বিদ্যালয়
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৯ PM , আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩০ PM
‘আঁই আগে স্কুলে যাইতাম। এক বছর হইছে, স্কুলে আর যাই না। এহন নদীতে আব্বার লগে মাছ ধরতে যাই। আঁর খুব ইচ্ছা, লেয়াহড়া করতাম। আঁর মতন অনেক গুণ হোলা-মাইয়া স্কুলে আহেনা। হেগুনরাও হেগুনগো আব্বারলগে কাম করতে নদীত যায়। এহন আঙ্গোরে স্কুলের স্যার ও ম্যাডামরাও ডাহে না। স্কুল কি আর খুলবো না? আঙ্গোরে কি নতুন বই দিবো না? যদি আবার চালু হয়, আন্ডা বেজ্ঞুন স্কুলে যাইয়াম। টিউনো (ইউএনও) স্যাররে কন আঙ্গো স্কুলকান সুন্দর করি দিতে।’
বৃহস্পতিবার দুপুরে (২ জানুয়ারি) লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ চরবংশী ইউপির চরকাচিয়া আশ্রয়কেন্দ্র বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ পাওয়া যায়। স্কুলটির পাশে মেঘনার পাড়ে দেখা হয় চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আবিরের সঙ্গে। এভাবেই সে এসব কথা বলে।
১৪ বছর পর বিনা বেতনে পাঠদান করার পর ২০২৩ সালে বিদ্যালয়ের বন্ধ করে দেন শিক্ষকরা। গত ১ জানুয়ারি নতুন বছরের প্রথম দিন রায়পুরের সব স্কুলে বই উৎসব হলেও বঞ্চিত ছিল রায়পুর মেঘনার পাড়ে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মিত জেলেপল্লি-অধ্যুষিত আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসকারী ১২০টি জেলে পরিবারের শিশুদের জন্য নির্মিত স্কুলের শিক্ষার্থীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১১ সালের ১ জুলাই রায়পুরের মেঘনা নদীর পাড়ে আশ্রয়কেন্দ্র ও আবাসনকেন্দ্রে বসবাসকারী ১৬০ পরিবারের শিশুদের জন্য নির্মাণ করা হয় চরকাচিয়া আশ্রয়কেন্দ্র বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই স্কুলের দুই কিলোমিটারে এক কিন্ডারগার্টেন স্কুল ছাড়া সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি।
লক্ষ্মীপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমানের নির্দেশে রায়পুরের সাবেক ইউএনও শারমিন আলম মেঘনার পাড়ে সরকারি খাসজমির ৪ শতাংশ খালি জায়গায় ওই স্কুলটি নির্মাণ হয়। স্কুলটি সেমিপাকা ভবনের চারটি কক্ষ ও দুটি টয়লেটও রয়েছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. চান মিয়া, সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগম, খালেদা খানম, ঝুমুর রানী দে, আসমা আক্তার ও তানিয়া বেগম। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ১৩০ জন শিক্ষার্থী ছিল।
সরকারিকরণে শর্তপূরণের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানের নামে জমি বরাদ্দ, অবকাঠামো, শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি, আসবাবপত্র ও নিয়মিত পাঠদানপ্রক্রিয়া চালু থাকলেও দীর্ঘদিন থেকে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিতে হচ্ছিল এখানকার শিক্ষকদের। কেউ কেউ মুদি দোকান, টিউশনি করে বা বিকল্প উপায়ে সংসার চালাচ্ছেন। উপজেলা প্রশাসনের ফান্ড থেকে কয়েক মাস শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি সরকারি না হওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন শিক্ষকসহ পরিবার।
প্রাথমিক শিক্ষা অফিস জানায়, উপজেলায় ১২১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৮০টি কেজি স্কুল, ১টি সরকারিসহ ৬টি বেসরকারি কলেজ, এমপিওভুক্ত ৫১টি মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান (১৮ মাদরাসা ও ৩৩টি উচ্চবিদ্যালয়) রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পূর্ণাঙ্গভাবে, কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিম্নমাধ্যমিক থেকে উচ্চ স্তর, কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে কলেজে উন্নীত করে এমপিওভুক্তি এবং কিছু প্রাথমিক সরকারিকরণের অপেক্ষায়।
চরকাচিয়া আশ্রায়ন প্রকল্পের বাসিন্দা মাইনুদ্দিন মাঝি, হাফিজুল্লাহ মাঝি ও গৃহবধু ছালমা বেগম বলেন, সাবেক জেলা প্রশাসক অনেক ভালো মনের মানুষ ছিলেন। প্রায় সময় চরে আমাদের অসহায় দিনমজুর ও জেলে পরিবারদের দেখতে আসতেন। আমাদের সন্তানরা ভালো লেখাপড়া করবে ও উচ্চ শিক্ষিত হবে, এই ভেবে স্কুলটি নির্মাণ করেন। বই ছাড়া শিশুদের উপবৃত্তি দেওয়া হয় না। মোটা বেতন দিয়ে সন্তানদের কিন্ডারগার্টেনও পড়াশোনা করাতে পারছি না। দূরের কোনো প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে সাহস পাই না। কেউ নদীতে মাছ ধরতে নদীতে, কেউ মাদকাসক্ত, কেউ জুয়া ও কেউ চুরি করার মতো নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটা স্কুল আছে, বর্তমান ইউএনও মনে হয় জানেনই না।
প্রধান শিক্ষক চান মিয়া বলেন, ‘স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয় মেঘনার পাড়ে অসহায়-নিরীহ জেলে ও দিনমজুর পরিবারের শিশুদের সুশিক্ষার জন্য। সাবেক ইউএনওরা শিক্ষকদের কিছু সম্মানী ভাতাও দিয়েছিলেন। বর্তমান ইউএনও শিক্ষকদের মোট ১৩ হাজার টাকা করে তিন মাসের বেতনও দিয়েছিলেন। এখন আর বেতন দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেন। বেতন না পেয়ে চাকরি করছি বলে নিজেকে অন্যের কাছে উপস্থাপন করা লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই হাজারো কষ্ট নিয়ে স্কুলটি বন্ধ করা হয়।
রায়পুর শিক্ষা কর্মকর্তা মইনুল ইসলাম বলেন, শুধু মেঘনার পাড়ে চরকাচিয়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ই না, সব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য শুধু বই বিতরণ ছাড়া অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। ইউএনওর সঙ্গে কথা বলে দেখেন।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও স্কুলের সভাপতি ইমরান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন, শিগগিরই তিনি বিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন।
সূত্র : যুগান্তর