ভাসমানদের ভয় তাড়া করছে ঢাবি ছাত্রীদের

এভাবে রাত কাটান ক্যাম্পাসের ভাসমান লোকরা
এভাবে রাত কাটান ক্যাম্পাসের ভাসমান লোকরা  © ফাইল ফটো

ছাত্রী ধর্ষণের প্রতিবাদে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। গত রবিবার রাজধানীর কুর্মিটোলায় সংগঠিত ওই ধর্ষণের প্রতিবাদে সোমবার থেকে শুধু ঢাবি ক্যাম্পাস নয়, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। যার রেশ এখনও কাটিয়ে উঠেনি। এদিকে, বুধবার ভোরে এ ঘটনায় জড়িত মজনু নামে এক ভাসমান লোককে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এরপর আলোচনায় আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যত্রতত্র ভাসমান লোকের অবাধে বিচরণের বিষয়টি। ফলে ক্যাম্পাসের ছাত্রীদের মাঝে এক ধরণের আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনের নেতারাও ভাসমানমুক্ত ক্যাম্পাস গড়তে প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন। বুধবার বিভিন্ন হলের মেয়ের উদ্যোগে আয়োজিত নারী সমাবেশ থেকে যে ৮ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ক্যাম্পাস থেকে ভাসমান পাগল ও ভবঘুরদের অপসারণ। ঢাবি প্রশাসনও বলছে, আগামীতে ক্যাম্পাস এলাকায় কোন ভবঘুরে কিংবা ভাসমান লোক থাকতে পারবে না। এসব বন্ধে প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেওয়া হবে।

গত ২৮ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এক ছাত্রী ভাসমান এক লোক দ্বারা হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সে সময় লোকটিকে শিক্ষার্থীরা হাতে-নাতে ধরলে অনেকেই তাকে পাগল মন্তব্য করায় পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও কিছুদিন আগে এক ছাত্রী রাজু ভাস্কর্যের সামনে রিকশার জন্য দাঁড়ালে এক ভবঘুরে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরে ওই শিক্ষার্থী বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সর্বশেষ গত রবিবার রাজধানীর কুর্মিটোলায় মজনু ভাসমান এক লোকের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক ছাত্রী। 

এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা আতঙ্কে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন তারা। একাধিক ছাত্রীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ক্যাম্পাসে আগের চেয়ে পাগল এবং ভবঘুরে লোকের চলাফেরা বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, রয়েছে প্রচুর ছদ্মবেশী ভিক্ষুক। এসব কারণে বিভিন্ন সময়ে ছিনতাইকারীর হাতেও পড়তে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। 

ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে এবং শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে এসব ভবঘুরে লোকের চলাফেরা সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। কলাভবন, টিএসসি, কার্জন হল, শহীদ মিনার এলাকা, মল চত্ত্বর, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রভৃতি এলাকায় এদের রয়েছে অবাধ বিচরণ। তাছাড়া পলাশী থেকে শহীদ মিনারের রাস্তা, টিএসসি থেকে জগন্নাথ হলের রাস্তায় প্রায় ছিনতাই-ইভটিজিংয়ের মতো ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় শিক্ষার্থীদের। এই এলাকায় কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাত করেও ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে বলে জানা গেছে। এছাড়া ভিসির বাসভবনের সামনে স্মৃতি চিরন্তন এলাকায়ও ভবঘুরদের আনাগোনা লক্ষ্য করার মত।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারাহ জাহান শুচি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ক্যাম্পাসে প্রায়ই ভিক্ষুক-ভবঘুরে লোকদের দেখতে পাই। এদের দুরাবস্থার জন্য খারাপ লাগলেও মাঝেমাঝে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। আমি চাইব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন সজাগ দৃষ্টি রাখেন; বিশেষত তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা দরকার। প্রক্টরিয়াল টিম এ কাজে ভালো ভূমিকা রাখতে পারবে।

ইংরেজি বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র রাকিব উদ্দিন বলেন, প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে উচ্চশিক্ষার নিমিত্তে প্রতিষ্ঠিত স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। যেখানে স্টুডেন্ট এবং রেজিস্টার্ড অফিসিয়ালস ব্যতিরেকে অন্যান্যদের প্রবেশাধিকার সীমিত; ক্ষেত্র বিশেষে নিষিদ্ধ করা দরকার। কিন্তু ঢাবি ক্যাম্পাসের যত্রতত্র হকার, ছদ্মবেশী ভবঘুরে কিংবা মাদকাসক্তদের লক্ষণীয় বিচরণ এবং উৎপাত কোনক্রমেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ এবং সংস্কৃতির সাথে যায় না। কেননা এতে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুস্থ পরিবেশ বিনষ্ট হয়, তেমনি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ারও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, মাদকের সহজলভ্যতা দিনকে দিন শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মাদকাসক্তদের ক্যাম্পাসের দিকে চুম্বকের ন্যায় টেনে আনছে। ফলে এতে ক্যাম্পাসে মাদকের মহামারির পাশাপাশি নেশাসক্তদের লাম্পট্য বেড়েই চলছে। আর তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে সুন্দর, সাবলীল, নিরাপদ এবং শিক্ষাবান্ধব করে তুলতে হলে অবশ্যই বহিরাগত অনুপ্রবেশ, ভবঘুরে এবং অবাধ পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশনের লাগাম টেনে ধরতে হবে। আর তা করতে হবে অচিরেই; ঢাবি তার স্বকীয়তা এবং প্রাতিষ্ঠানিক আবেদন হারোনোর পূর্বেই।

এদিকে বিডি ক্লিনের সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইসমাইল হোসাইন সিরাজী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে ক্যাম্পাস থেকে পাগল, ভবঘুরে, ভিক্ষুক তাড়ানোর জন্য তার নেতৃত্বে ৫০ জনের একটি টিম গঠন করার কথা জানান এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ সহযোগিতা কামনা করেন।

এ বিষয়ে বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আক্তারুজ্জামান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোনো পাগল, ভবঘুরে, ফেরিওয়ালা, হকার বা ভ্রাম্যমাণ কেউ থাকতে পারবে না। নির্দিষ্ট কিছু ফেরিওয়ালা থাকবে, যাদের প্রক্টর অফিস থেকে আইডি কার্ড দেওয়া হবে৷ এছাড়া কাউকে দেখলে ক্যাম্পাসের বাহিরে বের করে দেওয়া হবে।

ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভবঘুরে লোকের ঘুরে-বেড়ানো বন্ধ করা দরকার। প্রয়োজনে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেওয়ার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখছি। তাছাড়া বহিরাগত চলাচল নিয়ে কর্তৃপক্ষকে এখন ভাবার সময় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু উন্মুক্ত তাই এই কাজ করা আমাদের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জের বিষয়। তাই বহিরাগত নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি নিদির্ষ্ট সময়ের জন্য আমাদের সীমাবদ্ধতা দিতে হবে। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সার্বিক সহযোগিতা দরকার

বৃহস্পতিবার এক মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন বলেন, আমাদের এই প্রাণপ্রিয় ক্যাম্পাসে শত শত মজনু অবাধে বিচরণ করছে। অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই মজনুদের কারণে ছাত্রীরা ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারছেন না। অনেক ভবঘুরে মাদকাসক্তেরও বিচরণ এই ক্যাম্পাসে। তাই এই ক্যাম্পাসকে বহিরাগত মুক্ত করতে হবে। যাতে আর কোন নারী শিক্ষার্থী এ ধরণের হেনাস্তার শিকার না হয়।

ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ফেসবুকে লেখেন, ধর্ষক মজনুর মতো এমন চেহারার অনেকেই আমরা নিয়মিতভাবে দেখে আসছি। তার মতো অনেক নেশাখোর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রাস্তায় নিয়মিতভাবে নেশা করে এবং অবস্থান করে। আমরা এদেরকে দেখেও তখন ভদ্রলোকের মতো পাশ কাটিয়ে চলে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদেরও অনেক কিছু করার আছে, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আওয়াজ তুলুন।


সর্বশেষ সংবাদ