গাভী বিত্তান্ত: যেন বর্তমান সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরই প্রতিচ্ছবি

গাভী বিত্তান্ত: যেন বর্তমান সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরই প্রতিচ্ছিবি
গাভী বিত্তান্ত: যেন বর্তমান সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরই প্রতিচ্ছিবি  © টিডিসি ফটো

যারা আহমদ ছফার বই বা লেখা ইতোপূর্বে পড়েছেন তারা জানেন তার লেখনি কত তীক্ষ্ণ। জীবনবোধের গভীরতম প্রকাশ তার রচনাগুলো। ‘অর্ধেক মানবী অর্ধেক ঈশ্বরী’ দিয়ে আহমদ ছফার লেখনির সাথে পরিচয় হয় আমার। ‘গাভী বিত্তান্ত’ নাম দেখে ভেবেছিলাম নিশ্চয় এতে গরু নিয়েই বেশি লিখা হয়েছে! কিন্তু পড়তে গিয়ে নামকরণের যথার্থতা অনুভব করেছি। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ নানা অসঙ্গতি- শিক্ষক রাজনীতি, ছাত্র রাজনীতি নিয়ে লেখা বই গাভী বিত্তান্ত।

আমাদের সমাজে এমন কিছু বিষয় আছে যা অপ্রকাশিত কিন্তু সকলেই জানে। লেখক সেই অপ্রকাশিত বিষয়গুলোকে সাহিত্য রূপ দিয়েছেন। বইটি পড়ে অনুভব করেছি লেখকের চিন্তাশক্তি কতটা গভীর। খুব জটিল এবং ভারী কিছু বিষয়কে তিনি রম্যতার গুণে হালকা ও উপভোগ্য করে তুলেছেন।

বইয়ের কাহিনী শুরু হয় সদ্য উপাচার্য পদে নিয়োগপ্রাপ্ত মিঞা মুহাম্মদ আবু জুনায়েদকে নিয়ে। একেবারেই গোবেচারা ও নির্ভেজাল একজন মানুষ হঠাৎ করে কিভাবে এত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন তা সকলের কাছেই আশ্চর্যের বিষয় ঠেকে। জীবন প্রবাহের জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে সহজে উপাচার্য পদে আসীন হলেও দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আবু জুনায়েদ তিক্ত কিছু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। উপাচার্য হওয়ার আগে আবু জুনায়েদ ছিলেন রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক। নির্ঝঞ্ঝাট ও মিনমিনে স্বভাবের লোকটি শুধুমাত্র কাঁচাবাজারেই তার পৌরুষত্ব দেখাতেন। স্ত্রীর বাপের টাকায় লেখাপড়া করেছেন বলে স্ত্রীর কাছে সকাল-বিকাল খোটা শুনতে হত। কৃষক পরিবারের সন্তান আবু জুনায়েদ ব্যক্তি হিসেবে সাধারণ। শুধু জমি কেনার বিষয়ে তার আকাঙ্ক্ষা ছিল নেশার মতো।

আবু জুনায়েদকে ঘিরে লেখক অবতারণা করেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরমহলের দৈনন্দিন ঘটনা। সাধারণ দৃষ্টিতে বইটি রম্য বলে মনে হলেও পর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে গভীর বেদনা কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সিন্ডিকেট, টেন্ডার সবকিছু পরিচালিত হয় কিছু অসাধু ব্যক্তির ছত্রছায়ায়। রাষ্ট্রযন্ত্রের মেরুদণ্ডই যদি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তাহলে অন্যান্য ক্ষেত্রের অবস্থা কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়।

শিক্ষক রাজনীতির দুষ্টচক্রে উপাচার্য নির্বাচনের প্যানেলে নাম আসে আবু জুনায়েদের। নিজ ডিপার্টমেন্ট এর শিক্ষিকা দিলরুবা খানমের চালে ভাগ্যচক্রে উপাচার্য কর্তৃক নিয়োগ পান তিনি। সকল ক্ষমতার উৎস হয়ে পদে পদে সম্মুখীন হন নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা ও বাঁধার। রবীন্দ্রনাথের খ্যাতির বিড়ম্বনা কবিতার মতো আবু জুনায়েদ পড়েন দায়িত্বের বিড়ম্বনায়। উপাচার্য ভবনে ওঠার প্রথম দিন থেকেই আবু জুনায়েদ ও তার স্ত্রীর মধ্যে কাজ করে মধ্যবিত্ত কমপ্লেক্স। সে পোশাক আর স্যুট টাই দিয়ে দুর্বলতা ঢাকার চেষ্টা করত আর তার স্ত্রী সারাবাড়িতে কর্তৃত্ব প্রকাশের চেষ্টা করতেন।

উপাচার্য ভবনের বিশাল আঙিনা দেখে আবু জুনায়েদের একটি সাধ পূরণের ইচ্ছা জাগে। পূর্বে কোয়ার্টারে থাকায় গাভী পালনের আজন্ম লালিত ইচ্ছেটি অপূর্ণ রয়ে যায় তার। আবু জুনায়েদ ছোটবেলায় বরাবর ভাল ফলাফল করতেন। প্রতিদিন বিকালে খাওয়া এক গ্লাস গরম দুধকেই এমন ফলাফলের কারণ মনে হত তার। উপাচার্য পদে যোগদানের পর প্রতি শুক্রবার মসজিদে যাওয়ার অভ্যাস হয় আবু জুনায়েদের। এর পিছনে অবশ্য একটা উদ্দেশ্য আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনমতের হাওয়া কোনদিকে বইছে তার পূর্বাভাস পাওয়া যায় এখান থেকে।

ঘটনাক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকাদার তবারক আলীর সাথে পরিচয় হয় আবু জুনায়েদের। তার শ্বশুরের হাত ধরেই তবারক আলীর আজকের অবস্থান। যার কারণে তবারক আলী আজও কৃতজ্ঞ। সপরিবারে তবারক আলীর বাড়িতে দাওয়াতে গেলে নিজের গরু পোষার ইচ্ছার কথা জানান আবু জুনায়েদ। তবারক আলী দায়িত্ব নিয়ে তার ইচ্ছা পূরণ করেন। লাল রংয়ের অপূর্ব সুন্দর একটি গরু উপহার দেন তবারক আলী। ছিপ নৌকার মতো লম্বা শরীরের গরুটির নাম তরণী। সবচেয়ে সুন্দর তার চোখ দুটি। যা খুব সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ধীরে ধীরে তরুণী নিবাস বা গোয়ালঘরটি আবু জুনায়েদের সবচেয়ে প্রিয় স্থান হয়ে ওঠে। শিক্ষকদের সাথে আলোচনা সভা, আড্ডা সবই তি করতেন গোয়ালঘরে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এবং ফাইলে সই করতেন গোয়ালঘরে বসেই। আহমদ ছফা লিখেছেন “মোগল সম্রাটরা যেমন যেখানে যেতেন রাজধানী দিল্লিকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন তেমনি আবু জুনায়েদ ও দিনে একবেলার জন্য গোটা বিশ্ববিদ্যালয়কে গোয়ালঘরে ঢুকিয়ে ফেলতেন।” গোয়ালঘরকে কেন্দ্র করেই তার দৈনন্দিন সকল কাজকর্ম পরিচালিত হতে থাকল। গোয়ালঘরকে আবু জুনায়েদ আশীর্বাদ মনে করলেও জুনায়েদ সাহেবের স্ত্রী গরুটাকে সতীন বা প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেন। তরণীর (গরু) কারণে তার স্বামী তাকে উপেক্ষা করছে এমন ভাবনা থেকে তিনি তরণীকে হত্যার চিন্তা করেন। পেশাগত কাজে স্বামী বাইরে গেলে তরণীর খাদ্যে বিষ মেশান নূর বানু। বাসায় ফিরে তরণীকে অসুস্থ দেখেন আবু জুনায়েদ। ইতোমধ্যে আমেরিকা থেকে আসা বক্তৃতার অফারের কথা স্ত্রীকে জানাতে গেলে নূর বানু জানান তিনিই গাভীটাকে হত্যা করেছেন।

গাভী ও গোয়ালঘরের কাহিনীর অবতারণা করে লেখক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তরীণ দৈন্য দশা ও ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির নোংরা ও বাজে দিকটি ফুটিয়ে তুলেছেন। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টা ‘সারকাজম’ মনে হলেও এতে তীক্ষ্ম ভাব রয়েছে। ১৯৯৪ সালের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটি রচিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্র এখনো একই রকম। প্রায় সবক্ষেত্রে অযোগ্য ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ পদে সেটে আছেন। দলীয় ও রাজনীতিক কোন্দল বর্তমানে নিত্যকার ঘটনা। বইটি সমাজের এসব ত্রুটি আর অসামঞ্জস্যতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ