ইসলামে তাকওয়ার গুরুত্ব ও ফজিলত
- আজিজুর রহমান
- প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২২, ০১:০৬ PM , আপডেট: ২৩ মে ২০২২, ০২:৫৩ PM
ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তির একমাত্র উপায় তাকওয়া। পবিত্র কোরআনের বহু যায়গায় তাকওয়া অর্জনের তাকিদ দেয়া হয়েছে। কেননা তাকওয়া অবলম্বনের ফলে মানুষ সত্য পথের সন্ধান পায়। আল্লাহ এসব মানুষের অন্তর প্রশান্তিতে ভরিয়ে রাখেন। ফলে তারা হতাশা মুক্ত এক সফল জীবনের অধিকারী হয়ে উঠেন।
পবিত্র কোরআন মাজিদে সূরা তালাকের ২নং আয়াতে তাকওয়া অবলম্বনকারীদের সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন করবে, আল্লাহ তার জন্য সঙ্কট থেকে উত্তোরণের পথ তৈরি করে দেবেন এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিজিক দেবেন, যা তার ধারণারও বাইরে।’
তাকওয়া আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, বেঁচে থাকা ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় একমাত্র আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখাই তাকওয়া। যে ব্যক্তি তাকওয়ার পথ অবলম্বন করে তাকে মুক্তাকী বলা হয়। জীবনের প্রতিটি কাজকর্মের অগ্র-পশ্চাত কিংবা দিবা-নিশিতে আল্লাহর ভয় অন্তরে জাগরূক রেখে আমলের প্রতিটি স্তর পার করলেই কেবল মুমিন মুত্তাকী হওয়া যায়।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, কাঁটাযুক্ত দুর্গম পথে মানুষ নিজেকে বাঁচার জন্য যে সতর্কতা অবলম্বন করে, ঠিক তেমনি পরকালের কঠিন শাস্তির ভয়ে দুনিয়াতে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী আমল করার নাম তাকওয়া।
তাকওয়ার উপকারিতা
দুনিয়াতে তাকওয়ার পথ অবলম্বন করলে ইহকালে শান্তি এবং পরকাল মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কেননা মুমিন ব্যক্তিকে আল্লাহ ভালবাসেন। তাদের দুনিয়ায় ও আখেরাতে কোন ভয় থাকবেনা। বিপদাপদে মুমিনদের আল্লাহ গায়েবি মদদে সাহায্য করে থাকেন। সূরা তালাকে আল্লাহ বলেন, ‘যে কেউ আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার নিস্কৃতির পথ বের করে দেবেন এবং তার ধারণাতীত স্থান থেকে তাকে রিজিক দান করবেন।’
সূরা আরাফে উল্লেখ রয়েছে, ‘যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে এবং নিজেকে সংশোধন করেছে কিয়ামতের দিন তার কোনো ভয় নেই এবং কোনো দুশ্চিন্তায়ও তাকে গ্রাস করবে না।’
আরও পড়ুন: তুলসী পাতার স্বাস্থ্য উপকারিতা
মুত্তাকিদের সকল গুণাহ ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে সূরা আনআমে আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো, তোমাদের জন্যে আল্লাহ সত্য-মিথ্যা, হক-বাতিল অনুধাবন করার বুঝ দেবেন, তোমাদের থেকে মন্দগুলো দূর করবেন এবং গোনাহসমূহকে ক্ষমা করে দেবেন। মহান আল্লাহ বড় দয়ালু ও রহমওয়ালা।’
অথচ মানুষ আল্লাহকে ভুলে দুনিয়ার সাময়িক সুখের নেশায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ একটুতেই জীবনের গতিপথ জটিল করে হতাশ হয়ে পড়ে। পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ও ভোগবিলাসের জন্য শয়তানের পথ অনুসরণ করেন।
কিন্তু সূরা তালাকের ৪নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যে তাকওয়া অবলম্বন করবে, আল্লাহ তার কাজগুলোকে সহজ করে দেবেন।
তাকওয়া অর্জনের উপায়
খোদাভীতি অর্জনের পদ্ধতি বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা সূরা তওবায় বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।’
আল্লাহকে ভয় করার ক্ষেত্রে সত্যবাদী মানুষের সহচর্য গুরুত্বপূর্ণ। সত্যবাদিরাই কেবল আল্লাহ সান্নিধ্যে আসতে পারে। মিথ্যাবাদীরা মানুষকে গোমরাহ করে। তাই তাকওয়া অর্জনে সত্যবাদীদের সঙ্গ জরুরি।
ঈমান বৃদ্ধির অন্যতম পন্থা আল্লাহকে বেশি বেশি স্বরণ করা। আল্লাহর জিকিরেই কেবল অন্তর পরিস্কার হয়। তাই রাসূল (সা.) মানুষের অন্ততকে পবিত্র রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, 'মনে রেখো, নিশ্চয়ই মানুষের শরীরে একটি গোশতের টুকরো আছে, যা ঠিক থাকলে সমস্ত দেহই ঠিক থাকে। আর তার বিকৃতি ঘটলে সমস্ত দেহেরই বিকৃতি ঘটে। সে গোশতের টুকরাটি হলো- ‘কলব/ অন্তর।’ –সহীহ বোখারি ও মুসলিম
আরও পড়ুন: পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে সুস্থ থাকা যায়: গবেষণা
ঈমান বৃদ্ধিতে জিকিরের গুরুত্ব তুলে ধরে সূরা তাহায় আল্লাহ বলেন, ‘আর যে আমর যিকির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, অবশ্যই তার দুনিয়ার জীবন হবে সংকীর্ণ।’
তাই তাকওয়া অর্জনে অন্তরকে পরিস্কার রাখা জরুরি। একইসাথে সত্যবাদী সঙ্গী প্রয়োজন। যারা সর্বদা তাকওয়ার উপর অটল থাকে এবং অন্যকে সে পথের সন্ধান দেন।
তাকওয়ার গুরুত্ব
ইসলামে তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা খোদাভীতি ছাড়া ঈমানদার হওয়া যায় না। তাই খোদভীতির প্রতি গুরুত্বারোপ করে মহান রব্বুল আলামিন সূরা ইমরানেন ১০২নং আয়াতে বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করার মতো ভয় করো এবং পরিপূর্ণ ঈমানদার না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।
তাছাড়া ঈমানের বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে সূরা আরাফের ৯৬নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘যদি এলাকার লোকজন ঈমান আনয়ন করতো এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকওয়া অবলম্বন করতো, তাহলে আমি আল্লাহ তাদের আসমান ও জমিনে বরকতের দরজাসমূহ খোলে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে (আমার আয়াতকে) তাদেরকে আমি পাকড়াও করবো, তাদের অর্জিত পাপের কারণে।’
মানুষের মন প্রকৃতিগতভাবে শয়তান দ্বারা প্রভাবিত হয়। আর শয়তান সব সময় মানুষকে অসৎ ও অন্যায় কাজ করার জন্য ওয়াসওয়াসা দিয়ে আল্লাহদ্রোহিতায় প্ররোচিত করে। ফলে সমাজে জিনা-ব্যভিচার থেকে শুরু করে সুদ-ঘুষ, প্রতারণা, চুরি-ডাকাতি, হত্যা ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন জুলুমে মানুষ সহজেই লিপ্ত হয়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে তাকওয়ার পথ অবলম্বন অনস্বীকার্য।
তাকওয়ার মানদন্ডেই কেবল মানুষের সত্যিকার আভিজাত্য ও সম্মান নিহিত আছে। সূরা হুজুরাতে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের মাঝে সে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাবান যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।’
পাপমুক্তিতে তাকওয়া
সকল পাপাচার থেকে মুক্তির একমাত্র পথ তাকওয়া। তাকওয়ার গুণ মানুষকে পাপ থেকে দূরে রাখতে পারে। যেখানে তাকওয়া নেই, সেখানে শান্তি নেই। আল্লাহ তাকওয়া বিমূখি মানুষের উপর শান্তি বর্ষণ করে না। কেননা আল্লাহ মানুষকে শুধু তার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। আর ইবাদাত কবুল হওয়ার পূর্ব শর্ত তাকওয়া। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ শুধুমাত্র মুত্তাকিদের ইবাদত কবুল করেন।’ –সূরা মায়িদা: ২৭
সমাজ, দেশ ও জাতির সর্বস্তর আজ পাপাচারে দগ্ধ। প্রতিনিয়ত হচ্ছে গুরুতর পাপ। অথচ এসব গুরুতর পাপ কাজ করার পরেও মানুষের মধ্যে নূন্যতম কোন অনুশোচনাবোধ নেই। প্রতিনিয়ত তারা একই ধরণের কাজ করেই চলেছে। যা কেবল মানুষের অন্তরে তাকওয়ার না থাকার ফল।
আরও পড়ুন: তারাবির নামাজ কী, কীভাবে পড়বেন
অথচ হাদিসে এরশাদ হয়েছে, হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ‘হে আয়েশা! ক্ষুদ্র নগণ্য গুনাহ থেকেও দূরে থাকবে। কেননা আল্লাহর দরবারে (কিয়ামতের দিন) সেগুলো সম্পর্কেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’-ইবনে মাজাহ
সুতরাং তাকওয়ার গুণেই কেবল পাপমুক্তি সম্ভব। এপথেই রয়েছে ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তি। সূরা নাবার ৩১নং আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয়ই মুত্তাকিদের জন্য রয়েছে (ইহকালে-পরকালে) সফলতা।’