এমডির কক্ষ থেকেই বিমানের প্রশ্নফাঁস, ফোনে ছবি তুলে সরবরাহ

  © সংগৃহীত

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষা বাতিল ও সার্বিক তদন্তে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা (লালবাগ) বিভাগ। তদন্তে ও গ্রেপ্তার হওয়া ১০ জনের মধ্যে ৯ জনের দেওয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে স্পষ্ট হয়েছে এমডির কক্ষ থেকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৫০ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে। আরও অনেক ব্ল্যাংক চেক উদ্ধার করা হয়েছে।

ডিবি বলছে, বিমান বাংলাদেশ একটি পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের এমডির কক্ষ থেকে প্রশ্নফাঁস করেছেন জাহিদ নামে এমডির অফিস সহকারী। নিয়োগ পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে একটি কমিটি রয়েছে। তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি।

“এখানে অনেক লোকের চাকরি হওয়ার কথা। তারা দায় এড়াতে পারেন না। এ ঘটনায় যাদের দায় রয়েছে, যারা প্রশ্নফাঁস করেছেন, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ইতোমধ্যে নিয়োগ পরীক্ষার সদস্যদের কাউকে ফোনে কাউকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।”

আজ বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপির গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ।

তিনি বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নিয়োগ পরীক্ষার আগের দিন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। প্রশ্নফাঁস ও জালিয়াতির ঘটনায় গত ২১ নভেম্বর ডিবি লালবাগ প্রথম দিনই বিমানবন্দর, কাউলা থেকে আওলাদ হোসেন (২১), জাহাঙ্গীর আলম (৩৫), এনামুল হক (২৮), হারুন-অর-রশিদ (৪০) ও মাহফুজুল আলম (৩১) নামে বিমান বাংলাদেশের পাঁচ কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করে। এসময় তাদের কাছ থেকে প্রশ্নপত্রের সফ্টকপি, টাকা, ব্যাংকের চেক, স্ট্যাম্প, মোবাইল নাম্বার, ডায়েরি ও পরীক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র উদ্ধার করা হয়।

এরপর প্রশ্নফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের আরও ৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন- মো. মাসুদ (৩৪), জাহিদ হাসান (২৮), সমাজু ওরফে সোবহান (৩০), জাবেদ হোসেন (২৮) এবং জাকির হোসেন (২৯)। গ্রেপ্তারের সময় তাদের হেফাজত থেকে নগদ দেড় লাখ, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক-৩২টি, নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প-১৭টি, মোবাইল ফোন ১৪টি, মোটরসাইকেল, ডায়েরি ৩টি, ফাঁস হওয়ার প্রশ্নপত্রের হার্ডকপি ও সফটকপি এবং নিয়োগ প্রার্থীদের প্রবেশপত্র ৫৪টি জব্দ করা হয়।

ডিবি প্রধান হারুন বলেন, গ্রেপ্তার ১০ জনের মধ্যে ৯ জন প্রশ্নফাঁসে নিজেদের ও অন্যদের দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তারা প্রশ্নফাঁসের যাবতীয় অপকর্মের বিবরণ দিয়েছেন। 

হারুন বলেন, পরীক্ষা কমিটির মূল জিএম এডমিনের কক্ষে প্রশ্নপত্র রেডি হয়। সেখান থেকে একজন প্রশ্নপত্রের ছবি তোলেন। ২০ নভেম্বর বিমানের লোগো মুছে ফেলে ৮০টি প্রশ্ন টিক চিহ্ন দিয়ে আরও দুজনের কাছে সরবরাহ করে। ওই দুজন মোটরসাইকেলে করে চলে যায়। 

আবার ১৯ নভেম্বরের সামারাইজ প্রশ্নের ফটোকপি এমডির অফিস সহকারী জাহিদ হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি স্মার্টফোন সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ফটোকপির সময় ছবি তুলে সোবহানের কাছে পাঠিয়ে দেন। সোবহান আরও কয়েকজনের কাছে সরবরাহ করেন।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র তৈরি, প্রিন্টিং ও পরীক্ষার আয়োজনের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেন। যাবতীয় কার্যক্রম তারা করেন। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু এমডির অফিস সহকারী জাহিদ ছবি তুলে তা ফাঁস করেন। উচিত ছিল যারা দায়িত্বে ছিলেন দেখভালের তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি।

আদালতে গ্রেপ্তাররা বলেছেন, এর আগে বিভিন্ন নিয়োগের সময় একইভাবে তারা বিমান বাংলাদেশের নিয়োগ সংক্রান্ত অপকর্ম করেছেন, চুরি করে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন। গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি ও যাবতীয় ডিজিটাল তথ্য-উপাত্তে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, তারা অর্থের বিনিময়ে আগেও অপকর্ম করেছেন। ২১ নভেম্বরেও তারা অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন প্রার্থীর কাছ থেকে নগদ টাকা সংগ্রহ, প্রশ্নসহ উত্তরপত্র বিতরণ করেছেন। তারা আরও অনেকের নাম বলেছেন। আমরা তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবো।

এক প্রশ্নের জবাবে হারুন-অর-রশিদ বলেন, বিমান বাংলাদেশ একটি পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) পক্ষ থেকে প্রশ্নফাঁস করেছেন অফিস সহকারী জাহিদ। নিয়োগ পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে জড়িত কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব ছিল সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা। কিন্তু তারা এড়াতে পারেন না। এই ঘটনায় গ্রেপ্তাররা নিয়োগ কমিটির সদস্যদের জড়িত থাকার বিষয়টি বলেছেন। তাদের দায় রয়েছে। 

হারুন বলেন, আমরা ১৬৪ ধারায় গ্রেপ্তারদের জবানবন্দি বিশ্লেষণ করছি। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছি। সবকিছু মিলে যাদের বিরুদ্ধে প্রশ্নফাঁসে দায় এসেছে, তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। ইতোমধ্যে নিয়োগ পরীক্ষার সদস্যকের কাউকে ফোনে কাউকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

গ্রেপ্তার কোনো আসামির জবানবন্দিতে এমডির নাম এসেছে কি না জানতে চাইলে হারুন বলেন, যাদের দায় আছে তাদেরকেই আইনের আওতায় আনা হবে। মামলার তদন্ত ও নিষ্পত্তির স্বার্থে প্রয়োজনে আরও অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এখন পর্যন্ত আমরা বিমানের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ৫০ লাখ টাকা লেনদেনের কংক্রিট তথ্য পেয়েছি। আমরা তদন্ত করছি।

প্রসঙ্গত, গত ২১ নভেম্বর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১২টি পদে নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু পরীক্ষার আগেও একটি অসাধুচক্র বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইনসের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। নিয়োগপ্রত্যাশী প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ফটোকপি-সফটকপি বিক্রি করেন। ডিবি লালবাগ অভিযোগ পেয়ে অভিযানে নামে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় গত ২৬ নভেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। মামলাটি গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগে তদন্তাধীন।


সর্বশেষ সংবাদ