‘গত দুই দশকে এমন নারী বিদ্বেষী চলচ্চিত্র দেখিনি’

পরাণ ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রী
পরাণ ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রী  © ফাইল ছবি

সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত পরাণ ছবি নিয়ে সারাদেশে বইছে প্রশংসার জোয়ার।  ছবিতে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন বিদ্যা সিনহা মিম ও শরিফুল রাজ। প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহেই ছবিটি হাউজফুল। তবে এর বাইরেও ছবিটি নিয়ে রয়েছে সমালোচনা। ছবিতে নারীকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করায় সিনেমা বিশ্লেষকরা একে অন্যভাবে দেখছেন।

পরাণ ছবিটি বহুল আলোচিত বরগুনায় প্রকাশ্য দিবালোকে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় নির্মিত বলে অনেকেই মনে করছেন। ঘটনাটি এখনো হাইকোর্টে বিচারাধীন। ফলে পরাণ ছবির নারী চরিত্রকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সেটি বিচারকে প্রভাবিত করতে পারে বলেও আশঙ্কা সিনেমা বিশ্লেষকদের।

তাদের মতে, পরাণ ছবিতে প্রধান তিনটি নারী চরিত্রকেই ‘নেগেটিভ’ ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অনন্যাকে দেখানো হয়েছে মূল অপরাধী হিসেবে। তার কারণে তিনটি জীবন নষ্ট হয়েছে বলে ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া ছবিতে মিন্নির তৃতীয় প্রেমিককে হাজির করার ঘটনাটিও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

পরাণ ছবিতে নারীকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন চলচ্চিত্র বিশ্লেষক এবং গ্রিন ইউনিভার্সিটির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মনিরা শরমিন।

আরও পড়ুন: রুম সংকট কাটলেও অনিশ্চিত ১৭তম নিবন্ধন পরীক্ষা

তিনি তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘‘আমি গেলো দুই দশকে বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্রে এত অকারণ নারী বিদ্বেষ পোট্রে হইতে দেখি নাই। অকারণে নারীকে এত অপমান করতেও দেখি নাই। আমরা যখন একজনের ইংলিশ বানান আর উচ্চারণ শিখানোর দায় নিয়ে বসে আছি; তখন, একই সময়েই বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীর জন্য সবচেয়ে পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট এবং অবমাননাকর সিনেমাগুলোর একটি মুক্তি পেয়েছে। আমরা তাকে ভালো বলেছি। কেনো ভালো বলেছি তার কারণ আমার জানা নাই।এই সিনেমায় রাজের অভিনয় ছাড়া আর কিছু নাই, কিছুই নাই। রায়হান রাফি মোরাল পুলিশিং এর সবটুকু দ্বায়িত্ব গ্রহণ করে জাতিকে ধন্য করেছেন পরাণ নির্মাণের মধ্য দিয়ে।‘’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মনিরা শরমিন প্রীতু দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, একটা চলচ্চিত্র কীভাবে তৈরি হচ্ছে, কখন তৈরি হচ্ছে সেটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ছবিতে প্রথমেই দেখানো হয় একটি নারী অনেক বোকা, সে কখনোই পরীক্ষায় পাস করতে পারে না এবং একই সাথে সে লোভী। এই লোভী নারী এক সময় একজন ‘গুন্ডা’কে ব্যবহার করে এবং একজন মেধাবী ছাত্রকে ব্যবহার করে পরীক্ষায় পাস করছে। ছবিতে সেই পাস করা পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। তবে সেই নারী কীভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো সেটি দেখানো হচ্ছে না।

তিনি বলেন, ছবিতে বিয়ের পর দেখানো হয়েছে সে রান্নাবান্না পারে না। নারীর রান্না না জানা একটি খারাপ বিষয়, সেটাও আলাপে এসেছে। অনন্যাকে ভিলেনাইজ করতে বাইনারি অপজিশনে তাকে সম্পূর্ণ নেগেটিভ হিসেবে দেখানো হয়েছে। সব ধরনের খারাপ জিনিসকে তার ওপর অকারণে প্রয়োগ করা হয়েছে। ফলে আমাদের সমাজে বাজে নারীর যে ধারণা বহুল প্রচলিত তার প্রত্যেকটাই রাফি অনন্যা চরিত্রের মধ্যে নেগেটিভলি ইমপোজ করা হয়েছে।

এই চলচ্চিত্র বিশ্লেষক মনে করেন, ছবিতে অনেকগুলো পুরুষতান্ত্রিক ‘মেটাফোর’ ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া একটি দৃশ্যে দেখা যায় অনন্যা রোমানের সাথে ঘুরতে যায় তখন অনন্যা বলে; আমি কিন্তু অন্য মেয়েদের মতো মোটরসাইকেলে একপাশে পা দিয়ে বসতে পারবো না। এখানে জেন্ডার সংক্রান্ত আদি স্টেরেওটাইপকেই পোট্রে হতে দেখি।

আরও পড়ুন: ২৭ বছর আগের ‘গাভী বিত্তান্ত’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখনকার প্রতিচ্ছবি

তিনি আরও বলেন, ছবিটি যদি আমরা বাস্তবতার নিরিখে আলোচনা করি তখন আমরা দেখেছি নয়ন বন্ড পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন। তবে ছবিতে আমরা দেখতে পাই রোমানকে হত্যার জন্য অনন্যার তৃতীয় প্রেমিককে আমদানি করা হয়। তার মাধ্যমে অনন্যার প্রথম প্রেমিককে হত্যা করা হয়। ফলে এই তিনটি হত্যার জন্য একজন নারীকে দোষী করা হয়েছে। 

সমাজে নারীদের দোষারোপ করার যে প্রচলন সেটিকেই এই সিনেমা প্রমোট করছে। ভয়ঙ্কর নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের মত ঘটনা  অহরহই ঘটছে সমাজে, তাই পপুলার সিনেমা বানানোর আগে এগুলা মাথায় রাখা দরকার বলে মনে করি। কারণ এসব মানুষকে প্রভাবিত করে।


সর্বশেষ সংবাদ