শহীদ না হওয়ার আক্ষেপ, শহীদ পরিবারের সদস্য হতে চান জামায়াত আমির

ডা. শফিকুর রহমান
ডা. শফিকুর রহমান  © টিডিসি

‘আমার আফসোস এবারের এ যুদ্ধে আমি শহীদের পরিবারের একজন হতে পারলাম না। এ সৌভাগ্য যাদেরকে আল্লাহ দান করেছেন তাদেরকে আমার ঈর্ষা হয়। আমি যদি তাদের একজন হতাম। আমরা আজকে ঘোষণা করতে এসেছি আমরা আপনার পরিবারের সদস্য হতে চাই।’ এভাবেই নিজের মনের আকুতি ব্যাক্ত করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। 

শফিকুর রহমান আরও বলেন, ‘সমস্ত শোক একত্র করে আমরা শক্তিতে রূপান্তর করব। আমরা অঙ্গীকার নেব যে আমরা শহীদদের মর্যাদা রাখবো।’ বৃহস্পতিবার (২৯ আগষ্ট) নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাথে মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন তিনি।

জামায়াতের আমির বলেন, ‘জামায়াত ইসলামী একটি ইসলামী রাজনৈতিক দল। আমরা চাই রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়ারে সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব বসুক। যারা গদিকে নিজেদের বাপ-দাদার সম্পদ মনে করবে না। আর জনগণকে নিজেদের দাস বানাবার চিন্তা করবে না। বরং জনগণের চৌকিদার হিসেবে নিজেদের মনে করবে, জনগণ ঘুমাবে শান্তিতে আর উনারা রাত জেগে পাহারা দেবে জনগণকে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আসলে আমাদের ইতিহাস বড়ই বিচিত্র। ইতিহাসের পালা বদলে আমরা বন্ধুকে শত্রু বানাই, শত্রুকে বন্ধু বানাই। এরকম যে জাতি করে সে জাতি কোনোদিন বিশ্বের দরবারে ও নিজের বিবেকের কাছে সম্মানিত হতে পারে না। অপসংস্কৃতির এ যন্ত্রণা থেকে এ জাতিকে বের হয়ে আসতে হবে। যার যেখানে যে অবদান জাতির জন্য এটা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা আজকে শহীদ পরিবারের কাছে এসেছি সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য নয় বরং আমরা এসেছি অনুপ্রেরণা নেওয়ার জন্য। তারা বড়ই সৌভাগ্যবান শুধু শহীদদের হাশরের দিনে আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, তুমি তোমার জীবনের সর্বোচ্চ সম্পদ আমার জন্য দান করেছো। আজকে আমি আমার জান্নাতের সব দুয়ার তোমার জন্য খুলে দিলাম।’

আমিরে জামায়াত বলেন, এই আন্দোলন সংগ্রামে জাতি, ধর্ম ও দলের মধ্যে কোন ব্যবধান ছিল না। এখানে অন্য ধর্মের অনেক লোকও নির্মমভাবে মারা গেছেন। আমরা এদের সকলকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করব। জাতি হিসেবে আমরা ঋণী। আজীবন যেন এ জাতি এ ঋণের অনুমতি নিয়ে চলে এবং ঋণ আদায়ের চেষ্টা করে আল্লাহর কাছে। আমি এ সরকার সম্পর্কে কিছুই বলবো না। তাদের বিষয়টা আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দিলাম। রক্তের এক একটা ফোয়ারা মিলিত হয়ে রক্তের প্লাবন সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের এমন কোনো জনপদ নেই যেটা রক্তাক্ত হয়নি।

তিনি আরও বলেন, ‘শহীদরা তো মহা সৌভাগ্যবান। তারা চলে গেল। মায়েরা তাদের ফিরিয়ে আনার কথা বলবেন না। তারা জান্নাতের পথের অগ্রসৈনিক। বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়িতে আহত ভাই-বোনদেরকে দেখতে গিয়েছি। কলিজা ফেটে গেছে। যখন দেখেছি যুবক ছেলে দুই চোখে গুলি লেগে অন্ধ হয়ে গেছে। আহ্! সে তো আর জীবনে আলো দেখবে না। আলো নিভে গেছে তার। যতদিন বেঁচে আছে কারো সাহায্য ছাড়া একটা কদমও ফেলতে পারবে না।’ 

এদের বাবা মাকে আমরা কি সান্ত্বনা দেব। এদের আপন জনকে আমরা কি সান্ত্বনা দেব। সেদিন এ নারায়ণগঞ্জে এসেছিলাম। আমাদের শহীদ বোন সুমাইয়া। তার আড়াই মাসের নিষ্পাপ শিশুর দিকে তাকাইয়া আমরা নিজেদের ধরে রাখতে পারিনি। ও কারে মা বলে ডাক দেবে। একটা বাচ্চার সবচেয়ে বেশি সম্পর্ক তার মায়ের সঙ্গে। ওই মায়ের রক্ত খেয়ে কে সে বড় হয়েছে। সে তার মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন। যখন সে দেখবে অন্য বাচ্চারা মা মা বলে ডাকছে তখন সে মা বলার জন্য কাউকে খুঁজে পাবে না। ওদের আমরা কি সান্ত্বনা দেব।

যারা ক্ষমতার জন্য এত বেপরোয়া হয়ে গেল তারা কি একটা বারও চিন্তা করলো না যে এরাও মানুষ। এরা এদেশের নাগরিক। আমরা কত বাচ্চাকে এতিম করে দিয়েছে। কত যুবতি মেয়েকে বিধবা বানিয়ে ফেলেছে। কত বাবাদের বুক ভেঙে দিয়েছে। একটাবারও কি তারা চিন্তা করল না।

শেখ হাসিনার পতনকে তৃতীয় স্বাধীনতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সবাই বলছে এটা আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা আমার দৃষ্টিতে এটা আমাদের তৃতীয় স্বাধীনতা। ১৯৪৭, ১৯৭১ আর ২০২৪। এ তৃতীয় স্বাধীনতার বীরদের বীরত্ব গাথা আমাদের পাঠ্যপুস্তকসহ সব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্থান করে দিতে হবে। এটা তাদের পরিবারের চাহিদা নয় এটা আগামী প্রজন্মের চাহিদা। আগামী প্রজন্ম জানবে যে আমাদের আগের তরুণরা, যুবকরা এদেশের মানুষরা হকের পক্ষে বুক টান করে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা বলেছিল বুকের ভিতর তুমুল ঝড় বুক পেতেছি গুলি কর। আমরা আমাদের জাতির জন্য বুক পেতে লড়াই করব যদি একটা জাতি সেরকম দাঁড়িয়ে যায় কোনো স্বৈরাচার সেখানে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।’

রাজশাহীতে গিয়েছিলাম। একটা ভাই রিকশা চালিয়ে কোনো রকমে জীবন চালায়। ওই সময় সে যুবক মানুষ নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। রিকশা গ্যারেজে ফেলে এক কলসি পানি নিয়ে, একটা গ্লাস হাতে নিয়ে দৌড়ে গেছে। যারা এ কঠিন রোদের মধ্যে কষ্ট করতেছে তাদের হাতে একটু পানি তুলে দেবে। পানি খাওয়া শেষ। কলসি একদিকে রেখে সেও নেমে গেছে ওদেরকে সাহায্য করতে। জালিমের তিনটা বুলেট এপার ওপার করে তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিছে। তার বিয়ে হয়েছে এক বছর হলো তার স্ত্রী পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমি চিন্তা করলাম এ মেয়েটা যদি আমার ঔরসজাত মেয়ে হতো তাহলে আমার অনুভূতি কি হতো।

আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম মারে তোমার অনুভূতি কি তুমি কেমন আছো? আমাকে বলল বাবা আমি যেমন থাকি, আমি আমার গর্ভের সন্তান নিয়ে চিন্তিত। ওর কি হবে? ওতো একজন গরিব রিকশাওয়ালার সন্তান, আমার পেটে রেখে দিছি। আমি কি পারব তাকে মানুষ করতে। এ মেয়েটাকে বললাম আজকে থেকে তুমি আমার মেয়ে তোমার যাবতীয় দায়িত্ব বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী কবুল করলো। তোমাদের বেঁচে থাকা বেড়ে ওঠা আল্লাহই রহমত দেবে। মানুষ হিসেবে আমরা তোমার পাশে থাকবো। এখন থেকে প্রতি মাসে তোমাদের চলার মতো একটা অংশ তোমাদের কাছে পৌঁছে যাবে ইনশাআল্লাহ। তোমার এ বেবি দোয়া করি দুনিয়ায় আসুক। মেয়ে হোক ছেলে হোক আল্লাহ যা পছন্দ করেছে তোমার জন্য যেন চক্ষু শীতলকারী হয়। ও বড় হওয়া পর্যন্ত লেখাপড়া সহ যা কিছু প্রয়োজন ইনশাআল্লাহ আমরা দায়িত্ব নিলাম।

যেখানে যাই নিজেকে ধরে রাখতে পারি না আমাদের এত টাকা পয়সা  নেই কিন্তু আল্লাহর ভাণ্ডারে কোন কমতি নাই আমরা তার ওপর ভরসা করে এ কথাগুলো বলেছি আল্লাহ যেন আমাদের ওয়াদার জায়গা ঠিক রাখেন। অনেক শহীদ পরিবারের সঙ্গে আমাদের মোলাকাত হয়েছে। তারা বলছেন আমাদের কোনো আর্থিক সহায়তা লাগবে না আপনারা এসেছেন আমরা প্রশান্তি পেয়েছি। এ জাতি যেন আমার সন্তানকে ভুলে না যায়।

আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বসেছিলাম। আমরা বলেছি যে পরিবারগুলো আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন তাদের জন্য অর্থবহ সহায়তা দেওয়ার। পদক্ষেপ আপনারা করবেন। এবং রাষ্ট্রের সব খাতের সঙ্গে এটাকে আপনারা সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেবেন। আহতদের চিকিৎসা সর্বোচ্চ যেটা সম্ভব দেওয়ার চেষ্টা করুন। আমরা আপনার পাশে আছি। তারা কথা দিয়েছে এটা করবেন।

শহীদের রক্ত শুকিয়ে গেছে। সেটা যেন আমাদের অন্তর থেকে চলে না যায়। এখনো অনেক লোক নিখোঁজ আছে। কোথায় তাদের লাশ তাদের আপনজন কেউ জানে না। আসলেই কি তারা জীবিত নাকি লাশ হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে কেউ জানে না। সে রাতগুলোতে অনেক অপকর্ম হয়েছে৷ যেমনটি হয়েছিল ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরে। সারাদেশ থেকে আসা ওলামায়ে কেরামদের সঙ্গে যে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে৷ সেই রাতের লাশগুলো কোথায় গেছে কেউ জানে না।

তিনি আরও বলেন, আমরা চেষ্টা করছি সারাদেশে যারা এরকম নিহত হয়েছেন তাদের তথ্য সংগ্রহ করতে। আমাদের তথ্য সংগ্রহকারীরা হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক জায়গায় গিয়ে তারা মায়েদের বুকফাটা কান্না সহ্য করতে পারছেন না। তারা বলে বাবা আমার ছেলেটা কোথায় আছে একটু বলতে পারবা? এ মায়ের কাছে এ জাতি কী জবাব দেবে।


সর্বশেষ সংবাদ