লকডাউনের মধ্যে পুলিশের সঙ্গে ইঁদুর-বিড়াল খেলছে মানুষ
- মেশকাত মিশু
- প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২০, ০৭:৩৬ PM , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:২১ PM
সকালের দিকে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর টহল দল গ্রামের দিকে আসেনা, সে সুযোগ দোকানের আশেপাশে, বাজারে ইচ্ছে মতো আড্ডা দিয়ে নেয় মানুষ। রাতেও একই দৃশ্য। একটু ভেতরের দিকে ঘাসের উপর ৪-৮ জন মিলে মোবাইলে লুডুও খেলছে, কেউ কেউ তাস। সাথে দর্শকও পাওয়া যায় সমসংখ্যক। এসব চিত্র গ্রামে-গঞ্জে।
জমিতে চাষ হয়নি। শুকনো মাঠ। সেখানে ক্রিকেট মাঠ বানিয়ে ক্রিকেট খেলছে তরুনেরা। অফিস-কলকারখানা বন্ধ থাকায় শহর থেকে আসা জোয়ানরাও যোগ দেয় সেখানে। দেরিতে এলে টিমে চান্স পাওয়াও কঠিন। বাজারে এদের শুভাকাঙ্ক্ষী আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন এলে আগেভাগে জানিয়ে দেয়া হয় তাদের। কিন্তু সেখানে বালাই নেই সামাজিক দূরত্বের। করোনা হাতে-হাতে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও আছে। খেলায় জিততে মতবিরোধে দাঙ্গা-হাঙ্গামাও অহরহ হচ্ছে।
বাইরের এলাকা থেকে কেউ যেনো পাড়ায় ঢুকতে না পারে সে জন্য বিশেষ মিটিংয়ে বসেছে পাড়ার তরুণেরা। যে করোনা ঠেকাতে এতোবড়ো বৈঠক, এজেন্ডা, সেখানে নিজেরা মিলে গিজগিজ করছে। তাতেও সড়কে কেউ একজন নজর রেখেছে যেনো পুলিশ এলে আগেভাগে জানিয়ে দেয়া হয়।
নগর-মহানগরে পুলিশের আনাগোনা বেশি, সেনাবাহিনীর টহলও আছে বেশ। মাঝে কয়েকদিনে প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের কারণে কিছুটা বাসায় ছিল মানুষ। কিন্তু যার ইচ্ছে বের হবেই, তারে দমিয়ে রাখে কে? অভিযোগ উঠেছে সেনাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরে আসতে, আড্ডা দিতে গিয়ে অনেকেই পকেটে ওষুধের প্রেসক্রিপশন পকেটে নিয়ে ঘুরছে।
অঘোষিত লকডাউনের শুরু থেকেই দোকানপাট বন্ধ রাখতে তৎপর হয়ে উঠে প্রশাসন। দোকানীরা হয়তো ভেবেছিল সে কড়াকড়ি সহসাই উঠে যাবে। কিন্তু দিগ্বিজয়ী যে অদৃশ্য শত্রুর প্রতাপে অবরুদ্ধ পৃথিবীকে আগের রূপে দেখতে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় মানুষ। লকডাউনের দিনে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করার কৌশলের গল্প মানুষের হাসির খোরাকও জুগিয়েছে।
মানুষে-মানুষ সামাজিক দূরত্ব ঠিক রাখতে গিয়ে চিনে ১ মিটার দূরত্বে থেকে চুল কাটার ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়েছিল। কিন্তু দোকানের শাটার বন্ধ রেখে ভেতর-ভেতরে কাজ চালানোর কৌশল খুব সরলভাবেই নিয়েছে দেশীয় নাপিতেরা। দোকান বন্ধ, কিন্তু হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হবে না, টোকা দিলে ভেতর থেকে শব্দ আসে কবে নাগাদ সিরিয়াল পাওয়া যাবে। এটা শুধু সেলুনের দৃশ্য না। বাজারে বেশিরভাগ দোকানেই এই অবস্থা। দোকান বন্ধ, বাইরে থেকে কিন্তু তালা লাগানো নেই। অমন সৎবিশ্বাসে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রেখে কেউ চলে যায়না। ভেতরে আছে কেউ না কেউ। পুলিশ বা সেনাবাহিনী টহলে এলে বুঝবার উপায় নেই খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসা চলছে এখানে। সামনে থেকে বন্ধ চা দোকান পেছনের দরজা দিয়ে দেদারসে চলছে।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার দিনেও বাংলাদেশের কূলে মন্দার ঢেউ সেভাবে আচঁড়ে পড়েনি আমাদের অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতার কারণে। এখানে ভীড়ের মাঝে হাটতে হাটতে বাদাম বিক্রি করা মানুষটাও দিনশেষে সংসার চালানোর খরচ ঠিকই উঠিয়ে নেয়। মহামারীর দিনে কিন্তু টিকে থাকার এ লড়াইয়ে মাঠ ছাড়তে চাইছে না কেউ। তাই ছলেবলে কলেকৌশলে চালাতেই হচ্ছে তাদের। চলছেও। কিন্তু করোনা মোকাবিলায় সতর্ক-সাবধানতার বিষয় ভালোভাবেই এড়িয়ে যাচ্ছেন তারা। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও করোনার চোখ যে ফাঁকি দেয়া যায়না। কে বুঝে সে বাস্তবতা।
জমায়েত থেকে ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে। তাই মসজিদ-মন্দির সহ ধর্মীয় স্থাপনা গুলোতে মানুষের ভিড় না জমাতে নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। সড়ক থেকে ভেতরের দিকের মসজিদ গুলোতে পুলিশকে ধোঁকা দিচ্ছে ইমাম-মুসল্লীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ নজরদারি করতে আসেনা এখানে, সে সুযোগে ৫ জন নামাজ পড়ার বেধে দেয়া নিয়ম ভেঙে মহল্লার সবাইকে নিয়ে নামাজ পড়ছেন তারা।
শুক্রবারে জুমার নামাজে মাইক বন্ধ করে রাখতেও দেখা গেছে অনেক জায়গায়। ১০ জন তো না মসজিদে স্থান পাওয়াও কঠিনতর হয়ে উঠেছে। আক্রান্ত চিহ্নিত হয়েছে এমন এলাকা থেকেও আসছে কেউ কেউ। কিন্তু পরিস্থিতি কতোটা ভয়াবহ তা অনুধাবন করার মানুষের বড্ড অভাব। মনে হচ্ছে পুলিশকে ধোঁকা দিয়ে ফেললো, আসলে নিজেদেরকেই দিচ্ছে। করোনা ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি এখানে।
চোর পুলিশ খেলা চলছে। অনেকটা টম এন্ড জেরির সে ইদুর বিড়ালের মতো। এখানে বিজয়ী উভয় পক্ষই। দিনশেষে কিন্তু অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণের মুখে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানুষই। দুনিয়ায় জুড়ে মৃত্যুর সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়ে গেছে, দেশে আক্রান্ত হয়েছে হিসেবে শনাক্ত হয়েছে দুহাজারের কাছাকাছি। এরমধ্যে সুস্থ হওয়া মানুষের ছেয়ে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া আমাদের প্রিয়জনদের সংখ্যা বেশি। এক্ষুনি সাবধান না হলে এ মিছিলে অহারিয়ে যাবে নিজে নয়তো হারাতে হবে কাছের মানুষদের। সাবধান হতে হবে আক্রমণ দৃশ্যমান হওয়ার আগেই।
লেখক: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়