সেনা-ছাত্র-জনতা: জুলাই-আগস্ট গণবিপ্লব
- সাইদুর রহমান
- প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৫, ০৮:৪৭ AM , আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৫, ০৯:৩০ AM

জুলাই-আগস্ট কোটা সংস্কার আন্দোলনটি ছিলো মূলত ‘সেনা-ছাত্র-জনতার’ গণবিপ্লব। বিএনপি-জামায়াতসহ মুক্তিকামী রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বাত্মক সহযোগিতায় এই গণবিপ্লবটি সংঘটিত হয়। কিন্তু সবাই একবাক্যে বলছেন, ছাত্র-জনতার বিপ্লব। মনে রাখতে হবে কখনোই সেনাবাহিনী সহযোগিতা এবং পরামর্শ না দিলে বাংলাদেশে ৫ আগস্ট হতো না। শেখ হাসিনার পলায়ন করা লাগতো না। সর্বাত্মক সহযোগিতা ছিল বিদেশি কিছু কূটনীতিক মিশনেরও। ফ্যাসিবাদের দোসর বাদে মুক্তিকামী জনতার।
কীভাবে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার বিদায় হয় তার খণ্ডচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করবো। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি একটি ডামি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পরই হাসিনার ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিলো। কারণ জবরদস্তি করে ক্ষমতা দখল করে সীমাহীন দুর্নীতি, অর্থপাচার, অনিয়ম, অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন চালিয়েছিলো। ডামি নির্বাচনের সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানও বলেছিলেন, আমি চাই হাসিনা এমন একটি নির্বাচন করুক। কেন করুক তার বিশদ ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। শুনতে অবাক করার মতো লাগলেও এটাই চরম সত্য সেই সময়ই রাজনীতির অন্দরমহল থেকে সরকারের আয়ু নির্ধারণ করা হয় ৭/৮ মাস। সর্বোচ্চ ২০২৪ সালের অক্টোবর, নভেম্বর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই। বলা হয়, শেখ হাসিনার পতন ঠেকাতে ভারতও কার্যকর প্রতিরোধের ভূমিকায় থাকবে না। সেই সত্যতা পাওয়া যায় ৩রা আগস্ট ভারতের কূটনীতিক চ্যানেলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হাসিনার পতনের পরামর্শ।
কোটা সংস্কারের মতো একটি অরাজনৈতিক আন্দোলনে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল অকল্পনীয়। জুলাই প্রথম সপ্তাহে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে আমি নিজেই আমার সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে ৯ জুলাই লিখেছিলাম, অরাজনৈতিক বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশে পরিবর্তন আসবে। এখন অনেকেই বলতে পারেন, আন্দোলনটি পরিকল্পিত। তবে হ্যাঁ হাসিনার পতন ছিল অনিবার্য।
আন্দোলন তুঙ্গে থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনা ২৯ জুলাই বিকালে ১৪ দলীয় মিটিং আহবান করেন। সেখানে বিদায়ের আগমুহূর্তে জাতীয় পার্টি-জেপির চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মন্জু শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, নেত্রী ক্যান্টনমেন্ট ঠিক রাখেন। এই ছোট বাক্যটি শেখ হাসিনাকে বলে চিকিৎসার জন্য ৩রা আগস্ট সিঙ্গাপুরে উড়াল দেন তিনি। দেশে ফেরেন ১০ আগস্ট। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর প্রসঙ্গ টানার কারণ হলো উনি যখন ওই কথা বলেন তার চারদিন পরই ৩ আগস্ট সেনাবাহিনী প্রধানের অফিসার্স অ্যাড্রেস অনুষ্ঠিত। সেনাসদরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং বিভিন্ন সেনানিবাস থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়। কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অনুষ্ঠানে উন্মুক্ত প্রশ্ন নেয়া হয়। মেজর মো. আলী হায়দার ভূঁইয়া, মেজর হাজেরা জাহান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুব, মেজর নোমানসহ আরো বেশকেয়কজন মধ্যমসারির সেনাকর্মকর্তা সাহসী এবং প্রতিবাদ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। পরে সিএএস ঘোষণা করেন যে সেনাবাহিনী আর গুলি চালাবে না। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, ১৯৭০ সালের পর থেকে আমাদের দেশ এতো বড় গণপ্রতিবাদ দেখেনি। তাই এটি একটি অনন্য ঘটনা। আমাদের সকলকে ধৈর্য ধরতে হবে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে আইএসপিআর থেকে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়। সেখানে সেনাবাহিনীর অবস্থান পরিষ্কার করা হয়। বলা হয়, জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের যে কোন প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সবসময়ে জনগণের পাশে আছে এবং থাকবে।
এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শহীদ মিনার থেকে ৬ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পরে রাতেই কর্মসূচি একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। এটি করা হয়েছিল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পরামর্শে। তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন, আন্দোলনের বিরতি দেওয়ার সুযোগ নেই। এরপর ৫ আগস্টকে সফল করবার জন্য শুরু থেকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সুপার ফাইভের পাঁচ নেতাকে পাঁচটি জোনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়। বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষকদল, মহিলা দলকে বিভিন্ন পয়েন্ট ভাগ করা হয়। টার্গেট করা হয়, শাহবাগ, কাটাবন, গ্রিনরোড, চানখারপোল, শেরাটন, বাংলামোটর, মোহাম্মদপুর, বছিলা, শ্যামলী, ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, বাড্ডা, রামপুরা, মুগদা, উত্তরা, যাত্রাবাড়িসহ আরো কিছু জায়গায় বিপুল সংখ্যক লোকজন জমায়েত রাখা হয়। ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান বিরামহীন পরিশ্রম করেছেন। নির্ঘুম থেকেছেন, সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করেছিলেন নেতাকর্মীদের সাথে। নানা নির্দেশনা এবং পরামর্শ দিয়েছিলেন অরাজনৈতিক চ্যানেলে।
সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত ৫ অগাস্টেও ছিল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর অসম্ভব সহযোগিতা। আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে হাসিনা সেনাবাহিনী মোতায়েন করেন। সেনাবাহিনী ১,৭১৯ রাউন্ড তাজা গুলি, ১৪,০০০ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে এবং বিভিন্ন স্থানে জনতার সাথে ৩১টি সংঘর্ষে হয়। ৪ আগস্ট রাতে গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টেলিফোন করে বলেন, ৫ আগস্ট সকাল ১০টার মধ্যে ঢাকা শহর জনমানব শূণ্যের নির্দেশ হাসিনার। রাস্তায় যাকে পাবে তাকে গুলি করতে পুলিশকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। কিছুটা হতাশ, চোখে পানি। হঠাৎ ওহি নাজিলের মতো ক্যান্টনমেন্ট থেকে মেসেজ, পুলিশকে হাসিনা গুলির নির্দেশে দিয়েছে, কিন্তু ভয় পাওয়ার কারণ নাই। সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার সাথে আছে। রাস্তার যেখানে সেনাসদস্যরা থাকবে, ট্যাংক থাকবে, সেখানে আন্দোলনকারীদের সহযোগিতা করবে। প্রয়োজনে পুলিশকে প্রতিরোধ করবে। তাৎক্ষণিকভাবে মেসেজ আমার চ্যানেল সবমহলে পৌঁছে দেয়।
নির্ঘুম রাত, শুধু মেসেজ চালাচালি, ভোররাতে ওজু করে নামাজ পড়তে বসে শুধু কেঁদেছি, আল্লাহ কাছে চেয়েছিলাম জালিমের পতন। সকাল সাড়ে ৯টায় বা একটু পরে শহীদ মিনারের পাশের শিক্ষক কোয়ার্টার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক টেলিফোনে জানালেন, শহীদ মিনারে দুই ছাত্রের লাশ। পুরো ক্যাম্পাস ফাঁকা, পিনপতন নিরবতা। আমাদের চ্যানেলের সবাইকে ফোন দিয়ে আতংকিত না হয়ে সেনাবাহিনী যেখানে আছে সেখানে জড়ো হতে বলা হয়। বিশেষ করে বর্তমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল সামনে, পিকক বারের গলি, রমনা পার্ক এবং কাটাবন থেকে লোকজন বের হলে শেরাটন-শাহবাগ জনতার দখলে চলে যায়। আস্তে আস্তে উত্তরা, যাত্রা বাড়িসহ ঢাকা শহরের প্রবেশপথগুলো উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। সব জনস্রোতের লক্ষ্য গণভবন। জনরোষের হাত থেকে বাঁচতে হাসিনাকে দ্রুত পদত্যাগে বাধ্য করেন সেনাপ্রধান। বেলা পৌণ ১২টার দিকে শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিয়ে তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ভারতে চলে যান। শেখ হাসিনা যাওয়ার আগে একটি ভাষণ রেকর্ড করে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সুযোগও দেননি বর্তমান সেনাপ্রধান। এভাবে সেনাবাহিনীর ঐকান্তিক এবং চরম সহযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হতে বাধ্য হয় শেখ হাসিনার।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।