ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগস্ট ছাত্র আন্দোলন: স্মৃতির পাতা থেকে
- মো: নিজাম উদ্দিন
- প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২২, ০৯:৫১ PM , আপডেট: ২৩ আগস্ট ২০২২, ১০:২৭ PM
ওয়ান ইলেভেনের ফখরুদ্দিন মঈনউদ্দিন সরকারের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে একটি অস্থায়ী সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি একটি অস্বাভাবিক সরকারের সংকেত ছাড়া কিছুই ছিলনা। প্রায় ২৪ ঘন্টাই আবাসিক হল গুলোতে ছিল পুলিশ ও গোয়েন্দাদের নজরদারী। এরশাদের সামরিক শাসনের একটি নতুন সংস্করন তৈরি হতে যাচ্ছিল সে সময়। আজকের মেরুদেন্ডহীন পা চাটা বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই সেদিন যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনের নামে নতুন সুর তুলেছিল।
মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেন্দ্র, বাংলাদেশের গনতন্ত্রের মাতৃসদন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেদিন অতীতের মতই রুখে দাঁড়িয়েছিল, আজকের মত নিরব থাকেনি!
ঘটনার সূত্রপাত ২০ আগস্ট ২০০৭। ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সেদিন ডিপার্টমেন্টের ফুটবল খেলা চলছিল। মাঠের গ্যালারিতে বসাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের সাথে সেনাবাহিনীর কথা কাটাকাটি হয়।
এক পর্যায়ে সেনা সদস্যরা এক ছাত্রের গায়ে হাত তুলে। মুহূর্তের মধ্যেই সে খবর ছড়িয়ে পড়ে পুরো ক্যাম্পাসে। ছাত্ররা প্রতিবাদী অগ্নিমশাল হয়ে জ্বলে উঠে। সারা বাংলাদেশের সকল প্রতিষ্ঠানে এক যোগে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধায় সেনাক্যাম্প বিরোধী এক ঐতিহাসিক মিছিল ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনারের সামনে দিয়ে খেলার মাঠের দিকে এগুতে থাকে। অনেকেই রাগে, ক্ষোভে সেদিন নিজ নিজ জুতা ছুড়ে মাড়তে থাকে অস্থায়ী সেনাক্যাম্প ও পুলিশের দিকে। ছাত্রদের মিছিলটি সেনা ও পুলিশ সদস্যদের মাঝখানে পড়ে গেলে ব্যাপক গন পিটুনির শিকার হয় ছাত্ররা। স্লোগান মুখর ঝাঁঝালো মিছিলে প্রকম্পিত হয়ে উঠে সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস-
"আমাদের ক্যাম্পাসে, আমরাই থাকব
ক্যাম্পাসে সেনাক্যাম্প, মানিনা মানবনা "
সৌভাগ্যক্রমে সেদিনের সেই প্রতিবাদ প্রতিরোধের মিছিলে প্রথম বর্ষের একজন ছাত্র হিসাবে আমি ও ছিলাম। আর্মি পুলিশ বনাম ছাত্রদের সংঘর্ষে আমি চরমভাবে আহত হলে বন্ধু রাসেল (এখন পুলিশ অফিসার) আমাকে সূর্যসেন হলের বিতর্ক ধারার রুমে কোলে করে নিয়ে আসে। অবস্থার অবনতি হতে থাকায় দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজে আমাকে ভর্তি করা হয়।
একটু পরেই একই কেবিনে হাতে রক্তাক্ত অবস্থায় এসে ভর্তি হন তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত ভিসি আফম ইউসুফ হায়দার স্যার, চোখে আঘাত প্রাপ্ত মুজিব হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মাহফুজুর রহমানসহ আরো অনেক ছাত্র শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী।
এফ রহমান হলের সামনের গাছের পাতা গুলো পুলিশের গুলিতে ছিড়ে কাগজের টুকরোর মত হয়ে পড়ে। সারাদিন ক্যাম্পাসে এমনও গুঞ্জন ছিল রাতে সামরিক শাসন জারি হতে পারে! সন্ধ্যার পর ছাত্রাবাসগুলোতে নেমে আসে তল্লাসির নামে নির্যাতন। রাতে কারফিউ জারি করা হয়। গ্রেফতার করা হয় পর্যায়ক্রমে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক হারুনর রশীদ, অধ্যাপক সদরুল আমিন, অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক সহ অনেক শিক্ষক ও ছাত্রনেতাকে। তাদেরকে করা হয় অমানুষিক নির্যাতন।
বন্ধু সুজন এখনো পুরোপুরি সুস্থ্য নয়। নির্যাতন প্রতিরোধ ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সে সময় সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবীতে ক্যাম্পাসে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। এটি ছিল একটি শতস্ফুর্ত ছাত্র আন্দোলন। একক কোন ছাত্র সংগঠন এর কৃতিত্ব দাবী করলে ভুল হবে। তবে তৎকালিন সরকার এ ধরনের প্রতিবাদের মুখোমুখি না হলে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে আরেকটি দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসনের কবলে পড়ত।
রাতে আহতদের উন্নত চিকিৎসার খোঁজ খবর নিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসেন মে :জে :সিনা ইবনে জামালী। এই খবরে রাতে ঢাকা মেডিকেল প্রায় ঘেরাও করে ফেলে ছাত্ররা। সেদিন রাতে এনটিভির সংবাদ শিরোনামে আমার আহত একটি ছবি প্রকাশ করেছিল। যা দেখে আমার বন্ধু বান্ধবরাও খোঁজ খবর নিতে শুরু করে। এদিকে রাতেই সাধারন ছাত্রছাত্রীদেন ব্যানারে মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের জন্য ৪৮ ঘন্টা সময় বেধে দেয়া হয়। রাত পোহানোর আগেই ক্যাম্পাস ছাড়ে সেনাবাহিনী। কিছুটা সুস্থবোধ করলে আমি রাতেই ভয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম্বুলেন্সে সূর্য সেন হলে ফিরে আসি।
২১ আগস্ট শহীদ মিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এক প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষনা করে। সকালে ছাত্র শিক্ষকদের প্রতিবাদী যৌথ মিছিল। এত বড় মিছিল আমার জীবনে আজো দেখিনি! সেদিন সকল ছাত্রসংগঠন সকল ভেদাভেদ ভুলে এক কাতাড়ে এসে দাড়িয়েছিল। ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, বাম, ডান সবাই। এ এক অন্য রকম বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। চারুকলার ছাত্ররা প্রতিবাদ স্বরুপ জলপাই রং দিয়ে সেদিন এক বিশাল হাতি বানিয়ে ছিল। ছাত্ররা সেনাবাহিনীর প্রতিকী সেই হাতির লেজ ধড়ে মজা করে অনেক টানাটানি করেছিল! যে ছবি সে সময় ভাইরাল হয়।সেদিনের ছাত্রদের সংগ্রামে পূর্ন সমর্থন দিয়েছিল শিক্ষকরা। আর্মির গাড়িতে শাহবাগে আগুন ধড়িয়ে দেয় ছাত্ররা। নীলক্ষেত, পলাশীতে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে রনক্ষেত্র পরিনত হয়। সিএসবি টিভি চ্যানেলের লাইভ সম্প্রচারের ফলে সারা বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবাদের দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে।কিছুক্ষণের মধ্যই সিএসবি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়।
রাতেই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছেড়ে মিরপুরে আমার ছোট মামার বাসায় চলে যাই। সকালে থমথমে ঢাকা।সেনাবাহিনী রাস্তার মোড়ে মোড়ে। কোন বাস নেই। হেটেই চললাম মিরপুর থেকে মহাখালীর পথে বাড়ি যাব বলে। সংসদ ভবনের সামনে আসতেই সেনা সদস্যরা আমার পরিচয় জানতে চায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় পত্রটি জীবনে অনেক সম্মান দিলেও আর্মিরা সেদিন সংসদ ভবনের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এই পরিচয় পেয়ে আমাকে বেদম প্রহার থেকে রেহাই দেয়নি! বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সেদিন মঈন ইউ আহমেদ বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছিল।
এ ঘটনায় আশি হাজার ছাত্রের নামে বেনামে এক মামলা হয়।যদিও পরে মামলাটি রাষ্ট্রপতির সাধারন ক্ষমায় সরকার প্রত্যাহার করে নেয়। নব্বয়ের পরে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সফল ছাত্র আন্দোলন ২০০৭ এর আগস্ট ছাত্র আন্দোলন। অনেকেই হয়ত জানেনা। কিন্তু বাস্তবতা তাই, সেই আন্দোলনের একজন কর্মী হিসাবে আমার আজো তাই মনে হয়। গনতন্ত্রের ক্যাম্প ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেদিন সেনাক্যাম্পকে মাত্র ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে হঠিয়ে দিয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমি এখনও বিশ্বাস করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে যেকোন সময় যেকোন স্বৈরাচারকে বিদায় জানানো সময়ের ব্যাপার মাত্র! স্যালুট!সেদিনে বারুদের মত জ্বলে উঠা ছাত্রজনতাদের! আগস্ট ছাত্র আন্দোলন না হলে বাংলাদেশ হয়ত আরেকটি দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসনের কবলে পড়ত। ছাত্ররাই এদেশের গণতন্ত্র ও জনগণের শেষ ভরসা।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের একজন কর্মী।