থ্রিডি অ্যানিমেশন বানাতে গিয়ে আটকে গিয়েছি, থেমে যাইনি

জিসান ইসলাম অনন্ত
জিসান ইসলাম অনন্ত  © টিডিসি ফটো

ইউটিউব দেখে ধারণা নিয়ে নিজে নিজেই বানিয়ে ফেলেছেন থ্রিডি অ্যানিমেশন ছবি। এ ছবি বানিয়ে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আইরিশ রক ব্যান্ড কোডালাইনের ‘অল আই ওয়ান্ট’ গানটি শুনতে শুনতে মাথায় একটি গল্পের ধারণা আসে। সেই গল্পের আলোকেই বানিয়ে ফেলেন থ্রিডি অ্যানিমেশন ছবি ‘ফ্লাইট’। আর ছবিটির আবহ হিসেবে ব্যবহার করেছেন এ গানটিই।
 
বলছিলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস নিয়ে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী জিসান ইসলাম অনন্ত অনন্তের কথা। জিসান আদমজী পাবলিক স্কুল থেকে এসএসসি এবং আদমজী পাবলিক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছে। দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ও চেষ্টার পর অবশেষে সম্পন্ন হয়েছে তার প্রথম অ্যানিমেশন ছবির কাজ। জিসানের কাজ নিয়ে সম্প্রতি তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের মুখোমুখি হয়েছেন। তার কথাগুলো শুনেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সাগর হোসেন।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: থ্রিডি অ্যানিমেশনের বিষয়টি মাথায় আসলো কীভাবে?
জিসান ইসলাম অনন্ত: যখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়তাম, তখন থেকেই ভাবতাম ডিজনি মুভিগুলো কীভাবে তৈরি হয়। এই বিষয়টিতে আমার ভীষণ আগ্রহ ছিল। আমি যখন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে পড়তাম, তখন একদিন স্কুলের এক বন্ধু আমাকে বললো যে তারা ‘‘Blender’’ নামে একটি থ্রিডি সফটওয়্যার শিখে। আমি খুব আগ্রহী হলাম। মনে পড়ে একটি মেমোরি কার্ডে সে আমাকে সফটওয়্যার এবং কিছু ভিডিও দিয়েছিল। যাতে আমি মৌলিক বিষয়গুলো শিখতে পারি।
 
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: থ্রিডি অ্যানিমেশন বানানো কীভাবে শিখলেন?
জিসান ইসলাম অনন্ত: শুরুর দিকে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ না থাকায় আমার বন্ধু পেন ড্রাইভে যে সব জিনিস দিয়েছিল মোটামুটি তার মধ্যেই ছিলাম। কিছু টিউটোরিয়াল ভিডিও যা ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করাছিল, ‘ব্লেন্ডার গুরু’ এর how to make a donut in blender এর কিছু ভিডিও। আমার প্রথম প্রজেক্ট ছিল একটি ডোনাট। তারপর আমি একই ডোনাট আরও ৪ বার বানালাম।

ডোনাট তৈরি করার পর আমি আমার বাড়ির কিছু জিনিস যেমন গ্লাস, মগ, প্লেট ইত্যাদির ছবি তুলে সেগুলোর থ্রিডি তৈরি করার চেষ্টা করলাম। কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারের সীমাবদ্ধতার জন্য আমি গাড়ি বা মানব দেহের মত জটিল বস্তু তৈরি করতে পারিনি। তবুও যত দূর সম্ভব ব্লেন্ডারে আরও কিছু ছোট ছোট জিনিস তৈরি করতে শিখেছি। পুরোনো কম্পিউটারটি লোড নিতে না পেরে বারবার হ্যাং হতো, নষ্ট হতো, আমি বারবার সেটি ঠিক করে আমার কাজ চালিয়ে নিয়েছি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ‘ফ্লাইট” নিয়ে বলুন
জিসান ইসলাম অনন্ত: একদিন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং থেকে ফেরার পথে এই গল্পটি নিয়ে ভাবি। আমি কোডালাইনের ‘অল আই ওয়ান্ট’ গানটি শুনতে গিয়ে এই গল্প নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করলাম। ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষার পর অবসর সময়টায় কিছু একটা করতে চাচ্ছিলাম। তাই অল্প অল্প করে আমি আমার দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম।

এখন পর্যন্ত ৩টা অ্যানিমেশন বানিয়েছি। আমার সবচেয়ে বড় অ্যানিমেশনটির নাম ফ্লাইট, এটা একাই বানিয়েছি। প্রথম ডোনাট নামে থ্রিডি অ্যানিমেশন ছবি দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম। পরে আরও কয়েকটি ডোনাট বানিয়েছি।

গুগল ও ইউটিউবে থ্রিডি এনিমেশন নিয়ে তৈরি ব্লগ ও টিউটোরিয়ালগুলো মনোযোগের সাথে দেখে বাসার পুরোনো কম্পিউটারে অনুশীলন করে হাত পাকানোর চেষ্টা করলাম। ২০২৩ সালে আমার অনুরোধে বাবা একটি ভালো কনফিগারেশনের কম্পিউটার কিনে দিলে প্রায় ছয় মাসের কঠোর পরিশ্রমের পর এখন এটি পাঁচ মিনিটের একটি শর্ট ফিল্মে পরিণত হলো।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
জিসান ইসলাম অনন্ত: একটি এনিমেটেড ফিল্ম তৈরি করার অনেকগুলো ধাপ থাকে। চিত্রকর গল্প, স্ক্রিপ্ট, ক্যারেক্টার ব্যাকগ্রাউন্ড, মডেলিং, এডিটিং ইত্যাদি প্রতিটি বিভাগের কাজ আমি একাই করেছি। প্রায় প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা টানা কাজ করেছি।

আর আমার কম্পিউটার কখনো ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা টানা চালু রেখেছি। কাজের প্রত্যেকটা ধাপেই চ্যালেঞ্জ ছিল এবং একা আমাকেই সবগুলো কাজ সম্পন্ন করতে হয়েছে। এ ধরনের কাজে সাধারণত বড় বাজেট থাকে এবং প্রতিটি ধাপের কাজ পৃথক টিম করে থাকে। একা সব দিক সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছি। কখনো আটকে গিয়েছি কিন্তু থেমে যাইনি। এটি আমার জন্য ধৈর্যের পরীক্ষা ছিলো এবং আমি তাতে জয়ী হয়েছি।

 

 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: অ্যানিমেশন তৈরি করতে কত সময় লেগেছে?
জিসান ইসলাম অনন্ত: একটা ভালো মানের অ্যানিমেশন তৈরি করতে প্রতিদিন প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হয়। টানা চার মাস পর্যন্ত কাজ করার পর সবকিছু অ্যানিমেশনের জন্য প্রস্তুত হলো। চরিত্রটি আমি যেভাবে চাই সেভাবে নাড়াচাড়া করাতে আমার নিজের ভিডিও নিলাম।

আমি দৃশ্যগুলোতে নিজে অভিনয় করে সেটি এনিমেশন চরিত্রে প্রয়োগ করেছি। এই জার্নি খুবই কঠিন ছিল এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ এসেছে; যা আমাকে সমাধান করতে হয়েছে। কিছু সমস্যা এত কঠিন ছিল যে আমাকে কয়েক সপ্তাহ গবেষণা করতে হয়েছিল। শেষে ভালো লাগার একটা জায়গা পেয়েছি। আমার নির্মিত এনিমেশন শর্ট ফিল্ম ফ্লাইট সবাই পছন্দ করেছে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মূল গল্প সম্পর্কে বিস্তারিত বলুন
জিসান ইসলাম অনন্ত: চলচ্চিত্রের গল্পটা খুব সহজ। এতে শুধুমাত্র একটি চরিত্র আছে। গল্পে আমার চরিত্র, বাংটু একটি খেলনার দোকানে একটি খেলনা বিমান দেখে তার খুব ভালো লেগে যায়। কিন্তু তা তার জন্য খুব দামী ছিল। তাই কেনার সুযোগ হয়নি বলে সে মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু সে ভাবতে লাগল, যদি তা কিনতে না পারে তাহলে সে নিজে তৈরি করবে। তাই সে হাতের কাছে যা পায়, তা দিয়েই বিমান তৈরি করতে শুরু করে।

প্রথমে বিমানগুলো ভালো ছিল না এবং ভালোভাবে উড়তোও না। সে আবারও চেষ্টা করে। রাতদিন কঠোর পরিশ্রম করে শতশত বিমান তৈরি করে। বারবার চেষ্টার পরে সে উড়তে সক্ষম বিমানটি তৈরির সাফল্য পায়। অর্থাৎ স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পায়।

একা সব দিক সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছি। কখনো আটকে গিয়েছি কিন্তু থেমে যাইনি। এটি আমার জন্য ধৈর্যের পরীক্ষা ছিলো এবং আমি তাতে জয়ী হয়েছি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এ পর্যন্ত কয়টি অ্যানিমেশন তৈরি করেছেন?
জিসান ইসলাম অনন্ত: এখন পর্যন্ত ৩টা অ্যানিমেশন বানিয়েছি। আমার সবচেয়ে বড় অ্যানিমেশনটির নাম ফ্লাইট, এটা একাই বানিয়েছি। প্রথম ডোনাট নামে থ্রিডি অ্যানিমেশন ছবি দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম। পরে আরও কয়েকটি ডোনাট বানিয়েছি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি? 
জিসান ইসলাম অনন্ত: আমি থ্রিডি এনিমেটর হিসেবে কাজ করতে চাই। দেশে ও দেশের বাইরে বড় ক্যানভাসে কাজ করতে চাই। বিশ্বসেরা থ্রিডি অ্যানিমেশন শিল্পের অংশ হতে চাই। নিজেকে সেজন্য তৈরি করবো। ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মানে ডিজিটাল মিডিয়ার একটি নতুন দিগন্ত রচনার অংশীদার হতে চাই।


সর্বশেষ সংবাদ