উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ
গভর্নিং বডির নানা অনিয়ম, মানছেন না সরকারি আদেশও
- ইরফান হক
- প্রকাশ: ২২ মে ২০১৯, ১১:৫৭ PM , আপডেট: ২২ মে ২০১৯, ১১:৫৭ PM
রাজধানীর কাকরাইলে অবস্থিত উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের বয়স ৬২ পেরিয়েছে। বয়সের সাথে বেড়েছে সুনামও। কিন্তু সুনামকে পুঁজি করে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাচিত গভর্নিং বডির সদস্যরা ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অর্থ আয়ের মাধ্যমে ব্যক্তিগত লাভের পথ খুঁজে নেন, তখনই ঘটে বিপত্তি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি চলছে নাম মাত্র অধ্যক্ষ দিয়ে, যিনি কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারছেন না। সব ক্ষমতা গভর্নিং বডির নিকট। অন্যদিকে, তারা সরকারি কোন আদেশ তোয়াক্কা করছেন না। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।
গভর্নিং বডির নানা ধরণের দুর্নীতি এবং অনিয়মতান্ত্রিক নিয়োগ বন্ধ করে যোগ্য ও দক্ষ অধ্যক্ষ নিয়োগদানে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও অভিভাবকরা। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অভিভাবকদের এক লিখিত অভিযোগে বিষয়টি উঠে এসেছে।
জানা গেছে, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে সাড়ে ৯ হাজারেরও বেশি ছাত্রছাত্রী রয়েছে। আর শিক্ষক রয়েছে ৩০০ মতো। ২০০৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর তিনজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সুনামের সাথে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু ২০১৪ সালের নভেম্বরে সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহারের পর থেকে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে একজন প্রভাষক ভারপ্রাপ্তের অধ্যক্ষের দায়িত্বে চলছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে রয়েছেন মো. আবুল হোসেন। তার অদক্ষতা ও অযোগ্যতার কারণে গভর্নিং বডির সদস্যরা নানা ধরণের অনিয়ম ও দুনীর্তি করে আসছেন। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ।
অভিভাবকদের করা ওই অভিযোগে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়ম বহির্রভূত ফি আদায়, ১০ মাস যাবৎ শিক্ষক-কর্মচারীদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট বন্ধ, প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত উন্নয়ন ও অনুষ্ঠানের নামে অর্থ আত্মসাৎ, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম ও বাণিজ্য, অধ্যক্ষ নিয়োগে অবহেলাসহ গভর্নিং বডি বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম উঠে এসেছে।
অভিযোগ থেকে জানা গেছে, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত শিক্ষকদের ইনক্রিমেন্ট বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া অব্যবহৃত নৈমিত্তিক ছুটি ভাতা, উত্তরপত্র মূল্যায়ন ভাতা এবং প্রনোদনা বিগত ২ বছর যাবত বন্ধ রেখেছে বর্তমান কমিটি। অবসর গ্রহণকারী ১০ শিক্ষকের গ্র্যাচুইটিসহ বিভিন্ন প্রণোদনা বিগত দুই বছর বন্ধ রাখা হয়েছে।
বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের ৫ম, ৮ম, ১০ম ও দ্বাদশ শ্রেণির বিশেষ ক্লাশ, মডেল টেস্ট এবং ইংরেজি মাধ্যমের মুক টেস্ট বাবদ অর্জিত টাকার ৩০ শতাংশ গভর্নিং বডির সদস্যরা জোর করে ভোগ করে থাকেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের অনুপাত ৩২:১। সরকারী নিয়ম অনুযায়ী, সেই অনুপাত ৫০:১। ফলে অতিরিক্ত শিক্ষক থাকা সত্বেও নিয়োগ বাণিজ্য করার জন্য চলতি মাসের ৩ তারিখে পত্রিকায় শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। অথচ পূর্বে নিয়োগকৃত শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি স্থায়ীকরণে সময় দেড় বছরের বেশি হলেও তার কোন উদ্যোগে নেই। তাছাড়াও শিক্ষক নিয়োগে বডির চেয়ারম্যানের এক আত্মীয় অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও নিয়োগের পায়তারা চলছে।
চলতি বছরের ৫ মার্চ সরকারি পরিপত্র অনুযায়ী, তিন মাসের মধ্যে অধ্যক্ষ নিয়োগের নির্দেশনা ছিল। এরই প্রেক্ষিতে ২৫ মার্চ অধ্যক্ষ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিলে মোট ২২ জন এতে আবেদন করে। এই মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৩ জুন। কিন্তু তাতে গভর্নিং বডির অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। তারা বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. আবুল হোসেনকে পুনরায় নিয়োগ দিতে নানা তৎপরতা করছেন বলে জানা গেছে।
গভর্নিং বডির সদস্য মোজাম্মেল হকের বিরূদ্ধে নানানভাবে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানের জমির কাগজ-পত্র ভুল-ভ্রান্তির নামে তিনি ২০ লাখ টাকা আত্মাসাৎ করেছেন; পিয়ন ধনু মিয়ার কাছ থেকে তিনি ২ লাখ টাকা আত্মাসাৎ করেছেন; পরীক্ষার সেন্টার ম্যানেজ করার নাম চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাথাপিছু দুই হাজার টাকা করে নিয়েছেন মোজাম্মেল হক।
গত বছর বার্ষিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের টাকার বিনিময়ে গভর্নিং বডির সদস্য মোজাম্মেল হক ও আশিকুর রহমান নাদিম প্রমোশনের ব্যবস্থা করছেন। অধ্যক্ষের কক্ষে সারাক্ষণ অবস্থান করেন মোজাম্মেল হক। ফলে কোন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক অধ্যক্ষের সঙ্গে সহজে দেখা করতে পারেন না। প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল হোসেন, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে থাকার পরও তিনি দায়িত্বের অতিরিক্ত কলেজের শাখা প্রধান হিসেবে অতিরিক্ত সম্মানী গ্রহণ করছেন। সিসি ক্যামরা ও ভবনের সাব মারসিবল মটর বসানো বাবদ অধ্যক্ষ ও গভর্নিং বডির সদস্যরা ২০ লাখ টাকা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গভর্নিং বডি প্রায় ২০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করছেন বলে অভিযোগ উঠে।
শরিফ উদ্দিন অনিম নামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের অযোগ্যতা ও অদক্ষতার কারণে ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে অদ্যবদি পর্যন্ত নির্বাচিত গভর্নিং বডি নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করেই চলছে। ফলে মারাত্মকভাবে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তাই অভিভাবকদের পক্ষ থেকে আমরা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র এক শিক্ষক বলেন, গভর্নিং বডির সীমাহীন দুর্নীতি আর অধ্যক্ষের অদক্ষতা এই স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ম্লান হতে চলছে। একদিকে, টাকার বিনিমনেয় ভর্তি হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা আর অন্যদিকে, ভালো শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ফলে আমি বলবো প্রতিষ্ঠানটি সার্বিক দিক থেকে পড়াশুনার মান ব্যহত হচ্ছে।
গভর্নিং বডির সদস্য মোজাম্মেল হক বলেন, এ ধরণের অভিযোগতো অনেকেই করে থাকেন। তবে এসবের ভিত্তি নেই। আপনারা সরেজমিনে এসে দেখেন কোন ধরণের অনিয়ম-দুর্নীতি করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ফোনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতি আরিফুর রহমান টিটুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।