ছোটগল্প॥ অশরীরী

রাফেদ হোসাইন
রাফেদ হোসাইন  © টিডিসি ফটো

আমি মাঝেমধ্যে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নটা এমন যে, একটা পাহাড়ের কাছ দিয়ে আমি একাকী একলা হাঁটি। তখন শেষ বিকেল, সূর্যালোক বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার যাওযার কোনো তাড়া নেই, তবুও আমি আনমনে হাঁটতে থাকি।

মন্দ মধুর হাওয়ায় একটা চেনা সুবাস ভেসে আসে। ভাসা ভাসা গন্ধ। বেলীফুলের মনকাড়া সুতীব্র ঘ্রাণ। চতুর্দিকে অবোধ ভঙ্গিতে মুখখানা ঘুরিয়ে তীব্র গন্ধের উৎস আবিষ্কার করতে থাকি। কিন্তু আশেপাশে কাউকে দেখতে পাই না। জনমানবহীন সুনশান চরাচর।

আমি হাঁটতে থাকি। হটাৎ কাছের পাহাড় থেকে একটা মানুষী ছায়ামূর্তি মৃদু কন্ঠে নাম ধরে আমাকে ডাকে। আমি তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি। আবছায়া অস্পষ্ট সে চাহনি। হাত ইশারা করে বলে এসো, আমার কাছে এসো।

আমি কি জানি ভেবে তার কাছে যেতে থাকি। যতই কাছে যাই ততই বেলীফুলের ঘ্রাণ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। একটু দূর থেকে তার মুখখানা সুস্পষ্ট না হলেও তাকে খুব পরিচিত, চিরচেনা মনে হয়। অথচ তাকে আমি কখনো দেখিনি।

আমি তার কাছে যেতে থাকি, ততই হাসতে থাকে আর সে অস্পষ্ট হয়। যতই তার কাছে যাই ততই তার শরীরের অস্পষ্টতা বাড়তে থাকে আর হাওয়ায় তার শরীর মিলিয়ে যায়। যেন কায়াহীন এক আবছায়া। আমি পুরোপুরি আর তাকে দেখতে পাই না। কিন্তু তাকে খুব পরিচিত মনে হয়। খুব মায়া হয় তার জন্য। চর্তুদিকে বারবার তাকে খুঁজি কিন্তু তাকে আর পাই না।

বুকভর্তি থমথমে মেঘ নিয়ে ফিরে চলে আসি। এই একই স্বপ্নটা আমি অনেকদিন পর হুটহাট দেখি।

এখন রাত ১টা বেজে ২৯ মিনিট। চোখে ঘুম আসছে না। এই মাঝরাতে আমার খুব হাঁটতে ইচ্ছে করছে। বাইরে জোছনামাখা রাত, আকাশে রুপালি চাঁদ। ঘর হতে বেরিয়ে আমি বাইরে হাঁটতে থাকি। মনে হচ্ছে চাঁদটা ও আমার সাথে সাথে যাচ্ছে। মুগ্ধ চোখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকি আমি।

মাঝরাত হলেই ব্যাঙেরা জোরে জোরে ডাকতে থাকে, হয়তো ডেকে ডেকে তারা সঙ্গীকে কাছে পাওয়ার আহ্বান জানায়। জোনাক পোকার নিভু নিভু আবছা আলো ক্রমশই বাড়তে থাকে। অন্ধকার পথে একমাত্র তারাই মন জ্বলে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়ায় পথঘাট, বাগানজুড়ে।

হটাৎ আমার নাকে বেলীফুলের সেই চেনা-জানা গন্ধ লাগে। আমার ধারণা সেই মানুষী ছায়ামূর্তি আমার পাশেই রয়েছে। আবছায়া নিভু নিভু আলোতে আমি একটু থেকে সামনে পেছনে তাকিয়ে তাকে খুঁজি। কাউকে দেখতে পাই না। ব্যাকুল চোখে আমি সামনে তাকিয়ে আবার হাঁটা শুরু করি।

হটাৎ ডানপাশে তাকাতেই দেখি সেই মেয়েটা আমার পাশ দিয়ে আমাকে সঙ্গ দিয়ে হাঁটছে। আমি অবাক বনে যাই। এতোদিন যে ছিল স্বপ্নে আজ সে আমার এতোটা নিকটে। তার চোখে-মুখে মন্দ মধুর হাসি। আমি মুগ্ধ নয়নে অপলক তাকিয়ে থাকি। তার চাহনিজুড়ে এতো সুগভীর মায়া যে, তার চোখের মায়ার সমুদ্রে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।

নিস্তব্ধ এই গভীর রাতে আমরা হাঁটতে থাকি। গাঢ় আধাঁরের মতোই আমরা নিশ্চুপ হাঁটতে থাকি। কারো মুখে কোন শব্দ নেই। আমার বুকভর্তি ভালোলাগার বৃষ্টি নামতে থাকে। অনুভবে এতোটা সুখভাব আগে হয়তো কখনোই অনুভব করিনি।

মাথার উপরে পূর্ণিমার চাঁদ আর নিচে মন-প্রাণ উজাড় করে দেওয়া সে মেয়েটা, অশরীরী। খুব ইচ্ছে করে তাকে একটু ছুঁয়ে দিতে, তার হাতটা ধরে হাঁটতে। কিন্তু না আমি তাকে ছোঁব না। কল্পনাকে কখনো ছুঁতে নেই, স্পর্শ করতে নেই। ছুঁয়ে দিলেই কাছে পাওয়ার তীব্রতাটুকু হারিয়ে যায়।

নিঝুম রাতে আমরা দুজন হাঁটতে থাকি... চেনা পল্লীর অলিগলি থেকে রাজপথ.. মনে হচ্ছে ঝিঁঝি পোকা, তারা, চাঁদ কিংবা সমস্ত প্রকৃতি আমাদের সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে আর আর্শীবাদ করছে।


সর্বশেষ সংবাদ