ভাগ্যের চাকার বহুদিক এবং মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীর বাংলাদেশে আশ্রয়

তাহমিদ তাজওয়ার
তাহমিদ তাজওয়ার  © টিডিসি ফটো

বহুদিন আগে আহমদ ছফার লেখা 'ওঙ্কার' উপন্যাসটি পড়বার সুযোগ হয়েছিল। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটি লেখা হলেও লেখক ভাগ্যের চাকার ভালো-মন্দের মিশেল দেখিয়েছিলেন সেখানে। উপন্যাসে এককালের প্রতাপশালী জমিদার তালুকদার সাহেবের জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে মামলা মোকদ্দমায় হেরে তার ক্ষমতার ব্যাপ্তির হ্রাস এবং অসহায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার কথা ফুটে উঠেছে। একসময় গিয়ে তালুকদার সাহেবের নিকট ক্ষমতা, প্রতিপত্তি এবং সম্পদ স্রেফ গৌরবময় অতীত হয়েই ধরা দিতে থাকে। 

এই পরিপ্রেক্ষিতে তালুকদার সাহেবের ভঙ্গুর অবস্থাকে দূর করতে এগিয়ে আসেন তারই এককালের বিশ্বস্ত মোক্তার আবুনসর। যে কিনা কৌশলে এবং তৎকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিকতার আশীর্বাদে মদদপুষ্ট হয়ে তালুকদারের চাইতেও অধিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। মোক্তার আবুনসর বেচারা তালুকদারকে উদ্ধারে এগিয়ে আসে ঠিকই। কিন্তু শর্ত জুড়ে দেয় তার বোবা মেয়েকে তালুকদার পুত্রের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার। একেই বলে ভাগ্যের চাকার বৈচিত্র্য।

তালুকদার কি কখনও বিশ্বাস করতে পেরেছিল যে তার অধীন মোক্তারের কাছেই তার অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে? কখনও কি তার দাম্ভিক, সবল, অহমপূর্ণ আর্থিক অবস্থা এদিনের চিত্র তার মস্তিষ্কে আসতে দিয়েছিল?

ওঙ্কার উপন্যাসের প্রতাপশালী তালুকদার সাহেবের মতন এরকম টার্নিং পয়েন্ট যেকোনো সামরিক বাহিনীরও হতে পারে, তারই দৃষ্টান্ত যেন মিয়ানমার সেনাবাহিনী। খুব বেশিদিন নয়। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়টাতেই পুরো পৃথিবী অবলোকন করেছিল রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর উপর মিয়ানমার সামরিক জান্তার নির্মম নিপীড়ন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, তাণ্ডব এবং ন্যক্কারজনক অভিযান। যার ফলশ্রুতিতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিজেদের প্রাণ, সম্ভ্রম বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিল বাংলাদেশে।

সেসময় রাজধানীর বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা থেকে শুরু করে স্কুল, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, ভলেন্টিয়াররা সাধ্যমতন অর্থ, খাবার, শীতের পোশাক নিয়ে পিকাপ, ট্রাকভর্তি করে রওনা হতো উখিয়া, কুতুপালংয়ের মতন জায়গাগুলোতে। বাংলাদেশ সরকার বারংবার কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েও মিয়ানমার সরকারকে সম্পূর্ণরূপে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার জন্যে রাজি করাতে পারেনি। যা এক প্রকার সেদেশের সামরিক জান্তার টালবাহানা এবং ঔদাসীন্যতারই বহিঃপ্রকাশ ছিল।

ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চতুর্মুখী আক্রমণে খোদ মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী এখন বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতর পালিয়ে এসে বিজিবির কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এই সংখ্যাটা দেড়শত ছাড়িয়েছে। কবির ভাষায় 'দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ!'।

যে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর এথনিং ক্লিনেসিং চালিয়ে বিশাল সংখ্যক লোককে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে, এখন সময় হয়েছে বাংলাদেশের নিজ জাতির কল্যাণে, নিপীড়িত রোহিঙ্গা জাতির স্বার্থে সুযোগের যথাযথ ব্যবহার করার। পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীরা যেহেতু মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে তাদের রোহিঙ্গা ফেরত নেবার শর্তে সীমান্তরক্ষীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো। নয়তো অতিসত্বর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সীমান্তে নিরাপত্তার জোরদার করার সাথে তা সিলগালা করা। যাতে আর কোনো প্রকার জনস্রোত এবং বাড়তি চাপের সম্মুখীন সীমান্তবর্তী মানুষদের হতে না হয়।

বাংলাদেশের মতন ক্ষুদ্র দেশ ইতোমধ্যে বিশ্বের বুকে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। সেজন্য আর্থিক এবং সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভাগ্যের চাকার মন্থর গতির মাঝ দিয়েও দেশটিকে যেতে হয়েছে।

এবার সময় হয়েছে দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতার সাথে এই অবস্থাকে সামাল দেওয়ার। হাতি গর্তে পড়লে চামচিকায়ও লাথি মারে। মানবিকতার খাতিরে হয়তো হাতি হয়ে চামচিকাদের জ্বালাতন সহ্য করা হয়েছে। তবে চামচিকারা যেহেতু দিনশেষে হাতির সাথেই গর্তে পড়েছে, এবার অন্তত চামচিকাকে বাগে পেয়ে উঠে দাঁড়ানো যাক। ভাগ্যের চাকা এবার বাংলাদেশের স্বার্থের দিকে ঘুরছে। সে সুযোগ হাতছাড়া হওয়া হবে চরম বোকামি।

লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ