গ্রিনকার্ড বাতিল করে দেশে ফিরে ব্যবসা শুরু করেছি
ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল জনপ্রিয় রাজশাহীর ছেলে নাফিস সেলিম। তিনি নিজ জেলাতেই প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। এরপর কিছুদিন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। এরপর পাড়ি জমান সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে। পেয়েছেন গ্রিন কার্ডও। তবে একটা সময় মনে হয়েছে, এ গ্রিন কার্ড নয় তার নিজের স্বাধীনতা তার কাছে অনেক বড়। তাই এ কার্ডের মায়া ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা শেষে চলে আসেন নিজ মাতৃভূমিতে। এখানে শুরু করেন কনটেন্ট তৈরির কাজ। সঙ্গে রয়েছে একাধিক ব্যবসাও। তার এ বৈচিত্রপূর্ণ জীবনের গল্প নিয়ে সম্প্রতি তিনি মুখোমুখি হয়েছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের। তার কথাগুলো শুনেছেন তাওফিকুল ইসলাম হিমেল—
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শুরুতে আপনার শৈশব নিয়ে বলুন
নাফিস সেলিম: আমি রাজশাহীতে বড় হয়েছি। ছাত্র জীবন থেকেই আমার ব্যবসার প্রতি অনেক ঝোঁক ছিলো। আমার বাবা-চাচা-দাদা ওনারা সবাই ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন। এটা এ কারণেই কিনা জানিনা। তাই ছোট থেকেই ব্যবসার সাথে আমার পরিবারকে যুক্ত থাকতে দেখে বড় হয়েছি।
যদিও পরিবারের মানুষ চাচ্ছিলেন আমি যেন চাকরি করি। সব সময় আমাকে বলা হতো ব্যবসায় অনেক রিস্ক এবং এই ফিল্ডে না যেতে। এই কারণে ছোট থেকেই আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে আমি চাকরি করবো। তাই সারা জীবন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলাম। কারণ আমার একজন কাজিন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। তবে আমার ছোট মামা একটা কথা বলতেন, নাফিস তোর রক্তের মধ্যে ব্যবসা মিশে আছে। সেদিন বুঝিনি কথাটার মানে; তবে আজকে বুঝি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার শিক্ষাজীবনের গল্প শুনতে চাই।
নাফিস সেলিম: আমি ‘ও’ লেভেল ‘এ’ লেভেল রাজশাহীর প্যারামাউন্ট স্কুল থেকে দিয়েছি। তারপর স্টনি ব্রুক ইউনিভার্সিটিতে (এসবিইউ) যাই বায়ো মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ার জন্য। তবে আমার সব সময় ইচ্ছে করতো ব্যবসা নিয়ে পড়তে।
তারপর বাংলাদেশে কিছুদিন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। এখানে পড়াশোনা করার সময়ই যখন গ্রীন কার্ড তখন নিউইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট কলেজে ব্যবসায়ের উপরে পড়াশোনা করি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি দেশের বাইরে পড়ালেখা করে আবার ফিরে আসলেন কীভাবে, সেখানে তো কাজও শুরু করেছিলেন
নাফিস সেলিম: ছোটবেলা থেকেই বিদেশে থাকার ব্যাপারে আমার আগ্রহ ছিল। কিন্তু ওখানকার জীবনটা আমাকে ওভাবে স্যুট করছিল না। আমি একটু স্বাধীনভাবে থাকতে চাই। আমি কাজ করবো, কিন্তু কাজটা নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত করতে চাই না। আমি আমার মতো করে লাইফটা লিড করতে চাচ্ছিলাম। যেটা ওখানে করা অনেক বেশি কঠিন ছিলো।
আরও পড়ুন: আরো কয়েকটি বিদেশি ভাষার পাঠদান শুরু হচ্ছে ভাষা ইনস্টিটিউটে
তখন আমি একটু এনালাইসিস করলাম যে আমার জন্য দেশে থাকা ভালো হবে নাকি বিদেশে। হিসেব করে দেখলাম, আমি দেশে বেশি ইম্প্যাক্ট ফেলতে পারবো। বিদেশে সেইরকম ইম্প্যাক্ট ফেলতে পারবো না। এই সিদ্ধান্ত নিতে খুবই কষ্ট হয়েছে। তবে আমি গ্রীন কার্ড ক্যান্সেল করে এখন দেশেই সেটেল্ড এবং সত্যি কথা বলতে আমার জীবনের এইটা বেস্ট ডিসিশন ছিল। আলহামদুলিল্লাহ।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এখন আপনি একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে সেলিব্রেটিও বটে। এ যশ-খ্যাতি কীভাবে বজায় রাখেন
নাফিস সেলিম: রাস্তাঘাটে কেউ যখন আমার আমাকে চেনে এবং আমার সাথে ছবি তুলতে চায় তখন আমার অনেক আশ্চর্য লাগে। আমার কাছে নিজেকে একদমই সেলিব্রেটি মনে হয় না। মনে হয় না যে আমি অনেক বড় ব্যক্তিত্ব একদমই না। আমি আমার কাজে অনেক গুরুত্ব দিয়ে থাকি। তাই যখন কেউ আমাকে চেনে আমি খুব খুশি হয়ে যাই। তবে অনেক আশ্চর্যও হয়ে যাই।
একদিনের কথা শেয়ার করি, একজনের সাথে মিটিং করছি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলাপ-আলোচনা হচ্ছিলো। আমি ভাবছি কেউ আমাকে চেনে না। আমি ওই ভাইয়ের সাথে ইচ্ছামত সব শেয়ার করেছি। বিল দিতে যাব যখন তখন দেখি রেস্টুরেন্টের সবাই আমাকে চেনে।
একজন এসে বলতেছে ভাইয়া আমি আপনাকে শুরু থেকেই ফলো করছিলাম; তবে কিছু বলছিলাম না। কারণ আপনি কথা বলছিলেন। আমি ভাবলাম যে কি কি যে সে শুনে ফেলেছে আমাদের কথা। হা হা… তবে আমার খুবই ভালো লাগে যখন নতুন কারো সাথে আমার দেখা হয়। যদি এমন হতো আমাদের হাতে ২৪ ঘন্টা সময় না থেকে অগণিত সময় হতো! তাহলে মন চায় সবার সাথে অনেক সময় দেই আড্ডা দেই।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আমরা দেখেছি, ফেসবুকে নিজের প্রোফাইল-পেজের বাইরে একটা গ্রুপ আছে আপানার। সেখানে কি হয়
নাফিস সেলিম: ফেসবুক গ্রুপে আমাদের মেম্বারসরা বিভিন্ন ব্যবসায়ের আলোচনা করেন। সবাই সবাইকে হেল্প করে সাজেশন দেয় এবং এই গ্রুপটা সম্পূর্ণ ফ্রি কোন টাকা দেওয়া লাগে না। এই গ্রুপ খোলার উদ্দেশ্যই ছিল একটা কমিউনিটি তৈরি করা, সবাই যেন কানেক্টেড থাকতে পারে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি পুরোদস্তুর একজন ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্ব। আপনার ভিডিওতে দারুণভাবে এ ব্যাপারগুলো বিশ্লেষণ করেন। কোনো সরকারের পক্ষ থেকে সঙ্কটকালে ব্যবসা বা অর্থনীতি সংক্রান্ত দায়িত্ব দিতে চায়, আপনি কি তা ফিরিয়ে দেবেন?
নাফিস সেলিম: আমি একজন মার্কেটিংয়ের শিক্ষার্থী। আমার জ্ঞান সীমিত। আমি এখনো শিখছি। এত বড় দায়িত্ব দিলে আমি ফিরিয়ে দেব। কারণ আমি দায়িত্ব নেওয়ার মতো পজিশনে এখনো আসিনি। আমার থেকে আরো ভালো ভালো মানুষ রয়েছেন সেই দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। আমি তো এখনো শিখতেছি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ইউটিউবিংয়ের বাইরে আপনি নিজেও ব্যবসা পরিচালনা করেন। আপনার একাধিক ব্যবসায়ের কথা শুনেছি। কি ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন
নাফিস সেলিম: রাজশাহীতে আমাদের কনভেনশন হল আছে। যেটার নাম হচ্ছে ম্যাংগো রিসোর্ট ইভেন্ট হল। সেটার সাথে স্টোরি কেচার্স, যেটা একটা ডেকোর কোম্পানি এবং ছোটখাটো একটা এজেন্সি আছে। নাম ট্রেডেক্স মার্কেটিং সলিউশন।
মাঝে মাঝে মন চায় আরো বিজনেস দেই। তবে নিজেকে একটু স্থির করছি। ইম্প্যাক্ট একাডেমি নামে একটা এডটেক শুরু করতে যাচ্ছি। সেটার কিছু কাজ বাকি আছে। ইম্প্যাক্ট একাডেমী নিয়ে আমি খুব বেশি আশাবাদী।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার চাকরির চেয়ে ব্যবসা বা এ ধরনের ফ্রিল্যান্সিংয়ে বেশ আগ্রহ। এটা কেন? আপনিও তো চাইলে বিসিএস ক্যাডার হতে পারতেন
নাফিস সেলিম: আমি ফ্রিল্যান্সার না এইটা আগে থেকেই পরিষ্কার করে রাখা দরকার। তবে ফ্রিল্যান্সিং জগতের ব্যাপারে আমি কিছুটা হলেও জানি। চাকরি করি বা ব্যবসা করি দুইটাই আমাকে প্রচুর খাটতে হবে। খাটতে যখন হবেই তখন শুধুই স্বাধীনভাবে খাটতে চাই। এমন কোথাও খাটতে চাই, যেখানে খাটতে মজা লাগবে।
এটার জন্য ব্যবসা পছন্দ করি। তবে ব্যবসাতে অনেক স্ট্রেস থাকে, চাকরিতেও থাকে। ব্যবসাতে একটু বেশিই থাকে। ব্যবসার ক্ষেত্রে যেমন আমি ইচ্ছামতো আমার সিডিউল সেট করতে পারি, এটার থেকে মজার কিছু হইতে পারে না।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ইউটিউব-ফেসবুক থেকে বেশি আয় হয়, নাকি আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে?
নাফিস সেলিম: খুবই ভালো একটা প্রশ্ন করেছেন। শুরুর দিকে আমার ব্যবসা থেকেই বেশিরভাগ উপার্জন আসতো। কিন্তু আল্লাহর রহমতে এখন ইউটিউব-ফেসবুক থেকে অনেক বেশি ইনকাম হয়। একইসঙ্গে এ উপার্জনে আমি আমার ব্যবসাও চালিয়ে যাচ্ছি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: লাইফস্প্রিং সম্পর্কে বলুন, আপনি প্রতিষ্ঠানটির ডিজিটালের প্রধানের দায়িত্বপালন করছেন।
নাফিস সেলিম: লাইফস্প্রিং-এ এখন আমি মার্কেটিং কনসালটেন্ট হিসাবে কাজ করি। আমি সারাদিন ব্যবসা ব্যবসা করি আর লাইভস্প্রিং-এ তো চাকরি করি। এটা কেমন হয়ে গেল না? আসলে লাইফস্প্রিং-এর যেই ভিশন; এটা আমাকে অনেক টানে। আমি যদি চাকরিজীবী হতাম, আমি সত্যিই লাইফ স্প্রিং-এ আমার লাইফ কাটায় দিতাম।
আরও পড়ুন: ‘পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান’ না থাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীরা বিসিএসে ঝুঁকছে
লাইফ স্প্রিং-এর ইয়াহিয়া আমিন ভাই এবং কুশাল ভাইয়ের চিন্তা অন্য লেভেলের। লাইফ স্প্রিং একদম ফ্যামিলির মতো হয়ে গেছে। অফিসে ঢুকেই মনে হয় যে ফ্যামিলি গেট টুগেদার। আমার জন্য অন্যরকম একটি ভালোবাসা জায়গা এটি। তারা অনেক বেশি ইথিকাল এবং ধৈর্য্যশীল এন্ড কর্মমুখী। লাইফ স্প্রিং-এর প্রতি আমার চরম সফট কর্নার কাজ করে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বলা হচ্ছে, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের ফলে মানুষের ভবিষ্যত জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। সে সময়টাতে টিকে থাকতে এখন থেকে কি কি ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার?
নাফিস সেলিম: কমফোর্টেবল থাকা যাবে না। ভয়ও পাওয়া যাবে না। সব সময় নিজেকে আপডেট রাখতে হবে।
আমি বলব আপনারা এনভায়রনমেন্ট ফিল্টার করা শুরু করেন। বাইরের দেশের প্রচুর পডকাস্ট আছে, এগুলো শোনা শুরু করেন। এইগুলা খুবই হেল্পফুল। ইউটিউবে ফ্রিতে আপনি স্টাডি করতে পারবেন। যেমন ধরেন আমি ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে কাজ করি। আমার মতো যারা আছেন তাদের সবার দেখা উচিত যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্টকে ব্যবহার করে কিভাবে আমি আরো ইফিশিয়েন্সি মার্কেটিং করতে পারব। আমাদেরকে সব সময় শেখার মধ্যে থাকতে হবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এখন পর্যন্ত আপনি আপনার জীবনে কী কী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন?
নাফিস সেলিম: সেইরকম কোন কিছু আমার মনে পড়ছে না।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: পরবর্তী জীবনের লক্ষ্য কি, আপনার আইডল কে?
নাফিস সেলিম: আমার আইডল আমার দাদা। যাকে দেখার আমার সৌভাগ্য হয়নি। উনি আমার জন্মের আগেই মারা গেছেন। আমি সবসময় আল্লাহর কাছে দোয়া করি যে, যেন আমি আমার দাদার মতো হতে পারি। আমার দাদা রাজশাহীর মধ্যে অনেক বড় ব্যবসায়ী ছিলেন এবং তিনি অনেক ভাল ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ছিলেন। তিনি সবসময় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন এবং মানুষকে সাহায্য করতেন।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য ধন্যবাদ।
নাফিস সেলিম: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের জন্যও শুভকামনা রইলো।