কয়েক কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ

ক্লাস বর্জন করে আন্দোলনে ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষকরা

গভর্নিং বডির পদত্যাগসহ নানা দাবিতে আন্দোরনরত শিক্ষকরা
গভর্নিং বডির পদত্যাগসহ নানা দাবিতে আন্দোরনরত শিক্ষকরা

গভর্নিং বডির অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় ১২ কোটি টাকা লোপাটসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে পাঠদান ছেড়ে আন্দোলনে নেমেছেন রাজধানীর ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষকরা। শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমানসহ অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এনে একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করেছেন। তারা সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শহীদ মিনারের সামনে এ কর্মসূচি পালন করেন।

এর আগে শিক্ষকরা গতকাল গভর্নিং বডির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান ও অন্যান্য সদস্যদের অপসারণের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেন। তারা দাবি আদায়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন। শিক্ষকদের আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরাও। এদিন সরেজমিনে, ক্লাস বর্জন করে একজোট হয়ে কর্মবিরতি পালন করতে দেখা গেছে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সকলকে।

গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষকদের সবচেয়ে গুরুতর আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে তারা বলছেন, করোনা-কালীন সময়ে ২০২০ সালে গভর্নিং বডির মাধ্যমে কলেজের ফান্ড ভেঙ্গে ১১ কোটি টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়নি। পাশাপাশি সাময়িক বরখাস্তকৃত অধ্যক্ষ ও অপর দুই শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক বছরে বোর্ডের ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় বিনা রশিদে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। গভর্নিং বডি এ সম্পর্কে জেনেও কোন ব্যবস্থা নেননি। এটি সুকৌশলে করা হয়েছে। কিছু টাকা শিক্ষকদের বেতন হিসেবেও দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ আছে গভর্নিং বডির প্রত্যক্ষ মদদে প্রতি বছরে উপাধ্যক্ষকে কমিটির আহবায়ক করে বিনা। রশিদে ও ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে শিক্ষার্থীদের ইউনিফরমের নিম্নমানের কাপড় ও জুতা সরবরাহ করে মুনাফা হিসাবে প্রাপ্ত ৭০ থেকে ৮০ লক্ষ টাকা গভর্নিং বডির কতিপয় সদস্য ও কতিপয় দুর্নীতিবাজ শিক্ষকদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করেন।

শিক্ষকরা বলছেন, গভর্নিং বডির সভাপতির কাছে প্রতিষ্ঠানের কোন অনিয়ম-দুর্নীতি লিখিত বা মৌখিকভাবে তুলে ধরা হলেও তিনি তা আমলে নেন না বরং যে বা যারা বিষয়গুলো সম্পর্কে কথা বলেন বা তাকে জানান তাদেরকে প্রতিষ্ঠান বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন। এভাবেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুর্নীতিবাজদের সহযোগিতা করেন তিনি।

এছাড়াও উপাধ্যক্ষের নেতৃত্বে বিভিন্ন কমিটিতে নগদ টাকা উত্তোলন করে খরচের সঠিক হিসাব ছাড়াই গভর্নিং বডির অর্থ কমিটিতে ও নিয়মিত সভায় বিনা বাধায় অনুমোদন করা হয়েছে। এধরণের দুর্নীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে গভর্নিং বডির সদস্যদের বিরুদ্ধে। তারা বলছেন, অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে কলেজে নগদ টাকায় গ্রহণ করে এর আয়-ব্যয়ে কোন সামঞ্জস্যতা নেই। এধরণের দুর্নীতিও গভর্নিং বডির সদস্যদের ম্যানেজ করে সংঘটিত হয়েছে।

অভিযোগে শিক্ষকরা আন্দোলনরত বলছেন, গভর্নিং বড়ির কতিপয় সদস্যগণ অধ্যক্ষের প্রশাসনিক ক্ষমতার বাইরে সময় সময় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিক্ষক-কর্মচারীদের উচ্চস্বরে বকাঝকা করা, তাদের চাকুরিচ্যুতির হুমকি প্রদর্শন, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ইত্যাদি বলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে থাকেন। গভর্নিং বডির সদস্যগণের কোন প্রশাসনিক ক্ষমতা বা এ ধরণের আচরণ দেখানোর সুযোগ নাই।

এছাড়াও অভিযোগ আছে, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ক্রয়, সংস্কার ও উন্নয়নমূলক কাজ দরপত্র বিহীন, বিল-ভাউচার বিহীন বা জাল দরপত্র ও জাল বিল-ভাউচারের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে সম্পন্ন করা হয়েছে। এধরণের দুর্নীতিতে প্রত্যক্ষভাবে গভর্নিং বডির সদস্যরা জড়িত রয়েছেন।

পাশাপাশি কতিপয় দুর্নীতিবাজ শিক্ষক ও গভর্নিং বডির সদস্যদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দুর্বল বা পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে রিটেক পরীক্ষা ফি, পুনঃভর্তি ফি ও বোর্ড পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে কোচিং বা মডেল টেস্ট ফি বাবদ অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করা এবং টেস্ট পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণদের নিকট থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বোর্ডের ফর্ম ফিলাপের সুযোগ দেয়া হতো। 

এ আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করছেন কলেজের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম, জীববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাজমুল হুদা, ইংরেজি বিভাগের সেগুপ্তা ইসলাম, সিএসই বিভাগের প্রভাষক মারুফ নেওয়াজসহ ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের প্রায় ৭০ জন শিক্ষক।

আন্দোলনে থাকা শিক্ষকরা জানিয়েছেন, গভর্নিং বডির সভাপতি ও তাদের সংশ্লিষ্টরা পদত্যাগ না কার পর্যন্ত কলেজে কোনো ক্লাস বা কোনো ধরনের কার্যক্রম চলতে দেওয়া হবে না। একইসাথে অনিয়মের হোতা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকেও কলেজ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। শিক্ষকরা বলছেন, ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের গভর্নিং বডির বর্তমান সভাপতি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান। প্রায় ১৪ বছর যাবত তিনি এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছেন। গভর্নিং বডিতে অন্যসব পদে কিছুটা পরিবর্তন এলেও সভাপতির পদটিতে এত বছরেও কোনো পরিবর্তন হয়নি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সুনাম চরমভাবে নষ্ট করছে উল্লেখ করে আন্দোলনরত সিএসই বিভাগের প্রভাষক মারুফ নেওয়াজ বলছেন, কিছুদিন আগে বিভিন্ন অনিয়ম করে ও প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন খাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট ও আত্মসাৎ করে সাবেক অধ্যক্ষ জসিম উদ্দীন আহম্মেদ, মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক তৌফিক আজিজ চৌধুরী ও বাংলা বিভাগের শিক্ষক তরুণ কুমার গাঙ্গুলী। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সুনাম চরমভাবে নষ্ট করেছেন তারা। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি ও কিছু সদস্য প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকায় এগুলো কখনোই প্রকাশিত হয়নি এবং এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।

‘‘অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত অধ্যক্ষ ও অপর দুই শিক্ষকের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ প্রাথমিক তদন্তের পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক তদন্ত কাজের জন্য কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া দীর্ঘ প্রায় পাঁচ মাস ধরে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ও আইনগত জটিলতায় আটকে রয়েছে।’’

শিক্ষকরা জোর দাবি জানান, বর্তমান গভর্নিং বডি বাতিল করে নতুন গভর্নিং বডি গঠনের ব্যবস্থা নিতে এবং তাদের দ্বারা সংঘটিত অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে।

শিক্ষকরা বলছেন, আমাদের দাবি মেনে নেওয়া না হলে একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধের এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। সংকট নিরসনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও সহযোগিতা পাবো বলে আমাদের বিশ্বাস। তারা বলেন, আমরা চাই দ্রুত সমস্যার সমাধান হোক, দ্রুত ক্লাসে ফিরতে চাই। তবে তা একটি সমাধানের মধ্যে দিয়ে হতে হবে। দেয়ালে পিঠ না ঠেকলে এমন কর্মসূচি আসতো না বলেও জানান শিক্ষকরা।

প্রতিষ্ঠানের নানা অনিয়ম আর অর্থ লোপাটের সাথে গভর্নিং বডির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আন্দোলনরত শিক্ষকদের দাবি ছিল অভিযুক্ত শিক্ষকদের স্থায়ী বহিষ্কার করার জন্য। অভিযুক্ত শিক্ষকদের স্থায়ী বহিষ্কার না করে সাময়িক বহিষ্কার করার কারণেই তারা এসব অভিযোগ করছেন। তিনি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

সামগ্রিক অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির অভিযুক্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, এটি এখনো আদালতের বিচারাধীন বিষয় তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করা উচিৎ হবে না। এছাড়াও এটি এখনো তদন্তাধীন রয়েছে এবং এ ঘটনায় অভিযুক্ত তিনজন শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আমরা শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি যেন তারা আন্দোলন না করে ক্লাসে ফিরে যান।


সর্বশেষ সংবাদ