সরকারি চাকরিতে বয়স বৃদ্ধি: কার লাভ, কার ক্ষতি?
- মোহাম্মদ রনি খাঁ
- প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:৩২ PM , আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১০:০৩ PM
শাকিল আহম্মেদ, পড়েছেন দেশের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্প্রতি স্নাতক শেষ করেছেন। তবে এখনো কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান-ব্যাংকে চাকরির আবেদনে করেননি তিনি। কেবল চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চাকরিতে বয়সসীমা ৩৯ মাস বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন। এ নিয়েই কিছুটা হতাশ সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করা শাকিল। এর কারণ চাকরিতে বয়সসীমা বৃদ্ধি চাকরির প্রতিযোগিতায় তুলনামূলক প্রতিযোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ ব্যাপারে সদ্য স্নাতক পাস করা এ শিক্ষার্থী জানান, আমাদের যাদের বয়স ৩০ এর নিচে রয়েছে, এখন থেকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে গেলেন ৩২-৩৩ বছরের অভিজ্ঞরা। এক্ষেত্রে দুই বছর যাদের ক্ষতি হয়েছে, তাদের চাকরির বাজার আরও কঠিন হয়ে গেল। আর চাকরির পরীক্ষায় অভিজ্ঞতা সম্পন্নরা আরও সুযোগ পেলেন।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে নানা রকম আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কেউ কেউ ক্ষেত্র বিশেষে বিশ্লেষণসহ তাদের মতামত তুলে ধরছেন।
চাকরি প্রার্থীদের একটি অংশ দাবি করছেন, ২০০৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এভাবে চাকরির আবেদনের বয়সসীমা না বাড়িয়ে বরং কেন্দ্রীয়ভাবে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা মোটের ওপর বাড়িয়ে দিলেই এরূপ ঝামেলা হতো না এবং দুপক্ষের সঙ্গেই যৌক্তিক বিচার করা হতো। এতো সহজ সমাধান থাকতে কেন এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো এমন প্রশ্নও করেছেন অনেকে।
চাকরি প্রার্থীদের আরেকটি অংশ বলছেন, এমন সিদ্ধান্তের ফলে কেউ কেউ ৩৯ মাসই ছাড় পাবেন। কিন্তু সবাই সমান ছাড় পাবেন না। বয়সভেদে কেউ কেউ ২৭ মাস, কেউবা আবার ১৬ মাস, কিংবা ১-৬ মাস। এদের মধ্যে একটি অংশ আবার কেবলমাত্র এক থেকে সাতদিন পর্যন্তও ছাড় পেতে পারেন। এটা কোন ধরনের যৌক্তিক বিচার হতেই পারে না। এটা প্রহসন।
বয়স ছাড়ের ওপর কেবল হিসাব-নিকাশে ‘বিসিএস ইন্সেপশন’ নামক একটি ফেসবুক পেইজ এক বিশ্লেষণে জানাচ্ছে, ‘৩০-০৬-২০২০ তারিখে যাদের বয়স ২৬ বছর ছিলো, তাদের ক্ষতি বয়স ছাড়ের পুরোটাই মানে ৩৯ মাস। একই তারিখে যাদের বয়স ২৭, তাদের ক্ষতি বয়স ছাড়ের পুরোটাই। এছাড়া ৩০-০৬-২০২০ তারিখে যাদের বয়স ২৮ বছর ছিলো, তাদের ক্ষতি বয়স ছাড়ের ওপর ২৭ মাস।
আরও পড়ুন : সময় লাগবে ৪১তম বিসিএসের ফল প্রকাশে
পেইজটি সে পোস্টে আরও জানাচ্ছে, ‘৩০-০৬-২০২০ তারিখে যাদের বয়স ২৯ বছর ছিলো, তাদের লাভ বয়স ছাড়ের ওপর ২৭ মাস। এছাড়া ৩০-০৬-২০২০ তারিখে যাদের বয়স ৩০ বছর ছিলো, তাদের লাভ বয়স ছাড়ের ওপর ৩৯ মাস।’
এ ব্যাপারে তরিকুল ইসলাম সোহেল নামে এক চাকরিপ্রার্থী জানান, ‘করোনা তাদের ওপর তো কোন প্রভাবই পরে নাই অথচ তাদের বয়সসীমা বাড়ানো হল। এটা অযৌক্তিক, এটা বৈষম্য, এটা অবিচার।’
তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এহেন সিদ্ধান্তে বয়সসীমা বৃদ্ধির সুবিধা পাচ্ছেন, তাদের অনেকেই এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
তারা বলছেন, এটা কোন স্থায়ী কোনো সমাধান হতে পারেন না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভুক্তভোগী হবেন। তাদের সঙ্গে অন্যায় করা হবে। এর ফলে আগামী প্রজন্মও বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবি জানাবেন। যা কালক্রমে বিস্তর আন্দোলনে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।
এ বিষয়ে মো. রানা নামে আরেক চাকরিপ্রার্থী জানান, এটা একটা বৈষম্যমূলক সমাধান। কোন স্থায়ী সমাধান না বরং বৈষম্য আরও বাড়বে। কারণ এখন যাদের বয়স ৩০ হয়নি, তারা আসলে কিছুই পাবে না, তারা বৈষম্যের শিকার হবে এবং আন্দোলন চলমান থাকবে। স্থায়ীভাবে বয়সসীমা বৃদ্ধিই একমাত্র সমাধান। আর না হলে বংশ পরম্পরায় আন্দোলন চলতে থাকবে।
আরও পড়ুন : এখনো পিঠে ও পায়ে ব্যথা সেই হাসনাত আবদুল্লাহ’র
এ ব্যাপারে রাশেদুজ্জামান নামে এক চাকরিপ্রার্থী জানান, ‘আমারও বয়স ১০ অক্টোবর, ২০২০ শেষ হয়েছে। তাই আমিও এই সুবিধার অন্তর্ভুক্ত কিন্তু এতে প্রকৃত ক্ষতি যাদের বয়স ২০২২ বা ২০২৩ এ শেষ তাদেরই বেশি হয়েছে। তাই স্থায়ী বয়স বাড়ালেই সকলের জন্য ভালো। তাই যারা আন্দোলন করছেন তারা পিছিয়ে যাবেন না, বরঞ্চ আরও শক্তভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন।’
এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তকে চলমান ‘চাকরি আবেদনে বয়সসীমা-৩৫ চাই’ আন্দোলনকে দ্বিধাবিভক্ত এবং স্তিমিত করে দেওয়ার ফাঁদ হিসেবেও দেখছেন চাকরিপ্রার্থীদের একটি অংশ।
চাকরিতে বয়সসীমা-৩৫ দাবি প্রার্থীরা বলছেন, এটি একটি ফাঁদ। এর ফলে পিএসসি এখন থেকে ১১তম গ্রেড পর্যন্ত সুপারিশ করবে। এর ফলে আলাদাভাবে ভালো কোন চাকরির সার্কুলার না আসার সম্ভাবনাও থাকছে।
তারা আরও দাবি করছেন, ২০২২ সালে এখন পর্যন্ত ভালো কোন চাকরির সার্কুলার আসেনি। আগামী ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত এ সম্ভাবনা অনেক কম। করোনা যাদের জীবন থেকে দুই বছর নিয়ে এসে তারা কিছু পায়নি। এছাড়া তাদের বয়স এখন ২৭-২৯ বয়স তারাও তেমন সুবিধা পাবেন না।
এ ব্যাপারে চাকরিপ্রার্থী রেজাউল করিম জানান, এটি একটি পরিকল্পিত ফাঁদ। আন্দোলনকে দ্বিধাবিভক্ত করতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটা প্রহসন! জাস্ট প্রহসন!
আরও পড়ুন : পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরম মন্ত্রণালয়ে পাঠাল এনটিআরসিএ
এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এমন এহেন সিদ্ধান্তে ভবিষ্যতে সরকারি চাকরিতে আসবেন এমন তৃতীয়/চতুর্থ বর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের একটি অংশও দ্বিধায় ভুগছেন। তারা বলছেন, আমরা কিছুদিন পর চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেবো। দিনদিন চাকরির বাজার কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এখন যারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বয়সসীমা ছাড়ের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তারা ভবিষ্যতেও চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবি জানাবেন। এর ফলে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবো।
এ ব্যাপারে স্নাতক চতুর্থ বর্ষ পড়ুয়া শিক্ষার্থী সানজানা ইসলাম জানান, এটা কোনো যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হতেই পারেন না। বয়স বৃদ্ধির সীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে, তাই বলে বয়সের ছাড় দেওয়া কোনো ধরনের স্থায়ী সমাধান হতেই পারে না। এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।